Skip to main content

ফিতরা (সদকাতুল ফিতর)




ফিতরা কী : 
রমযানের শেষে রোযার পরিশুদ্ধকরণ ও গরীব-দুখী মানুষকে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য বাধ্যতামূলক প্রদত্ত দানকে সদকাতুল ফিতর (রোযার সদকা) বা ফিতরা বলা হয়। দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে ফিতরার বিধান জারি করা হয়।

ফিতরার উদ্দেশ্য : 
এর দুটি উদ্দেশ্য। এক. রোযাদারের রোযার পরিশুদ্ধকরণ, দুই. বিত্তহীনদের সহায়তা করা।

ফিতরা কার ওপর ওয়াজিব :

বুখারি শরীফে ফিতরা সম্পর্কীয় ১০টি হাদিস (১৪০৫-১৪১৪) উল্লেখ করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) ও আবু সাঈদ খুদরী (রা) হাদিসগুলো বর্ণনা করেছেন।

১৪০৬ নং হাদিসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বর্ণিত। নবী করীম (সা) মুসলিম পুরুষ-রমণী, স্বাধীন ও গোলাম প্রত্যেকের ওপর এক ছা খেজুর বা এক ছা যব ধার্য করে দিয়েছেন।

১৪০৯ নং হাদিসে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা) ছদকায়ে ফিতর বাবদ এক ছা খেজুর বা এক ছা যব প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বলেন, পরবর্তীকালে লোকেরা (আমীর মুয়াবিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা) তার স্থলে দু মুদ (চার মুদে এক ছা) গম নির্ধারণ করেছেন।

১৪১০ নং হাদিসে আবু সাঈদ খুদরী (রা) বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা)-এর যামানায় আমরা ফিতরা বাবদ (জনপ্রতি) এক ছা খেজুর বা এক ছা যব বা এক ছা গম বা এক ছা কিসমিস প্রদান করতাম। মুয়াবিয়া (রা)-এর আমলে যখন গম আমদানী হলো তখন তিনি বললেন, আমার মতে এর এক মুদ দুমুদের সমান।

১৪১২ নং হাদিসে আবু সাঈদ খুদরী (রা) বর্ণিত। নবী করীম (সা)-এর যামানায় ঈদুল ফিতরের দিন আমরা ফিতরা বাবদ মাথাপিছু এক ছা পরিমাণ খাদ্য-দ্রব্য প্রদান করতাম। তিনি বলেন, তখন আমাদের খাবার ছিল যব, কিসমিস, পনির ও খুরমা।

ফিতরা সম্পর্কে ইমামদের মাঝে বেশ মতবিরোধ রয়েছে। উপরের হাদিসগুলো থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, সকল মুসলমানের উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, মনিব-ভৃত্য সবাইকে ফিতরা প্রদান করতে হবে। ঈদের দিন সকালে যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয় তার উপরও ফিতরা প্রদান ওয়াজিব। বাড়ির প্রধান সকলের পক্ষ থেকে ফিতরা প্রদান করবেন। তবে কেউ তার নিজেরটা প্রদান করলে সমস্যা নেই। কারো পক্ষে কেউ চাইলে প্রদান করতে পারবেন। বাড়ির দাস-দাসী ও কর্মচারীর সুনির্দিষ্ট বেতন নির্ধারিত না হলে মালিক তাদের পক্ষে প্রদান করবেন।

ইমাম আবু হানিফা (রহ) ছাড়া বাকি তিনজন ইমাম ফিতরা প্রদানে নেছাব মানেননি। যার মৌল প্রয়োজন (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান) পূরণের ব্যবস্থা আছে অর্থাৎ ঈদের দিনের খাবারের অতিরিক্ত ফিতরা দেয়ার মতো কিছু থাকলে তাকে ফিতরা প্রদান করতে হবে। (ইমাম মালেক, শাফেয়ী ও আহমদের মতে নিজ ও পরিবারের একদিন ও একরাতের খাবারের অতিরিক্ত এক ছা পরিমাণ খাবার থাকলেই ফিতরা ওয়াজিব) তাঁদের যুক্তি দরিদ্ররাও রোযা রাখে এবং তাদেরও রোযার পরিশুদ্ধি প্রয়োজন। ফলে তাদেরকে ফিতরা দিতে হবে। প্রয়োজনে আবার তারা নেবে, যেমন ওশর প্রদানকারী ফসল ওঠার সাথে সাথে নেছাব পরিমাণ হলে তার সম্পদের পবিত্রতা সাধনের লক্ষ্যে ওশর প্রদান করে যদিও সেই ফসল তার সারা বছরের জন্য যথেষ্ট নয়। আর একটি বিষয়, যাকাত হলো ধন-মালের পবিত্রতা সাধন আর ফিতরা হলো ব্যক্তির পবিত্রতা সাধন। প্রশ্ন উঠতে পারে শিশু ও অতিরিক্ত বৃদ্ধদের রোযা রাখা থেকে অব্যাহতি রয়েছে, তাদের ফেৎরা কেন? ফিতরার দ্বিবিধ উদ্দেশ্য : এক. রোযার পরিশুদ্ধকরণ, দুই. দরিদ্রদের ঈদের আনন্দে শরীক করানো। ফলে শিশু-বৃদ্ধ সকলের পক্ষ থেকে ফিতরা প্রদান করতে হবে। ইমাম আবু হানিফার (রহ) মতে ঈদের দিন যে নেছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক তাকে ওয়াজিব হিসেবে ফিতরা প্রদান করতে হবে।

ফিতরা কখন প্রদান করতে হবে :

ঈদের নামাযের পূর্বে প্রদান করতে হবে এবং ঈদের ২/১ দিন আগেও দেয়া যাবে। সাহাবা (রা)-দের আমল এমনই ছিল। যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে প্রদান করবে সেটা হবে তার জন্য পবিত্রতা বিধানকারী। পক্ষান্তরে যে পরে দিবে সেটা হবে সাধারণ দান। ইবনে ওমর (রা) ঈদের ২/১ দিন আগে দিতেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ)-এর মতে রমযানের পূর্বেও দেয়া যায়। আমাদের দেশে সাধারণত রমযানের শেষে বা ঈদের পূর্বে দেয়ার নিয়ম চালু আছে। ফিতরা না দিলে সে ঋণী থেকে যাবে। ফিতরা আদায় না করলে যাকাত প্রদান না করার মতো গুনাহ হবে।

ফিতরা কারা পাবে : 

যারা যাকাত পাওয়ার অধিকারী ফিতরা পাওয়ার অধিকারীও তারা। যাকাতের আটটি খাত রয়েছে। ফিতরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করতে হবে।

ইবনে ওমর (রা) বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা) ফিতরা ধার্য করেছেন এবং বলেছেন, দরিদ্রদেরকে এ দিন তোমরা অভাবশূন্য করে দাও। অন্য বর্ণনায় বলেছেন, দরিদ্রদেরকে এ দিন ঘরে ঘরে ধর্ণা দেয়া থেকে অব্যাহতি দাও। দারিদ্র বিমোচন হলে অন্যান্য খাতও বিবেচনায় আসতে পারে। অমুসলিম নাগরিকদের ফিতরা প্রদান সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফা (রা)সহ অনেকে অনুমতি দিয়েছেন।

এক ছা, অর্দ্ধ ছা ও অর্থদানের মাধ্যমে ফিতরা প্রদানে বিতর্ক :

এ মতপার্থক্য সুদূর অতীত থেকে চলে আসছে। রসুলুল্লাহ (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে মক্কা-মদীনার প্রধান খাদ্যশস্য থেকে এক ছা (বর্তমান ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) পরিমাণ ফিতরা প্রদান করেছেন। রসুলুল্লাহ (সা) কোনো একটি নির্ধারণ না করে তাঁর উম্মতের সহজতা বিধানের জন্য তাঁদের প্রধান খাদ্যশস্য থেকে যে কোনো একটির এক ছা পরিমাণ প্রদানের কথা বলেছেন। নিশ্চয়ই যব, গম, খেজুর, খোরমা, কিসমিস, পনিরের মূল্য এক ছিল না। এখানে সামর্থ ও বিবেচনাবোধে তাঁরা প্রদান করেছেন। ইবনে ওমর (রা) খেজুর দিতেন এবং মদীনায় খেজুরের অভাব দেখা গেলে তিনি একবার যব দিয়েছিলেন।

হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রা)-এর শাসনামলে তিনি হজ্জ বা ওমরা উপলক্ষে মদীনায় আসেন এবং মিম্বরে বসে জনগণের সাথে কথা বলেন। তিনি বললেন, আমি মনে করি, সিরিয়ার গমের অর্ধ ছা এক ছা খোরমার সমান। লোকেরা সেটি মেনে নিলো। আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, আমি সারাজীবন এক ছা হিসেবেই দিয়ে আসছি। এখানে মনে হচ্ছে গম মদীনার প্রধান ফসল নয় এবং এটি আমদানিকৃত। গমের দাম অন্যান্য ফসলের প্রায় দ্বিগুণ। আমির মুয়াবিয়া (রা) মূল্য বিবেচনা করে বলেছেন, অর্ধ ছা গম দিয়ে দিলেও ফিতরা আদায় হবে। ইমামদের মাঝে এ নিয়ে বেশ মতপার্থক্য রয়েছে। সকলের মত হলো এক ছা হিসেবে ফিতরা প্রদানের। গম থেকে ফিতরা দিতে চাইলে ইমাম আবু হানিফা (রহ)সহ অনেকের মত অর্ধ ছা দেয়া যাবে।

আমাদের দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। আমরা ফিতরা হিসেবে চাল দিতে চাইলে এক ছা হিসেবেই দিতে হবে। গমও বলা যায় আমাদের প্রধান খাদ্যশস্যের তালিকায় অন্যতমও হিসেবে চলে এসেছে। এখানে গমের চেয়ে চালের দাম বেশি। আমির মুয়াবিয়া (রা) গমের দাম বেশি হওয়ার কারণে গম অর্ধ ছা করে দেয়ার কথা বলেছেন। তাকওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করে আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার আমরা চাল না গম ফিতরা হিসেবে প্রদান করবো।

আর একটি প্রশ্ন রয়েছে, খাদ্যশস্যের পরিবর্তে টাকা দেয়ার বিষয়টি। রসুলুল্লাহ (সা) ও সাহাবায়ে কেরামদের যুগে মুদ্রার প্রচলন ছিল খুবই সীমিত। আর মানুষের পেশা ছিল কৃষিভিত্তিক। উৎপাদিত ফসল প্রদান ছিল সহজ এবং আবাদকারী তাতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। এ দেশেও আমরা লক্ষ্য করেছি, গ্রামে অনেক সেবার বিনিময়ে মানুষ দ্রব্য প্রদান করতো এবং সেটিই ছিল সহজ। কিন্তু বর্তমানে মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন দ্রব্য বিনিময় প্রথাকে অনেকটা বিলুপ্ত করে দিয়েছে। তাই খাদ্যশস্য প্রদান ছাড়াও কেউ যদি খাদ্যশস্যের মূল্য নির্ধারণ করে নগদ অর্থ প্রদান করেন তাহলে তার ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। এ মত সমর্থন করেন ইমাম আবু হানিফা (রহ) ও বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ ফকীহ আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতি বছরের মতো এ বছরও ফিতরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অর্ধ ছা গমের (১ কেজি ৬৫০ গ্রাম) বাজার মূল্য ধরে সর্বনিম্ন ফিতরা ৭০/- টাকা এবং সর্বোচ্চ ২২০০/- টাকা নির্ধারণ করেছেন। আপনি নিজে যে মানের চাল খান তার এক ছা (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) পরিমাণের বাজার দর হিসাব করে জনপ্রতি ফিতরা দিতে পারেন। ৫০/- টাকা কেজি চাল হলে ফিতরা হবে ১৬৫/-টাকা। আমার মনে হয় সেটিই উত্তম হবে।

আমার একটি সহজ হিসাব হলো যেখানে মতপার্থক্য রয়েছে সেখানে যে কোনো একটি মত গ্রহণের সুযোগ আমার আছে। আল্লাহপাক আমাদেরকে জ্ঞান-বুদ্ধি ও যোগ্যতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর দেয়া বিবেককে কাজে লাগিয়ে যে কোনো একটি আমল করলে আশা করা যায় আল্লাহপাক কবুল করবেন। সব ক্ষেত্রে নিয়তই মুখ্য। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন ৭০/- টাকা হিসাবে প্রদান করলে কোনো সমস্যা আছে কি? আমি বলবো, না। একদল বিশেষজ্ঞ আলেমের এটি সম্মিলিত মত। 

আমি অপছন্দ ও গুনাহ মনে করি, উম্মাহর মতপার্থক্যগত বিষয়ে পরস্পর ঝগড়া-ঝাটি ও হিংসা-বিদ্বেষকে। আমি এখানে যা কিছু লিখেছি এটি অধ্যয়নগত ফলাফল, আমার নিজের কিছুই নয় এবং মেহেরবানী করে কেউ এটাকে ফতোয়া মনে করবেন না। আল্লাহপাক আমাদেরকে সঠিকটি উপলব্ধি ও ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন। ১৭ রমযান ১৪৪১, ১১ মে ২০২০।



Comments