রমযানের প্রথম দশক
রহমতের অধ্যায় আজ শেষ হতে যাচ্ছে। শতভাগ না হলেও মোটামুটি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস
রয়েছে এমন সবাই রমযানের রোযা আদায় করে বলে আমার ধারণা। নিরেট নাস্তিক (হাতে গোণা)
হয়তো এই বরকত থেকে মাহরুম থাকে। তবে এটা ঠিক, আল্লাহপাক যে উদ্দেশে তাঁর বান্দাদের
প্রতি রোযা ফরজ করেছেন (তাকওয়া অর্জন) সেটির প্রতি খেয়াল রেখে রোযা পালনের সংখ্যা
খুবই নগন্য। যার কারণে নামায ও রোযার মত এতো কার্যকর ইবাদত থেকে সুফল লাভে
মুসলমানরা বঞ্চিতই রয়ে যাচ্ছে।
ইসলাম আল্লাহপাক
প্রদত্ত এক পূর্ণাঙ্গ দ্বীন এবং তিনি মানুষকে কেবল তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি
করেছেন। চেতনা লাভের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অর্থাৎ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত ও
সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় সকল অবস্থায় আল্লাহর দ্বীন অনুসরণই মূলত বান্দার দায়িত্ব
এবং যারা মেনে চলে তাদেরই নাম মুসলিম (অনুগত)। আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক হলো
মনিব ও গোলাম এবং মালিক ও খলিফার। আল্লাহর সার্বক্ষণিক গোলামীর জন্য যে জিনিসটি
খুব প্রয়োজন তা হলো মনিবের স্মরণ ও তাঁকে ভয় করা। নামায দৈনিক পাঁচবার আল্লাহর কথা
স্মরণ করে দেয় এবং বুকে হাত বেঁধে নামাযী এ প্রতিশ্রুতিই বারবার প্রদান করে, ‘আমরা কেবল তোমারই গোলামী করি ও তোমারই কাছে
সাহায্য চাই’। এজন্য নামাযকে বলা হয় স্মরণ (জিকর)। বান্দাহ
হিসেবে মনিবের গোলামী করার কথা বারবার স্মরণ করে দেয় বলে আল্লাহপাক জোর দিয়ে
বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই নামায মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে
ফিরিয়ে রাখে’।
স্মরণের পাশাপাশি
মনিবের ভয় অন্তরে থাকলে গোলাম সহজেই তাঁর ইবাদত (আনুগত্য) করতে পারে অর্থাৎ
আল্লাহর আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকতে পারে। রোযা মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয়
জাগ্রত করে। নামায, যাকাত ও হজ্জের মাঝে কিছু লৌকিকতা ও প্রদর্শনী রয়েছে। নামায তো
মসজিদে এসে জামাতবদ্ধভাবেই আদায় করতে হয়, যাকাত সরকারকে (বা কোনো সংগঠনকে)
প্রদানেরই নিয়ম এবং একান্ত না হলে অন্তত গ্রহীতা জানতে পারে; হজ্জ সকলের সাথে
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু রোযার সম্পর্ক কেবল আল্লাহ ও
বান্দার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সকলের সাথে সেহরি ও ইফতার করলেও কোন্ জিনিস তাকে বাধা দেয়
লোকচক্ষুর অগোচরে খাদ্যখানা গ্রহণে। সেটি আর কিছু নয়, আল্লাহর ভয়। বৈশাখ মাসের
কঠিন দিনে পিপাসায় অস্থির হয়ে পড়লেও বাথরুমে প্রবেশ করে রোযাদার এক ঢোক পানি পান
করে না এবং করে না এই ভয়ে যে, দুনিয়ার কেউ না দেখলেও আল্লাহ দেখছেন। তাঁকে ফাঁকি
দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। একদিন দু’দিন
নয়, টানা একটি মাস তাকে এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। বান্দার সকল আচার-আচরণ,
কার্যক্রম আল্লাহর নজরে রয়েছে-এই বোধ-উপলব্ধি সৃষ্টিই রোযার লক্ষ্য।
কিন্তু দুর্ভাগ্য
আমাদের, কতো নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা নিয়ে আমরা রোযা পালন করি, ইফতারি সামনে নিয়ে
অপেক্ষা করি এবং এক মিনিট আগেও কোনো খাদ্যখানা মুখে দেই না। আল্লাহর হুকুম পালনে
কতো সতর্কতা। যে চেয়ারম্যান, মেম্বর বা সরকারি কর্মচারি ত্রাণের চাল চুরি করছে,
অফিসে ঘুষ নিচ্ছে, ব্যবসায়ী ওজনে কম দিচ্ছে বা ভেজাল মেশাচ্ছে বা ফরমালিন দিচ্ছে
বা মজুদ করে সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াচ্ছে সেও রোযা রাখছে, আবার তাড়াতড়ি ও বিলম্বে
ইফতার নিয়ে ঝগড়াও করছে ও একে অপরকে ইসলাম থেকে খারিজও করে দিচ্ছে। আবার কী দিয়ে
ইফতার করলে বেশি ছওয়াব সে হিসাবও তার রয়েছে। কিন্তু রোযার উদ্দেশ্য, সর্বক্ষণ
আল্লাহকে ভয় করে চলার অনুভূতি জাগ্রত করা, সেটি তার মাঝে অনুপস্থিত। ফলে কর্মজীবনে
আল্লাহকে ভয় করে সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি পরিহার করে চলার যে প্রেরণা, সে রোযা
থেকে লাভ করে না। একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যেখানে নব্বই শতাংশ লোক রোযা পালন
করে সেখানে ঘুষ, দুর্নীতি, গুম-খুন, জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা সাক্ষ্যদান, পর্দাহীনতা,
পরকীয়া, যিনা-ব্যাভিচার, সামাজিক এতো অনাচার অকল্পনীয়।
এমন অবস্থার পেছনে মূলত
দায়ী আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলামকেও আমরা অন্যান্য ধর্মের মতই মনে করি। পাশ্চাত্যের
সেকুলারিজমে বিশ্বাসী হয়ে আমরা মনে করেছি ধর্ম অত্যন্ত পবিত্র জিনিস, ধর্মকে সব
বিতর্কের উর্ধে রাখতে হবে এবং সেটিকে রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে টেনে
আনলে ধর্মের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হবে। পাশ্চাত্য তাদের সমৃদ্ধি ও সুশাসনের জন্য
সততাকে (Honesty is the best policy) পুঁজি হিসেবে গ্রহণ করেছে। নিজের দেশে
সুশাসন, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়
যতখানি আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান; আবার তারাই পররাজ্য দখল ও শহরের পর শহর, গ্রামের পর
গ্রাম ধ্বংসসাধন এবং দেশে দেশে স্বৈরশাসকদের মদদদানে আদৌ বিবেকের তাড়না অনুভব করে
না। নিজ দেশের প্রেক্ষিতে তাদের গৃহিত আচার-আচরণ ও নিয়ম-কানুন অনেকাংশে প্রশংসনীয়।
কিন্তু তাদের অনুসারী উন্নয়নশীল দেশের মুসলিম নামধারীরা পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে
ইসলামবিমুখ হয়ে দুর্নীতিকেই তাদের সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হিসেবে বেছে নিয়েছে।
খন্ডিত দ্বীন
পালনকারীদের ব্যাপারে আল্লাহর কঠোর হুঁশিয়ারীতে আমাদের কোনো চেতনা নেই। এর ফলে
দুনিয়ার জীবনে জিল্লতি ও লাঞ্ছনা আমরা হাড়ে হড়ে টের পাচ্ছি। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের
একই চেহারা। আল্লাহর প্রতিশ্রুত ভয়াবহ আজাব মৃত্যুর পরই আমরা উপলব্ধি করবো। আমরা
গর্ব করে বলি, বিশ্বের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে ধর্মভীরু। তার মাপকাঠি হলো, আমাদের দেশে
রয়েছে অনেক মসজিদ-মাদ্রাসা ও আলেম-উলামা এবং জু’মার দিনে উপচেয়ে পড়া ভীড় ও পোশাক-পরিচ্ছদে। এ সবই ইতিবাচক, কিন্তু
দুর্ভাগ্য হলো, সমাজ পরিচালনায় আমাদের আলেম সমাজের কোনো অংশ নেই। নামাযের ইমাম
হয়েও মসজিদ কমিটিতে ইমাম সাহেবের কোনো সম্মানজনক পদ নেই, ইমাম সাহেবরা মাত্রই
কর্মচারী। এই সবই সেকুলারিজমের ফল। সমাজ থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা
হয়েছে। তাই অতি নামাযী ও রোযাদার হয়েও দুর্নীতি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারছে
না। এই নামায-রোযা থেকে তখনই সুফল পাওয়া যাবে যখন আমরা মনে করবো আমাদের দ্বীন
(ইসলাম) পূর্ণাঙ্গ এবং আমরা সার্বক্ষণিক গোলাম, একটি মুহূর্তও আল্লাহর গোলামীর
বাইরে নয়। সার্বক্ষণিক আল্লাহর গোলামী করার উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই মূলত
এই নামায ও রোযার মত আনুষ্ঠানিক ইবাদতসমূহ ফরজ করা হয়েছে এই বোধ-উপলব্ধিই দিতে
পারে আমাদের কাঙ্ক্ষিত সফলতা। আল্লাহপাক আমাদেরকে দ্বীনের সহীহ উপলব্ধি দান করুন।
Comments
Post a Comment