Skip to main content

রোযা ও আত্মসংযম




মানুষের জীবনের চাহিদাকে ইসলাম অস্বীকার করেনি। বৈধতার আবরণে তাকে একটি সীমারেখা দান করেছে। ক্ষুধা পেলে সে খাদ্য চায়, পরিশ্রান্ত হলে বিশ্রাম চায় আবার একটি নির্দিষ্ট বয়সে উপনীত হলে তার জৈবিক চাহিদার উদ্রেগ হয়। ইসলাম সবই মেনে নেয়। উদরপূর্তি বা যৌন চাহিদা মেটানোই তার জীবনের লক্ষ্য নয়। তাকে দেখতে হয় এই চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে তার নিজের বা সমাজের কারো কোনো ক্ষতির বিষয়টি। নিজ বা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন সকল কর্মকান্ড ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। তাই উপার্জন এবং খাদ্য-খানা ও যৌন চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান মেনে চলাটা ইসলাম ফরজ করে দিয়েছে।
সৎ মানুষ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলাম সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করে বিশ্বাস আনয়নের প্রতি। মানুষের মাঝে সততা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস (জবাবদিহিতা) অনন্য ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি কাজের জবাবদিহি করতে হবে এই বোধ-উপলব্ধি স্বতস্ফুর্তভাবে মানুষকে পাপাচার থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ ও আখিরাতের ভয়রিক্ত সততা একটি পলিসি মাত্র যা ইউরোপ-আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী প্রদর্শন করে। একটি মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য থাকে তাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা বা নিজের দেশে ন্যায়-ইনসাফ-সামাজিক সুবিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের কোনো জুড়ি নেই। আবার আনবিক বোমা মেরে মুহূর্তেই লক্ষ লক্ষ মানুষকে ধ্বংস করতে তারা বিবেকে কোনো পীড়া অনুভব করে না। এ সবই পরকালে ভয়হীন সেকুলার চিন্তা-চেতনার ফসল। এরা নিজের দেশে গণতন্ত্র চর্চা করলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসকের মদদদাতা।
মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় ও জবাবদিহিতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইসলামের কিছু কর্মপন্থা রয়েছে। তার মধ্যে রোযা অন্যতম। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকার নাম রোযা। শাস্তিদান আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। মানুষের কষ্ট লাঘব করার লক্ষ্যে সেহরি খাওয়া ও ইফতার করা সুন্নাত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে বিলম্বে সেহরি খাওয়া ও তাড়াতাড়ি ইফতার করার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। আবার সূর্যাস্ত থেকে ফজরের উদয় পর্যন্ত পানাহারে কোনো বাধা নেই। এখানে আল্লাহ প্রদত্ত হালাল জিনিষ তাঁর বান্দাদের জন্য সাময়িক নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সেটি দীর্ঘ মাসব্যাপী। রোযা সম্পূর্ণ লৌকিকতা ও প্রদর্শনী থেকে মুক্ত। আল্লাহ ও রোযাদার ছাড়া রোযা পালনের খবর আর কেউ রাখে না। কেবল আল্লাহরই ভয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে রোযাদার কিছু গ্রহণ করে না। মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় সৃষ্টির ক্ষেত্রে রোযা অনন্য, এর কোনো তুলনা নেই।
প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে একটি স্বাধীন সত্ত্বা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের এই স্বাধীনতা ভোগ-ব্যবহারের জন্য আল্লাহপাক একটি সীমারেখা দান করেছেন। হারাম (নিষিদ্ধ) অত্যন্ত সীমিত, গোটা দুনিয়া তার জন্য হালাল। মানুষ যাতে স্বতস্ফুর্তভাবে আল্লাহর আইন পালন করতে পারে সে লক্ষ্যে মানুষকে তৈরী করার জন্যই এই রোযা। রোযা প্রসঙ্গে আল্লাহর বক্তব্য হলো, তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্যেই তোমাদের প্রতি রোযা ফরজ করা হয়েছে। মানুষের চাহিদাকে ধ্বংসসাধন নয় বরং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সঠিকভাবে পরিচালনাই হলো রোযা পালনের লক্ষ্য। মানুষ নফসের দাস হবে না। সে তার নফসের নিয়ন্ত্রণ করে তাকে কল্যাণের পথে পরিচালনা করবে। রোযাদারের সম্মুখে সবকিছু মজুদ রয়েছে, কিন্তু আল্লাহর নিষেধাজ্ঞার কারণে সে কোনো কিছু স্পর্শ করে না। ইফতার করার পরে তার শরীরে আসে ক্লান্তি, তার নফস দাবী করে বিশ্রাম কিন্তু রোযাদার তা উপেক্ষা করে দীর্ঘ নামাযে দন্ডায়মান হয়। আবার গভীর ঘুমে সে রাতটিকে অতিবাহিত করে না, শেষ রাতে সে জেগে ওঠে এবং জায়নামাযে দাঁড়িয়ে তার সব প্রয়োজন রবের কাছে পেশ করে। সেহরি খেয়ে ফজরের নামায আদায় করে মন চাইলে একটু বিশ্রাম নিয়ে শুরু হয় তার কর্মচঞ্চল জীবন। ঘুমিয়ে কাটানোর জন্য কবরে তার অফুরন্ত সময়। দুনিয়াটা মূলত তার কর্মক্ষেত্র। মৃত্যুর সাথে সাথে তার কাজ করার সকল ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। এভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদী কোর্স হিসেবে রোযা মানুষের মধ্যে নিয়ে আসে সংযম যা বাকি এগারোটি মাস চলার ক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করে।
আল্লাহর গোলামী করার উদ্দেশ্যেই মানবজাতির সৃষ্টি এবং তাঁর বিধান পালনের মধ্যেই রয়েছে তার কল্যাণ। সার্বক্ষণিক গোলামী করার প্রস্তুতিস্বরূপ কিছু মৌলিক ইবাদত (নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত) মানুষের প্রতি ফরজ করা হয়েছে। এ সব ইবাদত তাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিবে। উদ্দেশ্যবিবর্জিত এ সব ইবাদত মূল্যহীন। তখন আর নামায তাকে অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে ফিরিয়ে রাখে না এবং রোযাও আর তার মাঝে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে না ও সকল কাজে সংযম অবলম্বনও সম্ভব হয়ে উঠে না। এমন রোযাদার সম্পর্কেই রসুল (সা) বলেছেন, ক্ষুধা ও পিপাসায় কষ্ট পাওয়া ছাড়া তার ভাগ্যে আর কিছুই জোটে না।

Comments