Skip to main content

কুরআন ও রমযানের সম্পর্ক


রমযানের ফজিলত সম্পর্কে আমরা সবাই অবহিত। এ মাসটিকে বলা হয় রহমত, মাগফিরাত ও নাযাতের মাস। অজস্র ধারায় রহমত বর্ষিত হয় আল্লাহর বান্দাদের প্রতি। এ মাসের একটি ফরজ অন্য সময়ের ৭০টি ফরজের সমান এবং একটি নফল অন্য সময়ের একটি ফরজের সমান। এ মাসে জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। মানুষের চিরশত্রু শয়তানকে এ মাসে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। এ সবই আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা) থেকে জানা। এখন প্রশ্ন জাগে, এ মাসের এতো ফজিলত ও মর্তবার কারণ কী? আল্লাহ নিজেই তার জবাব দিয়েছেন।

রমযান মাস, এ মাসেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হেদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সম্বলিত, যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়। অতএব এখন থেকে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে তার জন্য সম্পূর্ণ মাসটি রোযা রাখা অপরিহার্য। আর যে ব্যক্তি রোগগ্রস্ত হয় বা সফরে থাকে, সে যেন অন্য দিনগুলোয় রোযার সংখ্যা পূর্ণ করে। আল্লাহ তোমাদের প্রতি কোমলতা প্রদর্শন করতে চান, কঠোর হতে চান না। তাই তোমাদেরকে এ পদ্ধতি জানানো হচ্ছে, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূর্ণ করতে পারো এবং আল্লাহ তোমাদের যে হেদায়াত দান করেছেন সেজন্য তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে ও তার স্বীকৃতি দিতে পারো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও-সূরা আল বাকারা ১৮৫।

উপরের আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়েছে, কুরআন রমযান মাসে নাযিল হয়েছে। আমরা আরো জানি কুরআন এ মাসের কদরের রাতে নাযিল হয়েছে, যার কারণে রাতটি হয়েছে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এখন আমরা উপলব্ধি করতে পারছি, করআনের কারণেই একটি রাত ও একটি মাস এতো ফজিলত ও মর্যাদাপূর্ণ হয়েছে। শুধু তাই নয়, কুরআনের সাথে যাদেরই সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তারা শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। যাঁর ওপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে (মুহাম্মদ সা) তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল, যিনি বহন করে এনেছেন তিনি শ্রেষ্ঠ ফেরেশতা (জিবরাইল আ.), যে মাসে অবতীর্ণ (রমযান) সেই মাস সেরা এবং যে রাতে কুরআন অবতীর্ণ সেই রাতও সেরা। শুধু কি তাই? যারা এই কুরআন মুখস্ত করে এবং যারা শিক্ষা দেয় ও করে তারাও শ্রেষ্ঠতম উম্মত।

রমযান মাসে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কথা উল্লেখ করার সাথে সাথে কুরআনের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। আদম (আ)-কে বেহেশত হতে চলে আসার সময় আল্লাহপাক তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, তাঁর পক্ষ থেকে হেদায়াত যাবে এবং যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াতসহ অসংখ্য নবী-রসুল দুনিয়ায় এসেছেন এবং সর্বশেষ রসুল হলেন আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা) ও সর্বশেষ হেদায়াত হলো তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল কুরআন। এই কুরআন মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হেদায়াত (পথ প্রদর্শনা), এর মধ্যে কোনো হেঁয়ালী ও অস্পষ্টতা নেই এবং হক ও বাতিল স্পষ্ট করে উল্লেখ করে। পরিচয় দেয়ার পরই বলা হয়েছে, যারা এ মাস পাবে তাদের ওপর পূর্ণ মাস রোযা পালন অপরিহার্য করা হয়েছে।

কুরআন সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত (পথ প্রদর্শন)। কিন্তু এই কুরআন থেকে হেদায়াত সকলের নসিবে হয় না। কুরআনের শুরুতেই বলা হয়েছে, এটি হেদয়াত মুত্তাকিদের জন্য (সূরা বাকারা ২)। সাথে মুত্তাকিদের কিছু গুণের কথাও বলা হয়েছে। আর রোযা ফরজ প্রসঙ্গে আল্লাহর কথা- যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। কুরআন থেকে হেদায়াত পাওয়া অর্থ, এই কুরআন যে কাজের আদেশ প্রদান করে সেটা করা এবং যা করতে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাকা। আল্লাহর এই বিধান মেনে চলার জন্য যেটি সর্বাগ্যে দরকার তা হলো আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর প্রতি অন্তরে ভয়। নামায দৈনিক পাঁচবার আমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করে দেয়। ফজরে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা (আল্লাহ আকবর) এবং হাই আলাচ্ছালাহ ও হাই আলাল ফালাহ এই আহবানের মধ্য দিয়ে। যোহর, আছর, মাগরিব ও এশার জামাতে আল্লাহর ঘরে হাজিরা দিয়ে প্রতি রাকাতে বুকে হাত বেঁধে বড় বিনয়ের সাথে প্রতিশ্রুতি প্রদান করি আমরা তোমারই গোলামী করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই। আল্লাহকে এই স্মরণের সাথে সাথে তাঁকে ভয় করে চলার জন্য তিনি রমযান মাসব্যাপী রোযা পালন ফরজ করেছেন।

পানাহার বর্জন করে কষ্ট দেয়া আল্লাহর অভিপ্রায় নয়। বান্দার জন্য যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রসুল (সা) সেহরি ও ইফতার করাকে সুন্নাত করেছেন এবং বিলম্বে সেহরি ও তাড়াতাড়ি ইফতারিতে কল্যাণ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। অসুস্থ ও সফরে থাকাবস্থায় পরে রোযা পালনের সুযোগ দানের কথা বলতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের প্রতি কোমলতা প্রদর্শন করতে চান, কঠোর হতে চান না। রমযান মাসে রোযা পালনের লক্ষ্যে আল্লাহপাক তাঁর হালাল খাদ্যখানা তাঁর বান্দাদের ওপর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হারাম করেছেন। অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে কিছু লৌকিকতা ও প্রদর্শনী থাকলেও রোযার সম্পর্ক কেবল আল্লাহর সাথে। রোযাদার আল্লাহরই ভয়ে লোকচক্ষুর অগোচরে কিছু গ্রহণ করে না। কারণ সে জানে আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দীর্ঘ এক মাস এই প্রশিক্ষণের ফলে তার মধ্যে আল্লাহর ভয় এমনভাবে জাগ্রত হয় যাতে তাঁর হারাম সবকিছু থেকে সে বিরত থাকতে পারে। মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টির ক্ষেত্রে রোযা অনন্য, তুলনাহীন। রোযা পালনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মুত্তাকি লোকদের জন্যই কুরআন হেদায়াত এবং ব্যবহারিক জীবনে কুরআন মেনে চলা তাদের পক্ষেই কেবল সম্ভব। এজন্যই রোযাদারের এতো মর্যাদা ও জান্নাতে যাওয়ার সুসংবাদ।

করোনা পরিস্থিতির মধ্যে এবারে রমযান মাস এসেছে। লকডাউনে আমরা সবাই নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করছি। রমযান মাসটাকে কুরআন চর্চার মাস হিসেবে গ্রহণের একটি সুযোগ ছিল। কুরআন সহীহ তেলাওয়াত, মুখস্ত করা এবং অর্থ ব্যাখ্যাসহ বুঝে পড়ার একটি কর্মসূচী সহজেই গ্রহণ করা যেত। যারা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন তাঁরা বড়ই ভাগ্যবান। আরবি ভাষা বুঝেন বলে তারা সহজেই কুরআন পড়ে আল্লাহর অভিপ্রায় বুঝতে পারেন ও তাঁর হুকুম-আহকাম মেনে চলতে পারেন। তাঁরা জাহান্নামের বর্ণনা পড়ে যেমন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন, তেমনি জান্নাতের বর্ণনা পড়ে খুশি হয়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন। কুরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষিত লোকদের উচিত মাতৃভাষায় কুরআন বোঝার জন্য তাফসির পড়া বা ইউটিউবে কুরআনের আলোচনা শোনা। কুরআনকে আল্লাহপাক হেদায়াত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কুরআন থেকে হেদায়াত পেতে হলে অবশ্যই অর্থ ও ব্যাখ্যা মাতৃভাষায় জানতে হবে।

কুরআনের প্রতিটি হরূফে দশটি করে নেকি। এই রমযান মাসে তা সত্তর গুণ বেড়ে যায়। তাই কুরআন তেলাওয়াত বেশি বেশি করা বা শ্রবণ করা এবং বাচ্চাদের মুখস্তকরণের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা দরকার। এখনো রমযানের অর্ধেকেরও বেশি সময় রয়েছে। আমাদেরকে বুঝতে হবে কুরআনের কারণেই রমযানের এতো মর্যাদা, কুরআনকে জানা ও মানাটাকেই আমাদের অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। বাজারে প্রচুর তাফসির গ্রন্থ রয়েছে। যে কোনো একটি সংগ্রহ করে নেয়া যায় বা এন্ডরয়েড ফোনে ডাউনলোড করে পড়া যায়। কুরআনের অনুসারীরা কুরআনের প্রতি বড় অবিচার করে থাকে। দুনিয়ার সব গ্রন্থ বা নির্দেশনা মানুষ পড়ে জানা ও মানার জন্য। কিন্তু কুরআনের কাছে আসলে মানুষের সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায়। মানুষ শুধু পড়ার জন্যই পড়ে। তাই কুরআন নাযিলের মাস রমযানুল মুবারকে আল্লাহর বিধান জানা ও মানার আগ্রহ নিয়ে কুরআন চর্চা হোক বাকি কটা দিন। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর কুরআন জানা ও মানার তাওফিক দান করুন। আমিন।


Comments