বিনোদন বলতে এমন কর্মকান্ড বোঝায় যা মানুষকে আনন্দ দেয়, অবসাদ দূর করে এবং সাময়িক হলেও উৎফুল্ল করে। কুরআন তেলাওয়াত, ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব, খেলাধুলা, ভ্রমণ, সংগীত, কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা, কৌতুক যা মানুষকে আনন্দ ও হাস্যরসের খোরাক যোগায় এমন সব কার্যক্রমকে আমরা বিনোদন বলতে পারি। মানুষের বয়স, রুচিবোধ, চিন্তা-চেতনা, পরিবেশ নানা বিষয় বিনোদনকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে। সুমধুর আযান শুনে আমাদের এক কবি গেয়ে উঠলেন, ‘কে ঐ শোনালো মোরে আযানের ধ্বনি, মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিলো কী সুমধুর’; আবার আর এক কবি বললেন, এ যেন বেশ্যাদের খদ্দের ডাকা আহবান (নাউজুবিল্লাহ)। একই আযানে কেউ আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছেন আবার কেউ বিরক্ত হচ্ছেন। বিনোদন মানুষের বিশ্বাস দ্বারা অনেকখানি প্রভাবিত।
আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ কিতাব আল কুরআন তার সাহিত্যিক মান ও ছন্দে অতুলনীয়। আল্লাহর রসুল (সা)-এর মুখনিঃসৃত তেলাওয়াত শুনে মানুষ আত্মহারা হয়ে পড়তো এবং অগণিত মানুষ তা মুখস্ত করে ফেলতো। এমন কী ইসলামের দুশমনরা গোপনে রসুলুল্লাহ (সা)-এর তেলাওয়াত শুনতো। সে সময় থেকে কুরআনের প্রতি আকর্ষণের কারণে অজস্র মানুষ কুরআন মুখস্ত করেছে এবং সেটি অব্যাহত আছে। বিশেষ বিশেষ ওয়ায়েজিন ও ক্কারীর তেলাওয়াত শোনার জন্য মানুষ পাগলপ্রাণ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া অনেকের বক্তৃতা ও ওয়াজে রয়েছে অদ্ভূত যাদু। আল্লামা সাঈদীর ওয়াজ এবং সাম্প্রতিক মিজানুর রহমান আজহারীর ওয়াজ যুব সমাজের মাঝে ঝড় তুলেছে। শিক্ষার সাথে সাথে আমি বলবো এর মাঝে রয়েছে আনন্দ ও তৃপ্তি অর্থাৎ এ সব ওয়াজও বিনোদনের অংশ।
সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিনোদন বলতে খেলাধুলা, গান-বাজনা, সিনেমা, নাটক, নারী-পুরুষের একত্রে আড্ডা, ছবি তোলা, ভ্রমণ, বাগান করা, মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালনা, লটারি, জুয়া, নেশা -এক কথায় বলা যায় যা মানুষকে আনন্দ যোগায়। আজকের বিবেচ্য বিষয় বিনোদনের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী? ইসলাম আল্লাহপাক প্রদত্ত এক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মানুষের জীবনের ব্যাপকতা যতখানি ইসলাম ঠিক ততখানি বিস্তৃত। ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি যা দাবী করে ইসলাম তা অস্বীকার করেনি। ইসলাম বৈধ-অবৈধতার একটি সীমারেখা দান করেছে মাত্র। মানুষের মন যা চায় তাই কি সে করতে পারে? পারে না, তাকে রাষ্ট্রীয় নানা আইন-কানুন মেনে চলতে হয়। অর্থাৎ তার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণাধীন। নিয়ন্ত্রণাধীন বলেই একজন ব্যক্তি তার স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের জন্য হারাম খুবই সীমিত ও সুস্পষ্ট এবং গোটা দুনিয়া তার জন্য হালাল। যেমন, খাবারের বিষয়ে আল কুরআনে বলা হয়েছে- শুকরের মাংস, প্রবাহিত রক্ত, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যবেহ (তৎসঙ্গে রসুলুল্লাহ (সা) বর্ণিত কিছু হিংস্র প্রাণী ও নখরধারী পাখির কথা) উল্লেখ করে বলা হয়েছে সকল পাক জিনিসই তোমাদের জন্য হালাল। হালাল খাবারের ব্যাপারে স্বল্প কিছুর বাইরে মানুষের রুচি-পছন্দের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। পরিধানের ব্যাপারে সতর আবৃত করা ফরজ করা হয়েছে এবং পুরুষের জন্য সোনা-রূপা, রেশমী পোশাক ও গর্ব-অহংকার প্রকাশক পোশাক হারাম করা হয়েছে। তাকওয়ার পোশাককে উত্তম বলা হয়েছে। অন্য ধর্মাবলম্বী ও জাতিগোষ্ঠীর সাদৃশ্য হয় এমন পোশাক পরিহার করার জন্য বলা হয়েছে। অবশ্য অপচয় এড়িয়ে চলতে হবে। এর বাইরে পরিধানের ব্যাপারে ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। আমাদের আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে। আমরা বিনোদনের সাথে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
বিনোদনের ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্পষ্ট। যার মধ্যে অশ্লীলতা ও অকল্যাণ রয়েছে এমন সবই হারাম। শ্লীল ও কল্যাণকর সবই বৈধ। অর্থাৎ যে গান, কবিতা, নাটক, সিনেমা, গল্প, উপন্যাস শিরক এবং নির্লজ্জতা-বেহায়াপনা ও অশ্লীলতায় পূর্ণ যা মানুষের মাঝে যৌন সুড়সুড়ি যোগায় ও পরকীয়া-যিনা-ব্যাভিচারে প্রলুব্ধ করে, সাথে মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণা সৃষ্টি করে জাতিগত বা গোষ্ঠীগত মারামারি-হানাহানিতে উস্কানি দেয় তা সবই হারাম। পক্ষান্তরে সাংস্কৃতিক সকল ধরনের কার্যক্রম যা মানুষের মধ্যে আল্লাহপ্রেম, রসুল (সা)-এর প্রতি ভালোবাসা, মানবপ্রেম, দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে তা সবই বৈধ ও প্রশংসনীয়।
মানুষের জীবনে বিভিন্ন উৎসব মূলত বিনোদনেরই অংশ। প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর মধ্যেই উৎসব রয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় জীবনেও নানা উৎসব আছে। আমাদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের পরিপন্থি না হলে দেশীয় উৎসবে ইসলামে কোনো আপত্তি নেই। আমাদের দু’টি ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা মহা আড়ম্বরের সাথে পালিত হয়। এখানে যেমন নামায আছে, উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান ও উত্তম খাদ্যগ্রহণ, পরস্পর কুশলাদি বিনিময়, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানোর পাশাপাশি হাস্যরস, কৌতুক, নির্মল সংগীতচর্চা, খেলাধুলার মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের আনন্দদানও রয়েছে এবং তা সবই সুন্নাহ সমর্থিত।
আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, ঈদের দিন রসুল (সা)-এর পেছনে দাঁড়িয়ে হাবশীদের খেলাধুলা তিনি উপভোগ করতেন (আহমদ, বুখারি ও মুসলিম)। অপর এক বর্ণনায় আয়েশা (রা) বলেন, আবু বকর (রা) আমাদের বাড়িতে এলেন। আমাদের কাছে তখন দুটো দাসী ছিল। তারা গানের মাধ্যমে বুয়াস যুদ্ধের ঘটনাবলির স্মৃতিচারণ করছিল। সে যুদ্ধে আওস ও খাযরাজের বড় বড় সরদার ও বীরযোদ্ধা নিহত হয়। আবু বকর (রা) আমাকে ধমক দিলেন। তিনি বললেন, রসুল (সা)-এর কাছে শয়তানের গান চলছে। তখন রসুল (সা) আবু বকরের (রা) দিকে মনোযোগী হলেন এবং বললেন, দাসী দু’টি যা গাইছে গাইতে দাও’-বুখারি। হাফেজ ইবনে হাজার ফতহুল বারীতে বলেন : আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন। রসুল (সা) সেদিন বললেন, মদিনার ইহুদীদের জানা উচিৎ, আমাদের ধর্মে প্রশস্ততা রয়েছে। আমাকে উদার তাওহীদী আদর্শ দিয়ে পাঠানো হয়েছে।’
রসুলুল্লাহ (সা)-এর এই উক্তি (মদিনার ইহুদীদের জানা উচিৎ, আমাদের ধর্মে প্রশস্ততা রয়েছে। আমাকে উদার তাওহীদী আদর্শ দিয়ে পাঠানো হয়েছে) আমাদের দ্বীনকে অনেক সহজ করেছে। ইসলাম কোনো একটি বিশেষ সময় ও গোষ্ঠীর জন্য নয়, কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবগোষ্ঠীর জন্য। সবাই যাতে এই দ্বীন মানতে পারে অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্য করতে পারে সে সুযোগ এখানে রয়েছে। শরীর গঠন ও মানুষকে নির্মল আনন্দ দানের জন্য জুয়া ও অশ্লীলতা বিবর্জিত সব ধরনের খেলাধুলা ইসলামে বৈধ। মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন্য সংগীত, কবিতা পাঠ, গল্প, উপন্যাস, রৌম্যরচনা অশ্লীলতাবর্জিত ও দ্বীনের সীমারেখার মধ্যে হলে ইসলামে কখনই আপত্তি করা হয়নি বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে নৈতিকতার বিপরিত হলে ইসলাম তা অনুমোদন করে না। যেমন আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে। কোনো কবিতা, গল্প, উপন্যাসের মধ্যে মানুষের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ালে নিঃসন্দেহে সেটি গুনাহের কাজ।
ইসলামের দৃষ্টিতে বিনোদনের বড় ক্ষেত্র হলো আপন গৃহ। ইসলাম চায়, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি দৃষ্টিদানের সাথে সাথে তাদের মধ্যে নেমে আসবে প্রশান্তি এবং সন্তান-সন্ততি হবে তাদের খেলা ও আনন্দের সামগ্রী। এমন অনুভূতি প্রকৃতিগত এবং সেটিই ইসলাম। প্রকৃতিগত হওয়ার পরও ইসলাম উভয়ের মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিয়েই আমাদের জীবন এবং পরস্পর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনে স্বস্তি ও আনন্দ খুঁজে পেতে পারি। নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ প্রকৃতিজাত। পরস্পর মেলামেশার মধ্যে ইসলাম একটি সীমারেখা দাঁড় করিয়েছে এবং একে অপর থেকে প্রশান্তি লাভের লক্ষ্যে বিয়েকে উৎসাহিত করেছে।
আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন অনেকাংশ নারীকে কেন্দ্র করে। ইসলাম নারী ও পুরুষকে পৃথক করে দেখেনি। ইসলামের দৃষ্টিতে ‘ঈমানদার নর ও নারী পরস্পরের বন্ধু ও সাথী, তারা ভালো কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজে নিষেধ করে’। উভয়ের সম্পর্ক বন্ধুত্বের ও ভালোবাসার। নারীকে মা, স্ত্রী, মেয়ে হিসেবে অসামান্য মর্যাদা দান করা হয়েছে। এমনটি আমাদের গল্প, উপন্যাস, কবিতায় প্রকাশ পেলে কতই না ভালো হত। একজন মুসলিম কবি ও লেখকের কলমের আঁচড়ে সেটিই ফুটে উঠার কথা।
ইসলাম পূর্বযুগে সবচেয়ে নিঃগৃহিত ছিল নারী ও দাস শ্রেণি। ইসলাম তাদেরকে সম্মানের আসনে আসীন করেছে। রসুল (সা)-এর সময়ে একজন নারী যতখানি স্বাধীনতা ভোগ করেছে ততখানি স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার একজন নারী এখনো রাখে। সে সময়ের অর্থনীতি ছিল কৃষি ও ব্যবসা। মা খাদিজা (রা) ছিলেন একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং সে সময়ে নারীরা কৃষিতে স্বামীকে সহায়তা করেছে বা নিজেই খেজুর বাগানের মালিক ছিলেন। তারা মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায, জুমা, ঈদ ও হজ্জে অংশগ্রহণ করেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও তাদের উপস্থিতি ছিল।
একজন নারী বহিরাঙ্গনে কাজ করতে বাধ্য নয়। আসলে তার জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র হলো গৃহ। সন্তান জন্মদান, লালন-পালন, শিক্ষাদান তার মৌলিক দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব পালনের কারণে নারীর প্রতি পুরুষের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। বর্তমান অর্থনীতিক কর্মকান্ড অনেক বিস্তৃত এবং নারীর অংশগ্রহণও ব্যাপক। এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে বিশেষ করে শিক্ষা ও চিকিৎসা জগতে নারীর সেবা খুবই প্রয়োজন। আমরা কোনো বিতর্কে না গিয়েই বলবো নারীর ঘরের বাইরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলেই তো পর্দার বিধান। পর্দা মেনে একজন নারী সকল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে। নামায-রোযা যেমন ফরজ এবং পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য পর্দা মানাটাও ফরজ। পর্দাহীনতা জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
বিনোদনের নামে নারী-পুরুষের বিবাহবহির্ভূত মেলামেশা ইসলাম স্বীকার করে না বরং কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা দিয়েছে। ইসলাম সকল ধরনের আনন্দ-স্ফুর্তি, হাস্যরস স্বীকৃতি দেয় যদি তা অশ্লীলতা মুক্ত ও ইসলামের সীমারেখা মেনে চলে। ইসলাম সহজ ও উদার এক জীবনব্যবস্থা যা সকল শ্রেণি, পেশা, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষাভাষী সবার জন্য উপযোগী এবং সহজভাবে পালনীয়। এখানে কোনো কাঠিন্য রাখা হয়নি। আবার ইসলাম কোনো কাঁচপাত্রও নয় যা সহজেই ভেঙ্গে যায়। তাই কোনো আমলের ক্ষেত্রে মতানৈক্য দেখা দিলে তাৎক্ষণিক তাকে ইসলাম থেকে খারিজ না করে আমাদেরকে বোঝার চেষ্টা করা দরকার। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর বিধান সহজভাবে মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
২৯ রমযান ১৪৪১, ২৩ মে ২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment