দুর্নীতি সমাজের
রন্ধ্রে রন্ধ্রে। একজন গরীব দুধবিক্রেতা সুযোগ পেলেই তার দুধে পানি মেশাচ্ছে,
মাছবিক্রেতা পচা মাছটি ভালো মাছ বলে বিক্রি করছে বা ওজনে কম দিচ্ছে, ফলবিক্রেতা
ফরমালিন মেশাচ্ছে বা ক্রেতার অজ্ঞাতসারে পচা ফলটা দিয়ে দিচ্ছে। আর বড় বড়
রাঘব-বোয়ালদের চুরি তো রয়েছেই। সেটি পুকুর চুরি নয়, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর ভাষায়
সাগর চুরি। রাজনীতিক, সরকারি আমলা, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক কেউ
দুর্নীতির উর্ধে নয়। রমযান মাস ও করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও ত্রাণ চুরির অভিযোগে
অনেক জনপ্রতিনিধিকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অথচ আমরা শুনি, বিশ্বের সবচেয়ে ধর্মভীরু
দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এটি কি তারই প্রমাণ বহন করে? এদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ
মুসলমান। পবিত্র রমযান মাসে হাতে গোনা ২/১ জন বাদে সবাই রোযা রাখে। করোনার এই
লকডাউনে মসজিদ খুলে দেয়ার আকুতিও কম নয়। তাহলে আমাদের নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত কি
কোনোই মূল্য বহন করে না।
আল্লাহপাক আমাদেরকে
সৃষ্টি করেছেন তাঁরই গোলামী করার জন্য এবং এই গোলামী করার ক্ষেত্রে তাঁর সাথে
কাউকে শরীক করা যাবে না। তাঁর দাবী, ‘আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো’-সূরা নহল ৩৬। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত
থেকে সূর্যোদয় সার্বক্ষণিক আল্লাহর হুকুম পালনই গোলাম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব।
সার্বক্ষণিক দাসত্ব করার উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আল্লাহপাক কয়েকটি
আনুষ্ঠানিক ইবাদতকে দ্বীনের খুঁটি হিসেবে আমাদের ওপর ফরজ করেছেন। তন্মধ্যে নামায
সর্বাগ্যে। আমরা যে আল্লাহর গোলাম নামায বারবার আমাদের তা স্মরণ করে দেয়। দিনের
সূচনা হয় নামায দিয়ে এবং কর্মব্যস্ততার মাঝে তিনবার ও রাতে ঘুমানোর পূর্বে মসজিদে
হাজিরা দিয়ে বুকে হাত বেঁধে প্রতি রাকাতে ওয়াদা করা হয় ‘আমরা তোমারই গোলামী করি ও তোমারই কাছে সাহায্য
চাই’। না’বুদু শব্দটি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় অর্থ প্রকাশ করে। নামাযে
দাঁড়িয়ে বারবার প্রতিশ্রুতি প্রদানের মধ্যে এ ঘোষণাই প্রদান করা হয়, নামায যেমন
ইবাদত এবং নামায থেকে আলাদা হওয়ার পরেও তোমারই ইবাদত (গোলামী বা দাসত্ব) করবো।
গোলামীর কথা বারবার স্মরণ করে দেয়ায় নামাযকে বলা হয় যিকর। আর মুনাফিকের বড়
বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। নামাযের বাইরে আল্লাহর নাফরমানি যারা করে
তারা হয় অস্বীকারকারী, নয় তো মুনাফিক।
মনিবের হুকুম পালনের
জন্য দু’টি জিনিস অপরিহার্য। প্রথমত মনিবের স্মরণ এবং
দ্বিতীয়ত ভয়। আল্লাহ আমাদের মনিব, এ কথা নামায বারবার স্মরণ করে দেয়। পাশাপাশি
রোযা মানুষের মাঝে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে। আল্লাহপাকের হালাল জিনিস তাঁর
নিষেধাজ্ঞার কারণে সাময়িকভাবে রোযাদার ভোগ-ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। ক্ষুধা-পিপাসায়
কাতর হয়ে পড়লেও লোকচক্ষুর অগোচরে সে কিছু স্পর্শ করে না। ইফতার সামগ্রী সম্মুখে
রেখে সে বারবার ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকায়। সময়ের পূর্বে কিছু মুখে দিলে রোযা নষ্ট
হয়ে যাবে, কত সতর্কতা। একদিন দু’দিন
নয়, টানা একটি মাস রোযা পালনের মাধ্যমে সে আল্লাহর হুকুম পালনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
সাময়িক নিষিদ্ধের ফলে একজন রোযাদার পানাহার থেকে বিরত থাকছে এবং এই বিরত থাকার
পেছনে অন্য কোনো শক্তি কাজ করে না, করে কেবল আল্লাহর ভয়। সে জানে, আল্লাহর দৃষ্টির
বাইরে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। কর্ম উপলক্ষে যখন সে যমিনে ছড়িয়ে পড়ে তখনও আল্লাহর
দৃষ্টিসীমার বাইরে নয়, এটিই রোযার মৌলিক শিক্ষা।
আল্লাহর সার্বক্ষণিক
গোলাম-এই উপলব্ধি থেকে সরে আসার পেছনে কারণ হলো পাশ্চাত্যের দর্শন।
ইউরোপ-আমেরিকানদের মত সেও ইসলামকে স্রেফ একটি ধর্ম মনে করে। ইসলামকে জীবনাদর্শ ও
জীবনোদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ না করায় তার এই পরিণতি। সে জানে নামায বেহেশতের চাবি,
রোযা রাখলে সে রাইয়ান দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে, যাকাত তার সম্পদ
পবিত্র করবে, হজ্জ তাকে সদ্যজাত শিশুর মত নিষ্পাপ করবে, কুরবানি তাকে জন্তুর পিঠে
চড়ে পুলসিরাত পার করাবে। তার এই বিশ্বাসে কোনো ভুল নেই। সাথে সাথে এ কথাও তার জানা
থাকা দরকার ছিল সকল ইবাদতের মূলে রয়েছে হালাল রুজি। অবৈধ উপার্জনে গঠিত শরীর কেবল
জাহান্নামেরই উপযুক্ত। তার আরো জানার দরকার মজলুমের পাওনা পরিশোধে জালেমের কোনো
নেক আমল আর অবশিষ্ট থাকবে না এবং মজলুমের পাপের বোঝা গ্রহণ করে সে জাহান্নামে
যাবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে,
ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ ইসলাম ছাড়াই একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে; আমরা কেন পারবো
না? তারা মিথ্যা বলে না, ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয় নেয় না, সেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা
রয়েছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত, মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের গ্যারান্টি রয়েছে, সবই
ঠিক। আমাদের দেশও মূলত তাদের আদর্শেই পরিচালিত এবং নতুন করে কল্যাণ রাষ্ট্রের যে
স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে তাও সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই। ইউরোপ-আমেরিকার যে চিত্র
উল্লেখ করা হয়েছে তার বিপরিতে একটি কদর্য চিত্রও আছে। নিজেদের দেশে গণতন্ত্রের
চর্চা থাকলেও পৃথিবীর দেশে দেশে এরা স্বৈশাসকের পাহারাদার। দেশে মানুষের জান-মালের
নিরাপত্তা বিধান ও স্বাধীনতা নিশ্চিতে তারা খুবই তৎপর। অথচ তারাই আফগানিস্তান,
সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়াসহ দেশে দেশে অগণিত নিরীহ মানুষের নির্মম হত্যাকান্ডের নায়ক।
দু দু’টি বিশ্বযুদ্ধ ও পারমানবিক বোমা মেরে মুহূর্তেই
লক্ষ লক্ষ মানবসন্তান হত্যা করতে তাদের হৃদয় একটুও কাঁপেনি। তাদের সততা স্রেফ
পলিসি (Honesty is the best
policy) এবং তারা মনে করে
বৈষয়িক উন্নতি, সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও সুখ-শান্তির জন্য এতটুকু সততা প্রয়োজন।
পেছনে আল্লাহর ভয় ও আখিরাতে জবাবদিহিতা থাকলে বিশ্বটা ভিন্নতর হতে পারতো।
দুর্ভাগ্য হলো, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সততা নয় দুর্নীতিকেই তাদের বৈষয়িক উন্নতির উপায়
হিসেবে গ্রহণ করেছে।
ইসলাম আল্লাহপ্রদত্ত এক
পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। বৈষয়িক উন্নতির সকল উপাদান এর মধ্যে রয়েছে। দুর্নীতি রোধ করে
একটি সুখি-সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলার মত মটিভিশনমূলক উপাদান ইসলামে ভরপুর। এদেশের
মানুষ ইসলামকে বিশ্বাস করে ও মানে, কিন্তু আংশিক। একটি জীবনাদর্শ হিসেবে জীবনের
সকল ক্ষেত্রে মানার ব্যাপারে তাদের দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের একটি উল্লেখযোগ্য ও
প্রশংসনীয় দিক হলো পরিবার প্রথা, যেটি পাশ্চাত্য হারিয়ে ফেলেছে। নগ্নতা, বেহায়াপনা
ও অশ্লীলতায় তারা সকল সীমা অতিক্রম করেছে। আমরা কুরআন থেকে জানি, অতীতে স্রেফ অশ্লীলতার
কারণে আল্লাহপাক একটি জাতিকে (লুত আ) সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে
সভ্য জাতির দাবীদার খোদ বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীর হবু স্ত্রী অন্তসত্বা ও
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বিবাহবহির্ভূত মা। এসব পাপাচারী জাতি আখিরাতে
বিশ্বাসী কোনো জাতির আদর্শ হতে পারে না। আমাদের আদর্শ প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা) ও
তাঁর হাতে গড়া মদীনারাষ্ট্র। একজন মুসলমান ততক্ষণ মুসলমান যতক্ষণ সে ইসলামে পূর্ণ
আস্থাশীল। ইসলামের বাইরে কোনো কিছু ভাবার সুযোগ আখিরাতে বিশ্বাসী কারো নেই।
আল্লাহর বাণী, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতি অবলম্বন
করতে চায় তার সে পদ্ধতি কখনই গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ব্যর্থ, আশাহত ও
বঞ্চিত’-আলে ইমরান ৮৫।
আমাদের নামায, রোযা,
হজ্জ, যাকাত তখনই অর্থবহ হবে যখন এগুলো আমাদেরকে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ গোলাম হতে
সহায়তা করবে। যখন নামায আমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ, রোযা আল্লাহর ভয়, যাকাত ধন-সম্পদে
আল্লাহ ও তাঁর বান্দার হক এবং হজ্জ মানুষের অন্তরে আল্লাহর প্রেম ও মুহাব্বত
সৃষ্টির মাধ্যমে সর্বদা আল্লাহর হুকুম পালনে প্রেরণা যোগাবে তখন আর মানুষের দ্বারা
কোনো অন্যায়, জুলুম-নির্যাতন ও নির্লজ্জতা সম্ভব হবে না। কিন্তু সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গির
কারণে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে না মেনে একে খন্ড-বিখন্ড করা হয়েছে। এদের
ব্যাপারেই আল্লাহর কঠোর হুঁশিয়ারী। ‘তোমরা কি আল্লাহর কিতাবের একাংশ বিশ্বাস করো এবং আরেক অংশ অবিশ্বাস
করো? কখনো যদি কেউ এ আচরণ করে, তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কী হতে পারে, পার্থিব জীবনে
তাদের লাঞ্ছনা এবং পরকালে তাদের কঠিনতম আযাবের দিকে নিক্ষেপ করা হবে; তোমরা যা
করছো, আল্লাহতায়ালা সেসব কিছু থেকে মোটেও উদাসীন নন। বস্তুত এ লোকেরা আখিরাতের
বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন খরিদ করে নিয়েছে। তাদের ওপর থেকে আযাব কিঞ্চিত পরিমাণও হালকা
করা হবে না, সেদিন তাদের কোনো সাহায্যও করা হবে না’-সূরা বাকারা ৮৫-৮৬।
একটি কল্যাণ রাষ্ট্র
গঠনে যা প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে ইসলামে তা সবই হারাম। সুদ-ঘুষসহ সব ধরনের অনিয়ম
ও দুর্নীতি যা জনজীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, রাষ্ট্রীয় সকল ধরনের জুলুম-নির্যাতন,
আল্লাহ ও মানুষের হক নষ্ট, আমানত ও ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ,
নগ্নতা-বেয়াহাপনা-অশ্লীলতা, এককথায় বলা যায় জনস্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় এমন সকল আচরণ ও
কর্মকান্ড ইসলামে হারাম। সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষের সুখ-শান্তি-নিরাপত্তা
ও সকল অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বোপরি এ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মানুষ লাভ করবে
ক্ষমা ও আখিরাতে চিরস্থায়ী সুখের আবাস জান্নাত। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর ক্ষমা ও
জান্নাতের প্রত্যাশী হয়ে কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
১৯ রমযান ১৪৪১, ১৩ মে
২০২০।
Comments
Post a Comment