চীনের উহান শহরে ৩১ ডিসেম্বর দেখা দেয়া করোনায় এই পাঁচ মাসে সাড়ে তিন লক্ষ লোক প্রাণ হারালো এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৫৫ লক্ষ ছেড়ে গেছে। বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত এবং ১৮ মার্চ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া করোনায় ঝরে পড়লো পাঁচ শতাধিক প্রাণ এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ হাজার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে ১ মে ছিল ৬ হাজার এবং গতকাল (২৫ মে) এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে। এই করোনা মহামারি বিশেষ কোনো দেশ বা মহাদেশে সীমাবদ্ধ নয়, এটি বিশ্বব্যাপী।
আমরা জানছি, বিমানের কারণে দেশ-মহাদেশে এই করোনা দ্রুত ছড়িয়েছে। বিস্ময়কর হলো, চীনের উহান থেকে সাংহাই, বেইজিংসহ চীনের কোনো শহর বা জনপদ, আবার তার নিকটবর্তী ও বন্ধু রাষ্ট্র মিয়ানমার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান- যাদের সাথে চীনের ব্যবসায়িক লেনদেন ও যাতায়াত অনেক বেশি সেখানে করোনা প্রথমে ছড়ায়নি। আমাদের দেশে প্রচুর চীনা নাগরিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকান্ড ও শিল্প-কারখানায় নিয়োজিত এবং চীনে আমাদের যাতায়াতও অনেক বেশি। অথচ করোনা প্রথম আঘাতটা হানলো পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার আমেরিকাসহ পারমানবিক শক্তিধর ইউরোপীয় দেশসমূহে। শিক্ষিতের হার শতভাগ, স্বাস্থ্যসচেতনা, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও জনঘনত্বের দিক দিয়ে তারা অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে। কিন্তু আক্রান্ত ও মৃত্যু উভয় দিক দিয়ে তারা অগ্রগামী। এক আমেরিকায় মৃত্যু লাখ ছুঁই ছুঁই করছে এবং আক্রান্ত ১৬ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা এ সব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন।
আমি ইতিহাসের ছাত্র না। আমার ইতিহাস জ্ঞান কিছুটা কুরআন ও হাদিসকেন্দ্রিক। আমি এমন এক আল্লাহতে বিশ্বাসী যিনি সবকিছু সৃষ্টির পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছেন এবং তাঁর ক্ষমতা নিরঙ্কুশ। তিনি যেটি হুকুম করেন সেটি তাৎক্ষণিক হয়ে যায়। আবার অনেক কিছু সৃষ্টি করার পর সেই সৃষ্টির মধ্যে কিছু ক্ষমতা ও নিয়মাবলী দিয়ে ছেড়ে দেন; যেটাকে আমরা কার্যকারণ সম্পর্ক বলে থাকি। বিপদ-মুছিবত আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে। বিপদ কোনো সময় আসে গজব হয়ে আবার কোনো সময় আসে পরীক্ষা হিসেবে। জালেমরা যখন সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনে পৃথিবীটাকে ভরে তুলে তখন আল্লাহপাক সে সব স্বৈরশাসকদের শাস্তি প্রদান করে পৃথিবীবাসীকে স্বস্তি দান করেন। শক্তিধর ফিরাউন ও নমরুদের করুণ পরিণতির কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। আবার হাজার হাজার পাখির কঙ্কর নিক্ষেপে আবরাহার বিশাল হস্তিবাহিনীর ধ্বংসও ব্যাখ্যাতীত।
আল্লাহর নাফরমানি ও পাপাচারে মানুষ যখন সীমালঙ্ঘন করে তখনও আল্লাহপাক পাকড়াও করেন। লুত (আ)-এর জাতি অশ্লীলতার চরম সীমায় পৌঁছেছিল এবং সমকামিতায় অভ্যস্ত হওয়ার কারণে আল্লাহ সে জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। রসুলুল্লাহ (সা) সতর্ক করে দিয়েছেন, কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা চরম মাত্রায় দেখা দিলে আল্লাহ সেই জাতির মধ্যে বালা-মুছিবত নাযিল করেন। ওজনে কমবেশি করার অপরাধে আল্লাহতায়ালা শোয়াঈব (আ)-এর জাতিকে ধ্বংস করেছিলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী জাতি ছিল আদ ও সামুদ। তারা সে সময়ে উন্নত ইমারত নির্মাণসহ বৈষয়িক অনেক সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি আল্লাহর নাফরমানিতেও ছিল সেরা। তাদের শৌর্য-বীর্য আল্লাহর গজবকে রোধ করতে পারেনি। এ সব ইতিহাস আল্লাহপাক আমাদের নিকট এজন্যই পেশ করেছেন যাতে আমরা সতর্ক হই ও জমিনে বাড়াবাড়ি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি থেকে বিরত হই।
এই করোনা আল্লাহর অতি ক্ষুদ্র এক জীবাণু যা কেবল শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা সম্ভব। অথচ সমগ্র বিশ্ববাসী এই করোনায় আক্রান্ত হয়ে দলে দলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, আস্তিক-নাস্তিক সবাইকে সমভাবে এই করোনা আঘাত করছে। এটি প্রিয়তম নবী (সা)-এর কথা। কিয়ামতের দিন পুনরুত্থিত হওয়ার দিন ভিন্ন ভিন্ন আমল নিয়ে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উঠবে। করোনা ভাইরাস মারাত্মক ছোঁয়াছে ও মরণঘাতি এবং এ থেকে দূরে থাকার জন্য নিয়ম-বিধি মেনে চলার পাশাপাশি আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে হবে। যত বড় বুজর্গই হন, আপনি যদি করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদ না থাকেন তাহলে আপনাকে ধরবে (একে বলে কার্যকরণ সম্পর্ক); আর যদি না ধরে এবং নিরাপদ দূরত্বে থাকার পরও ধরে তাহলে বুঝবেন আল্লাহর হুকুম (তকদির)। আমরা আল্লাহর বান্দার পাশাপাশি তাঁর খলিফা। আমাদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, ক্ষমতা পুরোপুরি প্রয়োগ করেই আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে হবে। এটি রসুল (সা)-এরই শিক্ষা।
বর্তমান বিশ্ব জুলুম-নির্যাতনে ভরে উঠেছে। মজলুমের আহাজারিতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠছে। অসহায় মানুষের এতো আর্তনাদ না শুনে আল্লাহ কী করে পারেন? মনে রাখতে হবে, এখন যা হচ্ছে তা জালেমের শাস্তি নয়, জালেমের সত্যিকার শাস্তি পরকালে যা দেখে মজলুমের হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে উঠবে। দুনিয়ার শাস্তি খুবই মামুলী, জালেমকে জুলুম থেকে ফিরিয়ে রাখা মাত্র। আফগান্তিান, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মিরসহ দেশে দেশে যে নরহত্যার তান্ডব তার মূল হোতা আমেরিকাসহ ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ। করোনার বড় আঘাতটাই তাদের ওপর। শুধু কি জুলুম? নগ্নতা-বেয়াহাপনাতেও তারা সেরা, সমকাতিকাকে তারা আইনসিদ্ধ করেছে। প্রকৃতিবিরুদ্ধ (ইসলাম বিরোধী) পন্থা অবলম্বনের ফলে তাদের দেশে শিশু-কিশোর ও যুবকের মারাত্মক স্বল্পতা ও বৃদ্ধের আধিক্য। নেশাগ্রস্ততাও তাদের আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বেশি হওয়ার পেছনে অনেকখানি দায়ী।
আমরা লক্ষ্য করছি, করোনার দাপট মুসলিম দেশসহ এশিয়ায় তুলনামূলক কম ও ধীর গতিসম্পন্। অবশ্য বর্তমানে রাশিয়া ও ভারতসহ এশিয়ায় এর বিস্তার ঘটছে। সুযোগ দেয়া হয়েছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সংশোধনের। আমাদের দেশেও দ্রুত বিস্তার ঘটছে। করোনার প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সুফল পাওয়া যাবে। সর্বোপরি একটি বিশ্বাসী জাতি হিসেবে আল্লাহর কাছে যেভাবে আত্মসমর্পণ এবং আল্লাহর বান্দাদের প্রতি সদয় হওয়ার দরকার ছিল আমরা তা হতে ব্যর্থ হয়েছি। ইসলাম আমাদের রক্ষাকবচ এবং ইসলামই আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তি দিবে। এই বোধ-উপলব্ধি আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
আমরা যদি আল্লাহর কাছে ফিরে আসি তাহলে তিনি আমাদের জন্য যথেষ্ট হতে পারেন। তাঁর বাণী, ‘এটা আল্লাহর রীতি নয়, লোকেরা ক্ষমা চাইতে থাকবে আর তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন’- সূরা আনফাল ৩৩। করোনা চলমান এবং তার সাথে আম্ফানের আঘাত। সবই আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। আমি এ কথা বলিনা, সতর্কতা-সাবধানতা অবলম্বন ছেড়ে দিয়ে আমরা কেবল আল্লাহর ওপর নির্ভর করে থাকবো। বুঝতে হবে, মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হতে হবে এবং খলিফা হিসেবে তার অনেক কিছুই করণীয় আছে। আমার নিজের কথা বলতে পারি। স্রেফ সতর্কতার জন্য মসজিদে না গিয়ে আমি ঘরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছি এবং ঈদের নামাযও ঘরে আদায় করেছি।
আমি আগেই বলেছি, কোনো কিছু ঘটার ক্ষেত্রে প্রথমত রয়েছে আল্লাহর হুকুম এবং দ্বিতীয়ত কার্যকরণ সম্পর্ক। করোনার মধ্যে যে গুণ, বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতা রয়েছে মানুষ তা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করে করোনার ভ্যাক্সিন বা ঔষধ আবিষ্কারের মাধ্যমে করোনাকে জয় করতে পারবে। কিন্তু মানুষের যদি নৈতিক পরিবর্তন না হয় তাহলে এই পৃথিবী ও এর জনগোষ্ঠীর কোনো কল্যাণ সাধিত হবে না। বারবার করোনা বিভিন্ন রূপ ধরে আসবে। আমার বিশ্বাস করোনা সহজেই দূর হবে না এবং করোনা পরবর্তী বিশ্ব নতুন প্রজন্মের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে ইনশা-আল্লাহ। আমরা চাই হিংসা-বিদ্বেষ ও জুলুমমুক্ত এবং ইনসাফপূর্ণ এক বিশ্ব। আমরা তারই প্রতীক্ষায় রইলাম। ২৬.০৫.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment