মানুষ আল্লাহর সকল
সৃষ্টির সেরা, তাঁর বান্দাহ ও প্রতিনিধি (খলিফা)। নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র,
সাদা-কালো, খাটো-লম্বা, বাঙালি-অবাঙালি, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, নানা বর্ণ, ভাষা, ধর্ম,
লিঙ্গের পার্থক্যসহ তাঁর এই সুন্দর বাগান। মানবিক মর্যাদায় কোনো পার্থক্য নেই,
পার্থক্য শুধু নীতি-নৈতিকতায় (তাকওয়া)। কত বৈচিত্র্যপূর্ণ তাঁর সৃষ্টি। কারো
চেহারার সাথে কারো চেহারার মিল নেই, মিল নেই কণ্ঠস্বরে, এমন কি চিন্তা-চেতনা ও
বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপেও। এ সবই সাক্ষ্য বহন করে তাঁর অসীম শক্তিমত্তা ও কলা-কৌশলের।
সবাইকে একই মতাদর্শ, একই বর্ণ বা সব দিক দিয়ে সমান করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল।
কিন্তু তা তিনি করেননি। তিনি চান বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য, এতো কিছু পার্থক্যসহ
সমঝোতা ও পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে একটি সুখি ও সুন্দর সমাজ গড়ে
তুলবে তাঁরই প্রতিনিধি এই মানবসমাজ। প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে যারা
স্রষ্টার কাছে ফিরে যাবে তাদের জন্য থাকবে অফুরন্তু সুখ-সম্ভোগেপূর্ণ চিরন্তন
জান্নাত, আর যারা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করে নিজেই মালিক হয়ে বসবে
বা কোনো সীমালঙ্ঘনকারীর (তাগুত) আনুগত্য করবে তাদেরকে দিয়ে পূর্ণ করবেন ভয়াবহ ও
চিরন্তন জাহান্নাম।
ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য
মানবসমাজে একটি বড় ধরনের পার্থক্য। এটিও তাঁর একটি পরীক্ষা। ধনীর সম্পদে রয়েছে
বঞ্চিত ও প্রার্থীদের অধিকার। এই অধিকার আদায়ে কে কতখানি যত্নশীল আল্লাহপাক সেটি
যাচাই করছেন এবং দরিদ্রের থেকে গ্রহণ করছেন তার ধৈর্য ও আল্লাহর ওপর নির্ভরতার
পরীক্ষা। সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ এবং যাকে রুজির প্রাচুর্যতা দান করেছেন,
সেটি মূলত তার রবের অনুগ্রহ ও পরীক্ষা। আল্লাহপাক নিজে যেমন রিজিক প্রদান করছেন
সাথে সাথে তাঁর প্রতিনিধিরাও তাঁর পক্ষে রিজিক বন্টন করবে সেটি তাঁর চাওয়া।
ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান, অসুস্থকে সেবাদান স্রেফ কোনো মানুষকে নয় বরং আল্লাহর
প্রতিনিধিকে করার মধ্য দিয়ে তাঁকেই করা। স্কুলজীবনে পড়েছিলাম- ‘হাশরের দিন বিচারে বসিয়া সুধাবে জগৎস্বামী; তুমি
মোরে করো নাই সেবা, যবে রুগ্ন যে ছিলাম আমি।’ এটা শুধু কবির কবিতা নয়, এটা হাদিসের বাণী। কত আবেগময় কথা। আল্লাহ
বলবেন, আমি অসুস্থ ছিলাম, আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম আর মানুষ বলবে, হে পরোয়ারদেগার! এ
কেমন করে হয়? আল্লাহ বলবেন, আমার বান্দাহ অসুস্থ ছিল, ক্ষুধার্ত ছিল তারে
সেবা-যত্ন ও খাওয়ালে আজ আমাকে পেতে।
রমযানের রোযা
নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র সকলকে একই সাথে একই নিয়মে পালন করতে হয়। ক্ষুধার যে কষ্ট
তা ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ সমভাবে উপলব্ধি করে। বক্তৃতা দিয়ে নয়, হাতে-কলমে
অনুশীলনের মাধ্যমে দরিদ্রের ক্ষুধার জ্বালা ধনীকে উপলব্ধি করানো হচ্ছে রোযার
মাধ্যমে। রোযা একই সাথে ফরজ করা হয়নি। প্রথমে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দরিদ্রদেরকে
খাদ্যদানের বিনিময়ে রোযা রাখায় ছাড় দেয়া হয়েছিল। আল্লাহতায়ালার এতো বড় ইবাদতের
বিনিময় রাখা হয়েছে দরিদ্রদের খাদ্যদান। পরবর্তীতে এই ছাড় রহিত করে শারীরিক দিক
দিয়ে সক্ষম ও মুকিম সবার প্রতি রোযা ফরজ করা হয়েছে। তবে চিররুগ্ন যার আরোগ্য লাভের
সম্ভাবনা নেই বা যে অতি বৃদ্ধ তার পক্ষে ছাড় এখনো রয়েছে এবং সেক্ষেত্রে এক রোযার
বিনিময় একজন দরিদ্রকে খাদ্যদান। এ থেকে সহজেই খাদ্যদানের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
রমযান মাসের ফজিলত ও
মর্তবা সম্পর্কে এতো বলা হয়েছে যে, তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহাবায়ে কেরাম পাগলপ্রাণ
হয়ে দান-খয়রাত ও ইবাদত-বন্দেগী করতেন। রমযান মাসে যে কোনো আমলের প্রতিদান অন্য
সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেড়ে যায়। রসুল (সা) ধনী-দরিদ্র সকলকেই খাদ্যদানে উদ্বুদ্ধ
করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা রোযাদারকে ইফতার করাও একটি খেজুর বা এক ঢোক পানি দিয়ে
হলেও। তিনি বলেছেন, ইফতারের বিনিময়ে রোযাদারের রোযার সমপরিমাণ ছওয়াব পাওয়া যাবে,
অথচ রোযাদারের ছওয়াবের কোনো ঘাটতি হবে না। তিনি আবার বলেছেন, এক টুকরো খেজুর দিয়ে
হলেও তোমরা মানুষকে খানা খাওয়াও এবং নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।
আল্লাহ ও তাঁর রসুল
(সা) দান-সাদাকা করার জন্য নানাভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সূরা মুদ্দাস্সিরে
উল্লেখ রয়েছে, জাহান্নামীদের জিজ্ঞেস করা হবে, ‘কোন্ জিনিস তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে আসলো? তারা জবাবে বলবে, আমরা
নামাযীদের মধ্যে শামিল ছিলাম না ও মিসকিনদের খাবার দিতাম না’। রসুল (সা) বলেছেন, ‘ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয় যে পেটপুরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে’। সূরা মাউনে আল্লাহপাক বলেছেন, পরকালে
অবিশ্বাসী সেই, যে ইয়াতিমকে ধাক্কা দেয় ও মিসকিনকে খাবার দিতে উৎসাহিত করে না।
কুরআন ও হাদিসে দানের ক্ষেত্রে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে।
এবারে রমযানের রোযা
পালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী করোনার এক ভয়াবহ বিপর্যয়কালে। লকডাউনের কারণে বিপুল
পরিমাণ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। কর্মহীন মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য
সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রত্যেকেরই উচিত তার নিকটবর্তী
আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশির প্রতি খেয়াল রাখা। শুধু যাকাত নয়, হাদিসের বর্ণনা
মতে যাকাত ছাড়া সম্পদের আরো দেয়ার আছে। জাতীয় দুর্যোগকালে সবারই উদার হস্তে এগিয়ে
আসা দরকার। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাকের বাণী উল্লেখ করতে হয়, ‘লোকেরা জিজ্ঞেস করে কী খরচ করবো? বলে দাও, যা
প্রয়োজনের অতিরিক্ত’।
আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘তোমরা
আল্লাহর পথে খরচ করো, নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংস করো না’।
আল্লাহর অসহায়
বান্দাদের মাঝে খরচের মধ্যেই রয়েছে জীবন। অর্থনীতিবিদরাও তাই মনে করেন, দরিদ্র
জনগোষ্ঠীর পেছনে যতবেশি ব্যয় করা যাবে অর্থনীতির চাকা তত সচল হবে। বিশ্বব্যাপী
অবশ্য এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হচ্ছে। তাই তো এতো প্রণোদনা। আমেরিকা সুদের হার
শূন্য করে দিয়েছে। আল্লাহপাক দেড় হাজার বছর পূর্বে জানিয়ে দেন, ‘আল্লাহ সূদকে নির্মূল করে দেন এবং দান-সাদাকে
ক্রমবৃদ্ধি দান করেন’।
আখিরাতে তো অবশ্যই, দানকারী তার দানের বিনিময়ে অনেক গুণ বৃদ্ধি হিসাবে ফেরৎ পাবে।
এ দান তো আল্লাহকে দেয়া কর্জ। সাথে সাথে পৃথিবীবাসী পাবে সহানুভূতিশীল, উদার ও
পরস্পরের প্রতি দয়ার্দ এক সমাজ যা মানুষের স্রষ্টা, লালন-পালনকারী, শাসক-বাদশাহ
মহান আল্লাহপাকেরই চাওয়া এবং তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে এমন সমাজ বিনির্মাণই আমাদের
দায়িত্ব। আল্লাহপাক আমাদেরকে এমন সমাজ নির্মাণের কারিগর হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
১৪ রমযান ১৪৪১, ৮ মে ২০২০
Comments
Post a Comment