Skip to main content

যাকাতের তাৎপর্য ও গুরুত্ব

যাকাত কী? ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হলো যাকাত। মূলত নামাযের পরই যাকাতের স্থান। ইসলাম ও কুফরের মধ্যে পার্থক্যকারী বিষয় যেমন নামায তেমনি যাকাতের অবস্থানও তাই। আল্লাহপাক একই সঙ্গে নামায ও যাকাতকে ফরজ করেছেন। তাঁর বাণী, ‘আর তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো, যাকাত আদায় করো এবং যারা আমার সামনে অবনত হয় তাদের সাথে তোমরাও আমার আনুগত্য স্বীকার করো’-আল বাকারা: ৪৩। কালেমা তাইয়্যেবা ঘোষণার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ঈমান আনে। ঈমান আনার পর ইসলামের সীমার মধ্যে প্রবেশের জন্য তাকে নামায আদায়ের সাথে সাথে যাকাত প্রদানেরও ঘোষণা প্রদান করতে হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘যদি তারা তাওবা করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে, তাহলে তারা হবে তোমাদের দ্বীনি ভাই’-আত্ তাওবা: ১১। যাকাত আদায় না করাকে কাফিরদের কাজ বলে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘তারা যাকাত দেয় না এবং তারা পরকালের ওপরও ঈমান আনে না’-হামীম আস্ সাজদা ৭। একজন ব্যক্তির মুসলমান দাবী করার জন্য নামায যেমন অপরিহার্য শর্ত, তেমনি একজন সচ্ছল (নেসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী) ব্যক্তির জন্য নামাযের সাথে সাথে যাকাতও অপরিহার্য। ইসলামী পরিভাষায় নেছাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারীকে বছরে ২.৫% নির্দ্দিষ্ট খাতে প্রদান করাকে যাকাত বলে। যাকাতের অর্থ : আভিধানিকভাবে যাকাতের দুটি অর্থ। প্রথমত-বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি, ক্রমবৃদ্ধি, প্রাচুর্য ইত্যাদি। আল্লাহপাকের বাণী, ‘যা কিছু তোমরা সুদের ওপর দাও, (তা তো এ জন্যেই দাও) যেন তা অন্য মানুষের মালের সাথে (অন্তর্ভুক্ত হয়ে) বৃদ্ধি পায়, আল্লাহতা’আলার দৃষ্টিতে তা বাড়ে না। অপরদিকে যে যাকাত তোমরা দিয়ে থাক, তা (যেহেতু একান্তভাবে) আল্লাহতা’আলাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে দান করো, তাই বৃদ্ধি পায়। এরাই হচ্ছে (সেসব লোক) যারা (যাকাতের মাধ্যমে) আল্লাহর দরবারে নিজেদের সম্পদ বহুগুণে বাড়িয়ে নেয়’-আর রূম: ৩৯। দ্বিতীয়ত-পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি। আল্লাহপাকের বাণী, ‘তুমি তাদের ধন-সম্পদ থেকে যাকাত ও সদকা গ্রহণ করো, সদকা দ্বারা তাদের পবিত্র করে দিবে, তুমি তাদের জন্য দু’আ করবে; কেননা, তোমার দু’আ তাদের জন্য (হবে পরম) সান্ত্বনা; আল্লাহতা’আলা সবকিছু শোনেন এবং সবকিছু জানেন’-আত্ তাওবা :১০৩। যাকাতের গুরুত্ব : আল্লাহপাক কোনো একটি বিষয় একবার বললেই মানুষ তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে পালন করে থাকে। যেমন রোযা মাত্র একবার বলাতেই মানুষ দীর্ঘ একমাস রোযা আদায় করে। কিন্তু যাকাত বিভিন্ন ভঙ্গিতে মোট ৮২ বার উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও যাকাত (৩০ বার), কোথাও সাদাকা (০৯ বার) আবার কোথাও ইনফাক (৪৩ বার) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং যাকাত আদায় না করার পরিণতি হিসেবে জাহান্নামের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এতে সহজেই আমরা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি। তারপরও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যাকাতের কিছু গুরুত্ব বর্তমান প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। যাকাত সম্পদ বৃদ্ধি করে : ব্যক্তিগত পর্যায়ে আল্লাহর পথে ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যারা নিজেদের সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি শস্যবীজ যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশত শস্যদানা আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও মহাজ্ঞানী’-বাকারা ২৬১। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহতা’আলা সুদ নিশ্চিহ্ন করেন, (অপরদিকে) দান-সদকা (উত্তরোত্তর) বৃদ্ধি করেন; আল্লাহ অকৃতজ্ঞ পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের কখনো পছন্দ করেন না’-আল বাকারা: ২৭৬। যাকাত ও দান-সদাকা শুধু আখিরাতেই নয় আল্লাহপাক এর মাধ্যমে দুনিয়াতেও সমৃদ্ধি দান করেন। বর্তমানে আমাদের দেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রচলিত এবং এ অর্থনীতি সুদনির্ভর। এখানে দান-সদকা একান্তভাবে মানুষের মর্জির উপর নির্ভর করে এবং মানুষ হয়ে পড়ে সংকীর্ণমনা। সম্পদ আহরণের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সবাই লিপ্ত। ফলে সম্পদ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। পুঁজিনির্ভর অর্থনীতির কারণে ব্যাপক উৎপাদন হয়। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার অভাবে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয় না। অর্থাৎ সমাজে মোট আয়ের তুলনায় ব্যয় হ্রাস পায়। যেটাকে আমরা মন্দা বলে থাকি। পুঁজিবাদী অর্থনীতির কারণে মাঝে-মধ্যেই আমরা মন্দার সম্মুখীন হই। মন্দার ফলে অর্থনীতি বিপরিত দিকে চলা শুরু করে। অর্থাৎ স্বল্প চাহিদা > স্বল্প বিনিয়োগ > স্বল্প কর্মসংস্থান > স্বল্প উৎপাদন > স্বল্প আয় চক্রাকারে চলতে থাকে। যেটা বিশ্ববাসী প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিল ১৯৩০-এর দশকে এবং এ মন্দা এখনও বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। সে সময়ের সাড়াজাগানো অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইনস পুঁজিবাদী অর্থনীতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভুত হন। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি (সামষ্টিক অর্থনীতিতে কোনো সমস্যা নেই এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাজের মোট আয় ও ব্যয় সমান হবে (Supply creates its own demand) থেকে বেরিয়ে এসে তিনি বললেন, সমাজের মোট আয় ও ব্যয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমান হয় না এবং আয়ের তুলনায় ব্যয় কম হয়। তিনি ব্যয় বৃদ্ধির তাগিদ দিলেন এবং এ ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপের কথাও জানালেন। ধনীদের তুলনায় দরিদ্রদের ভোগপ্রবণতা অনেক বেশি। কারণ তাদের মৌলিক প্রয়োজনই অপূর্ণ থেকে যায়। তাই তাদের হাতে অর্থ আসার সাথে সাথে তারা বাজারে ছুটে যায়। যে সমাজের প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা যত বেশি সে সমাজে আয় সৃষ্টিও তত বেশি। অর্থনীতিবিদরা হিসাব করে বলে দিলেন, একটি সমাজের প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা ৮০% হলে সে সমাজে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে ৫০০ কোটি টাকা আয় সৃষ্টি হবে। আবার ভোগপ্রবণতা ৫০% হলে আয় হবে ২০০ কোটি টাকা। যাকাত ধনীরা বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করে থাকে আর দরিদ্ররা তাদের অধিকার হিসেবে গ্রহণ করে। যাকাত বন্টনের খাতগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায় সবই দরিদ্ররা পেয়ে থাকে এবং সমাজের সামগ্রিক চাহিদার উপর এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে যাকাত প্রদানের ফলে যাকাতদাতা আল্লাহপাকের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক দুনিয়া ও আখেরাতে তার উত্তম বিনিময় পাবেনই উপরন্তু সামগ্রিকভাবে সমাজে উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে, বিনিয়োগ বাড়বে, আয় বাড়বে। এছাড়াও দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের কারণে সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে যে হিংসা-বিদ্বেষ তাও দূর হবে। পক্ষান্তরে সুদের হারের সাথে বিনিয়োগের সম্পর্ক ঋণাত্বক হওয়ায় কর্মসংস্থান হ্রাস পায়, উৎপাদন হ্রাস পায় এবং আয়ও হ্রাস পায়। সুদ কেবল আখেরাতেই ধবংস ডেকে আনবে না, দুনিয়াতেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। যাকাত সম্পদ পবিত্র করে : ইসলাম হারাম উপার্জনের সকল উৎস বন্ধ করে দিয়েছে। সুদ, ঘুষ, ধোকা-প্রতারণা, খেয়ানত, ওজনে কম দেয়া, ভেজাল দেয়া, জনস্বার্থের পরিপন্থি ও শোষণমূলক সবই হারাম এবং এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন কবিরা গুনাহ যার পরিণতি জাহান্নাম। পরিত্রাণের উপায় হলো আল্লাহর কাছে তাওবা করা এবং যাদের হক নষ্ট করা হয়েছে তাদের হক ফিরিয়ে দেয়া। আজ ধনী-দরিদ্রের মধ্যে যে আকাশচুম্বি বৈষম্য এর মূলে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি। বৈধভাবে উপার্জনের পরও সম্পদ তখনই পবিত্র হবে যখন তার হিসাব করে যাকাত প্রদান করা হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের ধনমাল থেকে যাকাত গ্রহণ করো আর এভাবে তোমরা তাদেরকে (প্রকাশ্যেও) পবিত্র করো এবং (গোপনেও) পরিচ্ছন্ন করো’। যাকাত না আদায় করলে তার সম্পদ হবে অপবিত্র যার পরিণতি জাহান্নাম। তিনি বলেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রুপা সঞ্চিত করে এবং আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না; তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। যেদিন ঐসব স্বর্ণ ও রুপাকে জাহান্নামের আগুনে জ্বালিয়ে দগ্ধ করা হবে, তারপর তা দিয়ে তাদের কপালে, পাঁজরে ও পিঠে সেঁকা দেয়া হবে আর বলা হবে : এ হচ্ছে, তোমরা নিজেরা যা সঞ্চয় করেছিলে তা। কাজেই যা সঞ্চয় করেছিলে, তা কেমন মজা লাগে উপভোগ করো’-তাওবা ৩৪-৩৫। আমাদের দেশীয় আইনে দেখি বৈধ উপায়ে উপার্জনের পর যদি কর প্রদান না করা হয় তাহলে তা কালো টাকায় পরিণত হয় যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবার কর বাদে অতিরিক্ত ১০% প্রদান করে তা সাদা করার সুযোগও মাঝে-মধ্যে দেয়া হয়। ইসলাম রাষ্ট্রীয় দ্বীন। কেউ যাকাত দিতে অবহেলা করলে সরকার যাকাত দিতে বাধ্য করবে এবং এরকম ক্ষেত্রে যাকাত আদায়ের পর সরকার তার সম্পদের অর্ধেক নিয়ে নিতেও পারবে। আর কেউ যদি যাকাত দিতে অস্বীকার করে তবে সরকার তাকে মুরতাদ ঘোষণা করে মৃত্যুদন্ড দিতে পারবে। যাকাত দারিদ্র্য বিমোচন করে : আল্লাহপাক সমগ্র সৃষ্টির স্রষ্টা হওয়ার সাথে সাথে এর লালন-পালনের দায়িত্বও তাঁর এবং এ কাজটি তিনি তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে সম্পাদন করতে চান। তিনি তাঁর সমগ্র সৃষ্টির প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। সাথে সাথে তিনি এটাও চান যে তাঁর প্রতিনিধিরা তাঁর মতই উদার ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী হবে। আল্লাহপাকের বাণী, ‘যে স্বীয় মনের সংকীর্ণতা হতে নিজেকে রক্ষা করলো সেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করলো’-আত্ তাগাবুন : ১৬। সকল মানুষকে তিনি সম মেধা, যোগ্যতা, সুযোগ দান করেননি। প্রত্যেককে তার মেধা, যোগ্যতা ও প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে জবাবদিহি করতে হবে। দুনিয়া একটি পরীক্ষাগার। কাউকে তিনি দিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছেন আবার কাউকে না দিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছেন। তাই স্বাভাবিকভাবে যাকে সম্পদ বেশি দেয়া হয়েছে তার উপর দায়িত্বও বেশি অর্পিত হয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিত জনের প্রাপ্য রয়েছে’-আয যারিয়াত ১৯। যাকাতদাতা সন্তষ্টচিত্তে তার সম্পদ থেকে তার গরীব ভাইয়ের প্রাপ্য বের করে দিয়ে তার সম্পদকে পবিত্র করবে এবং সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করবে। যাকাত মূলত রাষ্ট্রীয়ভাবেই আদায়যোগ্য বিধান এবং সরকারের অন্যতম মৌলিক কাজ। আল্লাহপাকের বাণী, ‘তারা এমন লোক, যাদেরকে আমি পৃথিবীতে রাষ্ট্রক্ষমতা দিলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত ব্যবস্থা চালু করে, সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে। বস্তুত: সব কাজের শেষ ফায়সালা আল্লাহর হাতে ন্যস্ত’-আল হজ্জ ৪১। রসুল (সা) এবং সাহেবায়ে কেরাম (রা) সরকার প্রধান হিসেবেই যাকাত আদায় করেছেন। তাঁরা ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করে দরিদ্রদের মধ্যে তা বন্টন করেছেন। যাকাতের আটটি খাতের মধ্যে দরিদ্রদের অংশটাই প্রাধান্য পেয়েছে। যাকাত বন্টনের খাতসমূহ : ‘যাকাত তাদের প্রাপ্য যারা দরিদ্র, মিসকিন, যারা যাকাত আদায়ের কর্মচারি, যাদের চিত্ত আকর্ষণ কাঙ্ক্ষিত এবং দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাবান’-তাওবা ৬০। যাকাতের উদ্দেশ্য হলো, দরিদ্রকে দারিদ্র্য মুক্ত করা ও তার প্রয়োজন মেটানো। তাই যাকাত যে পরিমাণ দিলে সে দারিদ্র্য থেকে স্থায়ীভাবে সচ্ছল হতে পারে এবং পরমুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বনির্ভর হতে পারে, সেই পরিমাণ তাকে দিতে হবে। এভাবে দারিদ্র্য বিমোচন সরকারি ব্যবস্থাপনায় কেবল সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি উদ্যোগে নামাযের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্যতামূলক যাকাত আদায় সরকার নৈতিকভাবে সক্ষম হচ্ছে না। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে যে যাকাত আদায় হয় তা একান্তই ঐচ্ছিক এবং পরিমাণেও সামান্য। আল্লাহর পথে : যাকাত বন্টনের সুনির্দ্দিষ্ট খাতসমূহ উল্লেখের পর ফি সাবিলিল্লাহ খাত ব্যাপক অর্থপূর্ণ। কারণ বাকি ৭টি খাতে ব্যয়ও মূলত আল্লাহর পথেই। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে যে কোনো নেক কাজে ব্যয়ই আল্লাহর পথে। যুগের প্রয়োজনে সমসাময়িক ফকীহরা অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে এ খাতে ব্যয় ঠিক করতে পারেন। একটা সুযোগ শরীয়ত প্রণেতা উন্মুক্ত রেখেছেন। ফি সাবিলিল্লাহ জিহাদ ফি সাবিল্লিাহ অবশ্যই। কিন্তু নির্দ্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। বর্তমান যুগে উম্মাহ বহুমুখি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নানামুখি তৎপরতা বিশেষ করে বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা বেশি প্রয়োজন। স্যাটেলাইট চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা, বই-পুস্তক রচনা এবং দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে মুবাল্লিগ নিয়োগ কাজে এ খাত থেকে ব্যয় করা যেতে পারে। যে সব সংগঠন এসব কাজ আঞ্জাম দেয় তাদের যাকাত থেকে প্রদান করা উত্তম হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ছাড়াও দ্বীনি শিক্ষা প্রসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং ছাত্র-শিক্ষকের প্রয়োজন পূরণও হতে পারে। শিক্ষকদেরকেও সম্মানি দেয়া যাবে যদি তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থাকার কারণে আয় উপার্জনের আর কোনো সুযোগ না পান। আল্লাহর বাণী, ‘এটা (যাকাত) প্রাপ্য সেসব অভাবগ্রস্ত লোকদের, যারা আল্লাহর কাজে নিয়োজিত থাকায় জীবিকার জন্য জমিনে পদচারণা করতে পারে না এবং (আত্মসম্ভ্রমের কারণে) কারও নিকট হাত পাতে না বলে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদের (দারিদ্রের) লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট মিনতি করে যাচনা করে না। আর যে কল্যাণকর কিছু তোমরা ব্যয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত’- বাকারা ২৭৩। যাকাত সংগ্রহ পদ্ধতি : যাকাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য দেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে আদায় ও বন্টনের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব। আল্লাহপাক তাঁর রসুলকে ধনীদের নিকট থেকে আদায় করে তা দরিদ্রদের মধ্যে বন্টনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআন মজিদে বিভিন্ন ভঙ্গিতে বলা হয়েছে তাদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করো এবং পবিত্র করো ইত্যাদি এবং রসুল (সা) ও তাঁর সাহাবীদের আমলও ছিল তাই। কুরআন মজিদে রাষ্ট্র সরকারের ৪টি দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে-তার মধ্যে নামায কায়েম ও যাকাত আদায় অন্যতম। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার সে দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারছে না। ফলে যাকাতের মত এত কল্যাণকর ব্যবস্থার সুফল থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। অথচ রসুল (সা) ও তাঁর সাহাবীরা (রা) খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে হেজাজের মত একটি দরিদ্র দেশকে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করেছিলেন। আমাদের দেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যাকাত প্রদানের মাধ্যমে মূলত দারিদ্র্য বিমোচন নয় বরং দারিদ্রের চাষ হয। এতে যাকাতদাতার মধ্যে থাকে একটা প্রদর্শনীভাব এবং গ্রহীতার মধ্যে থাকে চরম হীনমন্যতা। পবিত্র রমযান মাসে যাকাত সংগ্রহে পদদলিত হওয়া ও পুলিশের লাঠির আঘাতের কথা পত্রিকায় আমাদের চোখে পড়ে। এ থেকে আমাদের পরিত্রাণ দরকার। সরকার আমাদের দেশে নামায আদায়ের ব্যবস্থা না করতে পারলেও মানুষ স্বউদ্যোগে মসজিদ নির্মাণ ও ইমাম-মুয়াজ্জিন নিয়োগের মাধ্যমে জামায়াতে নামায পড়ার সুন্দর ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। আমাদের এ জনপদে দীর্ঘকাল থেকে নামাযের সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকলেও যাকাতের ব্যাপারে ঔদাসীন্য লক্ষণীয়। হিসাব করে যাকাত আদায় এবং ফসলের যাকাত ওশর আদায়ে খুবই দুর্বলতা রয়েছে। অথচ নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ নেই। ইবনে যায়েদ (রা) বলেন, ‘নামায ও যাকাতকে একসঙ্গে ফরজ করা হয়েছে, এ দুটির মধ্যে কোনোরুপ পার্থক্য করা হয়নি’। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, ‘তোমাদের একসঙ্গে আদেশ করা হয়েছে নামায কায়েম করতে ও যাকাত আদায় করতে। তাই কেউ যাকাত আদায় না করলে তার নামাযও হবে না’। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) বলেন, ‘নামায ও যাকাত একটি অপরটির সম্পুরক, একটি ছাড়া অন্যটি কবুল হয় না’। নামাযের ব্যাপারে আমরা অনেকখনি আন্তরিক, বিশেষ করে মসজিদ কমিটিকে অনেক ব্যস্ত দেখা যায়। নামাযের মত যাকাতও সামষ্টিক ইবাদত এবং যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারিদের বেতন-ভাতা প্রদান যাকাতের অন্যতম খাত। মসজিদ কমিটির তত্ত্বাবধানে মহল্লার সকলে মিলে মসজিদে ইমামের নেতৃত্বে যেমন নামায আদায় করেন তেমনি মহল্লাহর সকলের যাকাত একত্র করে মহল্লার দুস্থদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেনিটেশন ও দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর ভূমিকা রাখা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে মসজিদ এলাকায় যাকাত প্রদানের উপযুক্ত লোকদের তালিকা প্রণয়ণ, তাদেরকে একত্রিত করে যাকাত দানে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ মসজিদ কমিটি থেকে হতে পারে এবং এসব কাজে যে ব্যয় তা যাকাত ফান্ড থেকে বহন করা যায়। এ ছাড়াও যাকাত আদায় ও বন্টনের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক বা জাতীয়ভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোলা যায় যাদের কাজ হবে যাকাত সংগ্রহ করে তার ওপর ভিত্তি করে দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান গড়ে তোলা। সর্বোপরি আমাদের এমন সরকার ব্যবস্থা কায়েমের জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানো উচিত যাদেরকে আল্লাহপাক রাষ্ট্রক্ষমতা দান করলে তাঁর ঘোষণা মোতাবেক তারা নামায কায়েম ও যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা এবং সমাজ থেকে দুষ্কৃতি দূর করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। মূলত এ প্রচেষ্টার মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ। উপসংহার : যাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, অন্যতম বুনিয়াদ এবং আখিরাতে নাযাতের উপায় হওয়ার সাথে সাথে দুনিয়ার জীবনেও একটি সচ্ছল ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে টিকে থাকার উপায় হিসেবে ভূমিকা পালন করে। যাকাত দিলে সম্পদ কমে না বরং ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে সম্পদ অনেক বেড়ে যায় এবং যাকাত আদায় না করার মধ্যে আমাদের ধ্বংস নিহিত রয়েছে। আল্লাহপাকের বাণী, ‘আল্লাহর পথে খরচ করো এবং আপন হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেও না। ইহসানের পথে চলো’-বাকারা ১৯৫। মেধা, যোগ্যতা, সুস্থতা ও সম্পদ সবই আল্লাহর। আল্লাহ বারবার বলছেন ‘আমরা যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করো’। আল্লাহর দেয়া রিজিক তাঁর বান্দাদের প্রয়োজনে, তাঁর দ্বীনের প্রয়োজনে উদার হস্তে আমরা খরচ করি এবং কত খরচ করছি তা হিসেব না করি তা হলে আল্লাহও আমাদের উদার হস্তে দান করবেন। আল্লাহপাক আমাদেরকে সকল সংকীর্ণতার ঊর্দ্ধে উঠে হিসাব করে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে তাঁর প্রিয়ভাজন বান্দাহ হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Comments