ঈদ অর্থ আনন্দ উৎসব, আবার ঈদ অর্থ যা বারবার ফিরে আসে। ফিতর শব্দের অর্থ ভেঙ্গে দেয়া। রোযা ভাঙ্গাকে ইফতার বলা হয়। ঈদুল ফিতর অর্থ হলো রোযা ভাঙ্গার আনন্দ। দীর্ঘ এক মাস রোযা পালনের মধ্য দিয়ে মু’মিন জীবনে আসে ঈদের আনন্দ। এ যেন গুনাহ মাফের আনন্দ। পরিশুদ্ধির আনন্দ। আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ঈদের দিন আল্লাহপাক রোযাদার সম্পর্কে ফেরেশতাদের কাছে আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, যে গোলাম মনিবের হুকুম পালন তার ব্যাপারে মনিবের দায়িত্ব কী? ফেরেশতারা বলেন, গোলামকে পুরস্কৃত করা। আল্লাহ বলেন, আমি তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করছি’-বায়হাকি। অন্য হাদিসে এসেছে রোযাদাররা ঈদের নামায থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই ঘরে ফিরেন। রোযাদার সম্পর্কে হাদিসে অনেক শুভ সংবাদ রয়েছে। তার সকল গুনাহ মাফ, রাইয়ান দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ, রোযাদারের পুরস্কার আল্লাহ নিজ হাতে প্রদান করবেন ইত্যাদি। সাফল্যের সাথে রোযা পালনের ফলে ঈদের দিন রোযাদারের মধ্যে আলাদা এক আনন্দ বিরাজ করে।
হিজরত করে মদীনায় আসার পর রসুলুল্লাহ (সা) মদীনাবাসীদের মাঝে দু’টি উৎসব লক্ষ্য করেন। উৎসব বলতে প্রচলিত অর্থে খেলাধুলা, গান-বাজনা, রঙ-তামাশা ইত্যাদি যা বোঝায়। তিনি জানান, আমাদেরও দু’টি উৎসব রয়েছে। তার একটি ঈদুল ফিতর ও অপরটি ঈদুল আযহা। দীর্ঘ এক মাস রোযা পালনের পর রোযা ভাঙ্গার আনন্দ ঈদুল ফিতর এবং অন্যটি মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ)-এর চরম আত্মত্যাগের স্মরণ ঈদুল আযহা (কুরবানির ঈদ)। একজন মুসলিম তার জীবনে হাসি-কান্না, ব্যাথা-বেদনা, আনন্দ-উচ্ছাস সকল ক্ষেত্রে কখনো আল্লাহকে বিস্মৃত হন না। আমাদের জীবনে দু’টি উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার মূল আনুষ্ঠানিকতা ঈদের নামায। আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা আমাদের মৌলিক আকিদা। মহান আল্লাহপাক আমাদের যে হেদায়াত দান করেছেন তার শুকরিয়া জ্ঞাপন ও তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার লক্ষ্যেই আমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে রমযানের রোযা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদেরকে এ পদ্ধতি জানানো হচ্ছে, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূর্ণ করতে পারো এবং আল্লাহ তোমাদের যে হেদায়াত দান করেছেন সেজন্য তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে ও তার স্বীকৃতি দিতে পারো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও’- সূরা আল বাকারা ১৮৬।
যে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী বা জাতির উৎসব মানেই হলো অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা যা ইসলামে সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য। কিন্তু আমাদের ঈদ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তারপর, ঈদ মানেই খুশি। শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র সবার মাঝে বয়ে যায় আনন্দের শিহরণ। চলে নতুন জামা-কাপড় ক্রয় ও বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি, যে যেখানেই থাকে, প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাওয়ার লক্ষ্যে হাজারো কষ্ট সত্ত্বেও ছুটে বাড়ির পানে। বাড়িতে সবাইকে নিয়ে ঈদ পালন না হলে আমাদের ঈদ পূর্ণতা পায় না। ঈদ আনন্দে সবাইকে শরীক করার জন্য সচ্ছল মানুষগুলো যাকাত প্রদানসহ উদার হস্তে ব্যয় করে। সর্বোপরি নিজেদের রোযার ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীকরণ ও দরিদ্রদের ঈদ আনন্দে শরীক করার লক্ষ্যে ঈদের নামাযের পূর্বেই বাধ্যতামূলক ফিতরা প্রদান করে থাকে। এ সবই আমাদের ঈদের অনুষঙ্গ।
ঈদের দিন সকাল সকাল শুরু হয়ে যায় ঈদগাহে যাওয়ার ব্যাপক প্রস্তুতি। গোসল শেষে সুগন্ধি মেখে নতুন জামা-কাপড় পরিধান করে সুসজ্জিতভাবে ঈদুল ফিতরের দিন মিষ্টিমুখ করে বাড়ির সবাইকে নিয়ে তাকবির পড়তে পড়তে (আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ও লিল্লাহিল হামদ) ঈদগাহে রওনা হয় এবং ঈদগাহে পৌঁছে তাকবির পাঠ সমাপ্ত করে। এই ঈদে ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ সবার অংশগ্রহণে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব যেন নতুন প্রাণ পায়। ঈদের নামায বারো বা ছয় তাকবিরে পড়া হয়। আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণাই যেন বড় কথা।
প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী ও জাতিগোষ্ঠীর উৎসব পালিত হয় তাদের ধর্মগুরু বা জাতীয় নেতাকে কেন্দ্র করে। যেমন, খ্রীষ্টানদের বড়দিন পালিত হয় যীশু (ইসা আ) খ্রীষ্টের জন্মদিন, বুদ্ধপূর্ণিমা পালিত হয় গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন এবং শ্রীকৃষ্ণের জন্ম উপলক্ষে পালিত হয় জন্মাষ্টমী। কিন্তু আমাদের দু’টি উৎসব কোনোভাবে প্রিয়তম নবী (সা)-কে কেন্দ্র করে নয়। না তাঁর জন্মদিন, না হিজরত বা তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো দিন। ইসলামে ব্যক্তিপূজা বা সৃষ্টিপূজার কোনো সুযোগ নেই। শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব, মহানত্ব সবই আল্লাহর। ঈদের মাঠে বারবার তাকবির পাঠ এবং দু’রাকাত নামাযের মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা ও তাঁর প্রতি চরম আনুগত্য প্রকাশ করে।
ইসলামে সাম্য-ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখা এবং সকল ধরনের শ্রেণিভেদ ও বৈষম্যের মূলোৎপাটন শুধু বক্তৃতা-বিবৃতির মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, তা বাস্তবে প্রদর্শিত হয় নামাযের কাতারে। এখানে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, চাকর-মনিব সবাই সমান। কাঁধে কাঁধ মিলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সবাই মহান আল্লাহরই শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে। মানবিক দুর্বলতার কারণে কোনো সময়ে যদি মনোমালিন্য ঘটে, ঈদের মাঠে এসে পরস্পর কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে তা সব ভুলে যায়। এ এক অপূর্ব ভ্রাতৃত্ব। দু’রাকাত নামায শেষে ইমামের খুতবা শ্রবণের মাধ্যমে মুসল্লিদের মাঝে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতা নতুন রূপ লাভ করে। ভুলে যায় সকল তিক্ততা ও হিংসা-বিদ্বেষ।
বিনোদন জীবনেরই অংশ। ফিতরাতের ধর্ম ইসলাম বিনোদনকে স্বীকার করে। ঈদের দিন হাস্যরস, কৌতুক, নির্মল সংগীতচর্চা, খেলাধুলার মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের আনন্দদান রসুল (সা) সমর্থিত। আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, ঈদের দিন রসুল (সা)-এর পেছনে দাঁড়িয়ে হাবশীদের খেলাধুলা তিনি উপভোগ করতেন (আহমদ, বুখারি ও মুসলিম)। অপর এক বর্ণনায় আয়েশা (রা) বলেন, আবু বকর (রা) আমাদের বাড়িতে এলেন। আমাদের কাছে তখন দুটো দাসী ছিল। তারা গানের মাধ্যমে বুয়াস যুদ্ধের ঘটনাবলির স্মৃতিচারণ করছিল। সে যুদ্ধে আওস ও খাযরাজের বড় বড় সরদার ও বীরযোদ্ধা নিহত হয়। আবু বকর (রা) আমাকে ধমক দিলেন। তিনি বললেন, রসুল (সা)-এর কাছে শয়তানের গান চলছে। তখন রসুল (সা) আবু বকরের (রা) দিকে মনোযোগী হলেন এবং বললেন, দাসী দু’টি যা গাইছে গাইতে দাও’-বুখারি। হাফেজ ইবনে হাজার ফতহুল বারীতে বলেন : আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন। রসুল (সা) সেদিন বললেন, মদিনার ইহুদীদের জানা উচিৎ, আমাদের ধর্মে প্রশস্ততা রয়েছে। আমাকে উদার তাওহীদী আদর্শ দিয়ে পাঠানো হয়েছে।’
এবার এক ভিন্ন পরিবেশে পবিত্র রমযান ও ঈদ উদযাপিত হচ্ছে। করোনা ভাইরাসে সমগ্র বিশ্ব পর্যদুস্ত। ইতোমধ্যে তিন লক্ষাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছে এবং এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। মানুষ যখন জুলুম-নির্যাতন ও অশ্লীলতার চরম সীমালঙ্ঘন করে তখন আল্লাহপাক বালা-মুসিবত দিয়ে তাঁর বান্দাদের সতর্ক করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষ্ময়কর উন্নতির এই যুগে অতি ক্ষুদ্র এক জীবাণুর আক্রমণে পৃথিবীর সকল পরাশক্তি ধরাশায়ী হয়ে পড়েছে। গোটা বিশ্ব এখন স্থবির ও লকডাউনের কবলে। প্রাণখুলে মসজিদে নামায না পড়ার এক বেদনার সাথে যোগ হয়েছে ঈদগাহে না যাওয়ার কষ্ট। মসজিদে তারাবিহ আদায় না করার কষ্ট ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো অনেকখানি পুষিয়ে নিয়েছে ঘরে পরিবারের সাথে জামাতে ফরজ সালাতসহ তারাবিহ আদায় এবং তাহাজ্জুদ নামায, কুরআন অধ্যয়ন ও পরিবারের সাথে সময়দানের মাধ্যমে। এ ছাড়া বিপদকালে ঈমানদাররা তাওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহপাকের অধিক নৈকট্য লাভ করে।
করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা ব্যাহত হচ্ছে; ঈদের বড় আকর্ষণ ঘরে ফেরা এবারে সম্ভব হবে না এবং করোনার বিস্তার রোধ বিবেচনা করে উচিতও হবে না। এছাড়া শপিং মল ও বাজারে চলাফেরায় নানা বিধি-নিষেধ রয়েছে। ঈদে কেনাকাটা তেমন জমবে না, যদিও প্রতি বছর আমাদের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করে এই ঈদ। বিপুল পরিমাণ বেচা-কেনার কারণে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয় ও দেশ সমৃদ্ধ হয়। নিজেদের কেনাকাটা না করে বা কম করে আমরা লকডাইনের কারণে কর্মহীন লোকের পাশে দাঁড়াতে পারি। গরীব ও বেকার মানুষকে সহযোগিতার মাধ্যমে ভেঙ্গেপড়া অর্থনীতির কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে বালা-মুসিবত যা তা সবই আমাদের হাতের কামাই। হয়তো অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-নির্যাতন এবং অশ্লীলতার সাথে আমরা প্রত্যক্ষ জড়িত নই, কিন্তু এর কারণে আমাদের মাঝে যে পরিমাণ পেরেশানি থাকার দরকার ছিল ও প্রতিরোধে যে পরিমাণ উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন ছিল তা না থাকার কারণে ভালো-মন্দ সবার উপরে সমভাবে বালা-মুসিবত নেমে আসে। আজ আমরা খোদায়ী আযাবেরই মুখোমুখি।
এখন চলছে রমযানের শেষ অধ্যায় এবং এ অধ্যায়েই রয়েছে মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর। এর পরপরই খুশির বার্তা নিয়ে আসবে ঈদুল ফিতর। এখন প্রয়োজন করোনার মত মুসিবত থেকে রক্ষা পেতে সামষ্টিকভাবে তাওবা ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আর প্রয়োজন বেশি বেশি সদকা করা। সদকা আল্লাহর ক্রোধকে প্রশমিত করে। আল্লাহপাক আমাদেরকে করোনার মত মুছিবত থেকে হেফাজত করুন।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment