بِّسْمِ اللَّـهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ﴿١﴾ وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ ﴿٢﴾ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ ﴿٣﴾ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ ﴿٤﴾ سَلَامٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطْلَعِ الْفَجْرِ ﴿٥﴾
রহমান রহীম আল্লাহতায়ালার নামে-
১. আমি এটি (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাতে।
২. তুমি কি জানো কদরের রাত কী?
৩. কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম।
৪. ফেরেশতারা ও রুহ তাদের রবের সব ধরনের আদেশ নিয়ে (জমিনে) অবতরণ করে।
৫. এ রাতটি ফজরের উদয় পর্যন্ত পুরোপুরি শান্তিময়।
নামকরণ : প্রথম আয়াতের কদর শব্দটিকে নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
নাযিলের সময়কাল ও বিষয়বস্তু : মক্কী সূরা। কিছুটা মতপার্থক্য থাকলেও বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভঙ্গি দৃষ্টিতে মক্কী সূরা বলেই প্রতীয়মান হয়। সূরাসমূহের বিন্যাসের ক্ষেত্রে সূরা আল আলাক্বের পরেই এই সূরাটিকে স্থান দেয়াতে মনে হয় মক্কীযুগের প্রাথমিক দিকেই সূরাটি অবতীর্ণ।
রসুল (সা)-এর ওপর অবতীর্ণ এ কুরআনকে মক্কাবাসীরা ভালোভাবে গ্রহণ না করে উল্টো তাদের দুর্ভাগ্যের কারণ মনে করতে থাকে এবং নানাভাবে এই কুরআন ও যাঁর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তাঁকে মিথ্যা সাব্যস্ত করতে থাকে। এই সূরায় কুরআন মজিদের মর্যাদা এবং যে রাতে এই কুরআন নাযিল হয়েছে সে রাতের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। এই কুরআন সাধারণ কোনো কিতাব নয়, এর সম্মান ও মর্যাদা অনেক উচ্চে এবং এটা মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনকারী কিতাব। যে রাতে এই কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে সে রাতও সাধারণ কোনো রাত নয়, তা মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনকারী রাত। সে রাতে মানুষের তকদীরের ফায়সালা হয়।
ব্যাখ্যা : (১) সূরা আলাক্বের প্রথম ৫টি আয়াত নাযিলের পর কিছুদিন বিরতির পর সূরা মুদ্দাচ্ছিরের প্রথম ৭টি আয়াত নাযিল হয় এবং সেখানে মানুষকে সতর্ক করার জন্য রসুল (সা)-কে নির্দেশ প্রদান করা হয়। আল্লাহর দিকে আহবান জানানোর সাথে সাথে মক্কাবাসীদের মাঝে হৈ চৈ পড়ে যায়। তারা আল্লাহ, রসুল, কিতাব কোনো কিছুই বিশ্বাস করতে রাজি ছিল না। বরং রসুল (সা)-এর বিরুদ্ধে নানা ধরনের প্রচারণা শুরু করে এবং কুরআন শোনা থেকে বিরত রাখার জন্য নানা অপচেষ্টা চালাতে থাকে। কুরআন যে আল্লাহর বাণী তা তারা মানতে প্রস্তুত ছিল না, বরং মুহাম্মদ (সা)-এর বানানো বা কারো কাছ থেকে শুনে তা প্রচার করছে এমনটি তারা মনে করতো। তাদের আচরণের প্রেক্ষিতে আল্লাহপাক সূরা কদরে উল্লেখ করেছেন, ‘এই কুরআন আমি এক সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ রাতে নাযিল করেছি’। সূরা দুখানে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই আমি একে এক বরকতপূর্ণ রাতে নাযিল করেছি’।
কুরআন যে আল্লাহর কিতাব তা সূরার শুরুতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দেয়া হয়েছে। এখন কদরের রাত কোনটি তা নিয়ে বেশ মতপার্থক্য রয়েছে। তবে এটা যে রমযান মাসে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ আল্লাহপাক নিজেই সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে তা উল্লেখ করেছেন। কুরআন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কিতাব এবং যে মাসে এ কিতাব নাযিল হয়েছে সে মাসটিও (রমযান) অনেক মর্যাদা ও ফজিলতে পূর্ণ। রমযান মাসে একটি ফরজ অন্য সময়ের ৭০টি ফরজ, একটি নফল অন্য সময়ের একটি ফরজের সমান এবং মানুষের মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করার জন্য রমযান মাসে রোযা ফরজ করে দেয়া হয়েছে। কুরআনের সম্মান ও মর্যাদা তারাই দিতে পারে যাদের মধ্যে তাকওয়া রয়েছে। যে মানুষটি কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ অর্থাৎ আলেম এবং যারা হিফজ করেন অর্থাৎ কুরআনে হাফিজ তারাও সম্মানিত।
রমযান মাসের কদরের রাতে সূরা আলাক্বের ৫টি আয়াতের মাধ্যমে জিবরাইল (আ) থেকে রসুল (সা)-এর কাছে কুরআন অবতরণ শুরু হয় এবং প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ ২৩ বছরে তা সমাপ্ত হয়। তবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, আল্লাহপাক প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক কুরআনের আয়াতসমূহ রচনা করতেন। বরং মানবজাতিসহ সকল সৃষ্টি, নবী ও কিতাব প্রেরণ, সর্বশেষ নবী ও কুরআন প্রেরণ সবকিছুই আল্লাহতায়ালার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ। কদরের রাতে হতে পারে বাণীবাহক ফেরেশতার হাতে সমগ্র কুরআন তুলে দেয়া হয় বা সে রাতে জিবরাইল (আ) কর্তৃক মুহাম্মদ (স)-এর কাছে ওহী প্রেরণ শুরু। কদরের রাত সুনির্দিষ্ট করে আল্লাহ এবং রসুল (সা) থেকে বলা না হলেও রসুল (সা)-এর আমল থেকে জানা যায়, তিনি রমযান মাসের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন ও সাহাবাদের উৎসাহিত করতেন। কদরের রাত পাওয়ার জন্য রমযান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতসমূহ ইবাদত বন্দেগীতে কাটানোর জন্য তিনি সাহাবীদের বলেছেন। আলেম সমাজের মধ্যে মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে যে রমযানের শেষ দশকেই শবে কদর হবে এবং অধিকাংশের মত হলো ২৭শে রমযানই হলো শবে কদর। যেহেতু স্পষ্ট করা হয়নি তাই শবে কদর পাওয়ার উদ্দেশ্যে আমাদের উচিৎ রমযানের শেষ দশকে বেশি বেশি রাত্রি জাগরণ করা। আল্লাহপাকের অভিপ্রায়ও যেন তাই, তাঁর বান্দারা তাঁর রহমত পাওয়ার আশায় বেশি করে সচেষ্ট হবে।
(২-৩) কদরের রাতের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহপাক নিজেই প্রশ্ন করে আবার জবাব দিয়েছেন, কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এখানে হাজার বলতে ৮৩ বছর ৪ মাস ঠিক এমনটি নয়। বরং হাজার বলতে অসংখ্য বোঝায়। আরবি ভাষায় হাজার, সত্তর শব্দগুলো অসংখ্য বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তার অর্থ কদরের রাতে কুরআন অবতরণ হওয়াটা মানব ইতিহাসের এমন একটি ঘটনা যা যুগ যুগ ধরে কখনো ঘটেনি। ইতিহাসের গতি পাল্টে দেয়ার মত ঘটনা এবং মানব জাতি জাহিলিয়াত থেকে আলোর দিকে ফিরে আসার মত ঘটনা। তাই এ রাত কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। এ রাতের মর্যাদা সম্পর্কে রসুল (সা) বলেছেন, ‘কদরের রাতে আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাওয়ার আশায় যে ঈমানের সাথে দন্ডায়মান হয়, আল্লাহ তার পেছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেন’। কদরের রাতে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী এমন বিপুল পরিমাণ বান্দাকে তিনি ক্ষমা করে দেন এবং তাঁর পথে চলা বান্দাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। কদরের রাতে গোটা মুসলিম উম্মাহ তার অতীত পাপরাশির জন্য লজ্জিত-অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসার একটি সংকল্প গ্রহণ করে এবং জমিনে কুরআনের সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে নতুনভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
তবে কদরকে এভাবেও আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি। আমাদের জাতীয় জীবনে ২৬শে মার্চ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ গুরুত্বের পেছনে কারণ হলো, এ দিনে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছে। এ দিনে সরকার কর্তৃক বিপুল পরিমাণ কয়েদীকে মুক্তিদান, দেশের স্বার্থে বিশেষ অবদানের জন্য কাউকে স্বাধীনতা পদক প্রদান এবং জেলখানা-ইয়াতিমখানা-হাসপাতালে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও দেশের কল্যাণে ত্যাগস্বীকারের মানসিকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নানাবিধ কর্মসূচি গৃহিত হয় এবং গোটা জাতি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়। মানুষ তো আল্লাহরই প্রতিনিধি এবং তাঁরই কাছ থেকে শেখা এ সব আচরণ। সে দিনের নিজস্ব কোনো বৈশিষ্ট্য নয়, বরং বিশেষ ঘটনার কারণেই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
(৪-৫) আল্লাহতায়ালার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নিয়ে এ রাতে জিবরাইল (আ) ফেরেশতাদের সাথে করে এ পৃথিবীতে আগমন করেন এবং ফজরের উদয় পর্যন্ত সারাটা রাত থাকে শান্তিময়। এতে বোঝা যায়, এ রাতটি তকদীরের ভালো-মন্দ ফায়সালারও রাত। তাই আল্লাহর কাছে চাওয়া-পাওয়ারও রাত। আল্লাহপাক স্বয়ং নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে বান্দাহ কী চান তা জানতে চান। তাই আমাদের উচিৎ অবহেলা না করে রমযানের শেষ দশকে শেষ রাতে আল্লাহর কাছে ধর্ণা দেয়া এবং নিজের সব প্রয়োজন মনিবের কাছে পেশ করা। আল্লাহর কাছে চাইলে তিনি দেবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আল্লাহরই কথা- ‘যে আমাকে ডাকে, আমি তার ডাকে সাড়া দেই’। বান্দার কোনো প্রার্থনাই অপূর্ণ থাকে না। এ দুনিয়ায় না দিলেও আল্লাহপাক তা আখিরাতে তাঁর বান্দাকে পূর্ণ প্রতিদান দেবেন। তাই আমাদের উচিৎ আল্লাহর কাছে বেশি বেশি চাওয়া এবং এই চাওয়ার মধ্যে বান্দাসুলভ আচরণ অর্থাৎ বিনয় প্রকাশ পায়।
শিক্ষা : সূরা কদরে মূলত কুরআনের সম্মান ও মর্যাদা ব্যক্ত করা হয়েছে। কুরআনের কারণেই রমযানের এত মর্যাদা এবং শবে কদরের এত ফজিলত। তাই কুরআনকে আঁকড়ে ধরে এর হারাম-হালাল মেনে চলা এবং কদরের রাতে নিজের সকল প্রয়োজন আল্লাহর কাছে পেশের সাথে সাথে কুরআনের সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে সচেষ্ট হওয়ার তাওফিক কামনা করা কুরআন অনুসারীদের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর কিতাবের পূর্ণ অনুসারী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
Comments
Post a Comment