বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
হিংসা ও বিদ্বেষমুক্ত জীবন যাপনের মধ্যেই রয়েছে নাজাত
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ
সম্প্রতি দেশে এক আমূল পরিবর্তন হয়েছে। রাস্তায় পড়ে গিয়ে আমার স্ত্রী পায়ে আঘাত পাওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক দীর্ঘদিন আপনাদের মাঝ থেকে অনুপস্থিত ছিলাম। দেশটা জুলুম-নির্যাতন, গুম-খুন ও দুর্নীতিতে ভরে গিয়েছিল। দেশের আলেম সমাজ ও ঈমানদার জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি জুলুমের শিকার হয়েছিল। বিশেষ কোনো দল নয় সকল ঘরোনার আলেম-উলামা ও ঈমানদাররাই নির্যাতিত হয়েছেন। জামায়াত, হেফাজত, চরমোনাই কেহই জুলুম থেকে বাদ যায়নি। ৫ই মে হেফাজতে ইসলামীর ওপর হত্যাযজ্ঞ মানুষ কখনও ভুলবে না। সেদিন কতজন শহিদ হয়েছে সে হিসাবটাও জাতি জানে না। উলামায়ে কেরাম রসুলুল্লাহ সা.-এর ওয়ারিশ। আল্লাহর রসুল (সা.) কোনো অর্থবিত্ত রেখে যাননি, তাঁরা রেখে গিয়েছেন ইলম। এই ইলমের কারণেই আলেমরা সম্মানিত। নবির (সা.) ওয়ারিশ আলেম ও ঈমানদারদের প্রতি জুলুম কোনো সাধারণ বিষয় নয়। ঐ জালেমরা নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর শত্রু এবং সাথে সাথে আল্লাহপাকেরও শত্রু। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যারা ঈমানদার নর ও নারীকে যারা কষ্ট দেয় অতঃপর তওবা করে না তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি’- সুরা বুরুজ আয়াত ১০।
আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের প্রতি জুলুম করেন না এবং জুলুম তিনি তাঁর নিজের প্রতি হারাম করে নিয়েছেন। আল্লাহর বাণী, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি জুলুম করেন না, মানুষই নিজের প্রতি জুলুম করে থাকে’- সুরা ইউনুস আয়াত ৪৪। জালেমকে আল্লাহপাক শাস্তি দেবেনই এবং সেটি দুনিয়া ও আখেরাতে। মানুষের মান-ইজ্জত- সম্মান এবং জীবন ও সম্পদ সবই পবিত্র। কোনভাবেই তা ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে’- সুরা হুমাজা আয়াত ১। চিন্তা করুন, একটু গালি দিলে ও পেছনে দোষ প্রচার করলে যদি শাস্তি নিশ্চিত হয় তাহলে যারা গুম- খুন, চুরি-ডাকাতি ও সম্পদ পাচার করে তাদের পরিণতি কী হতে পারে? আল্লাহপাক সুরা হুমাজাতেই বলেছেন, জালেমের পরিণতি হবে হুতামা এবং সেটি আল্লাহর আগুন, প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত-উৎক্ষিপ্ত, অন্তর পর্যন্ত স্পর্শ করে। জাহান্নামের আগুনকে আল্লাহর আগুন বলার মধ্য দিয়ে জালেমের প্রতি আল্লাহর প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। আমার জানামতে আগুন বলে উল্লেখ এই একটি ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে।
মানুষের প্রতি জুলুম-নির্যাতন ও রাষ্ট্রের সম্পদ আত্মসাৎ করে যারা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে তারা আসলে ধনী নয়, রসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভাষায় হতদরিদ্র। কিয়ামতের দিন দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ ব্যাংক-ব্যালেন্স, স্বর্ণ-রৌপ্য কিছুই কাজে আসবে না। সেখানে মূল্য বহন করবে কেবল আমল। আল্লাহপাক জালেম থেকে মজলুমের সকল পাওনা সেদিন আদায় করে দিবেন। জালেমের ছিটেফোটা নেক আমল মজলুমকে দেয়ার পরে তার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তখন মজলুমের গুনাহ জালেমকে দেয়ার পর তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘোষণা মোতাবেক জালেমের চেয়ে নিঃস্ব, হতদরিদ্র ও মিসকিন আর কেহ নেই।
সরকারি ছত্রছায়ায় লুটেরাগোষ্ঠী সীমাহীন লুটপাট করে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে। এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছে এবং সালমান এফ রহমান জনতা ব্যাংক থেকে একা ২৭ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করেছে। দুর্নীতি রোধ করা যাদের দায়িত্ব সেই সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ ও পুলিশপ্রধান বেনজিরের সম্পদের হিসাব নেই। এই যখন অবস্থা তখন একটি দেশে কীভাবে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার পিয়ন চারশ কোটি টাকার মালিক, হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। এই উক্তিতেই তাঁর ও তাঁর সরকারের ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠে। অবসরপ্রাপ্ত এক সচিবের ঘরে ৩০০ কোটি টাকা নগদ পাওয়া যায় ও এক রাজনীতিক নেতার ঘর থেকে উদ্ধার হয় পাঁচ কোটি টাকা। এই হলো স্বৈরশাসকের চরম জুলুম-নির্যাতন ও দুর্নীতির হাল।
আল্লাহপাক সীমালঙ্ঘন সহ্য করেন না। সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন ও দুর্নীতির টাটকা ফল শাসকগোষ্ঠী লাভ করেছে। এমন করুণ পরিণতি আল্লাহপাকের নিদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়। ছাত্র-জনতার কয়দিনের আন্দোলনের ফলে সরকার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। জমিন ঈমানদারদের জন্য প্রশস্ত হয়ে পড়ে এবং জালেমের জন্য সংকীর্ণ হয়ে যায়। আর এটি আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা। তাঁর বাণী, ‘আমি সংকল্প করেছিলাম, পৃথিবীতে যাদের লাঞ্ছিত করে রাখা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবো, তাদের নেতৃত্ব দান করবো, তাদের উত্তরাধিকার করবো এবং পৃথিবীতে তাদের কর্তৃত্ব দান করবো’- সুরা ক্বাসাস ৫-৬। আল্লাহর ওয়াদা ষোলআনা বাস্তবায়ন হয়েছে।
প্রতিশোধ হিসেবে জালেমের উপর থেকে মজলুম দুনিয়ার জীবনে সমপরিমাণ বদলা নিতে পারে। মেপে মেপে প্রতিশোধ গ্রহণ অত্যন্ত কঠিন এবং তাতে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে জুলুম-নির্যাতন ক্রমাগত বাড়ে। আল্লাহপাক চান তাঁর বান্দারা ক্ষমা করুক। তাঁর বাণী, ‘অন্যায়ের প্রতিবিধান সমপরিমাণ অন্যায়, কিন্তু কেহ যদি ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধন করে নেয় তার পুরস্কার আল্লাহর জিম্মায়। আল্লাহ জালেমদের পছন্দ করেন না’- সুরা শূরা ৪০। বদলা নেয়ার সুযোগ লাভের পরও কেহ যদি ক্ষমা করে দেয় তাহলে তার প্রতিদানের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহপাক গ্রহণ করেন। নবিকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেছেন, ‘ভালো ও মন্দ কখনো এক নয়। তুমি মন্দকে দূর করো সেই ভালো দ্বারা যা অতীবও উত্তম; তাহলে দেখবে জানের দুশমনরা প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে’- সুরা হামিম আস সেজদা ৩৪। আমিরে জামায়াত সেটিই বলেছিলেন কিন্তু সেটির ভুল ব্যাখ্যা করে দারুণ সমালোচনা করা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, এই সরকারের অধীনে দল হিসেবে জামায়াত সবচেয়ে জুলুমের শিকার হয়েছে। তাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘর বুলডজার দিয়ে ভেঙে দেয়া হয়েছে, অফিস সব তালাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা চালাতে দেওয়া হয়নি; এমনকি মহিলাদেরও কুরআন-হাদিসের কোনো চর্চা করতে দেওয়া হয়নি। তারপরও আমরা দলগতভাবে কোনো প্রতিশোধ নেব না। হ্যাঁ, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা আইনের আশ্রয় নিলে আমরা সহযোগিতা করবো। আমরা চাই না, কেহ আইন নিজ হাতে নিয়ে জুলুমের পরিবর্তে আবার জুলুম করবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর সারাজীবন শ্বেতাঙ্গদের জেলখানা কাটিয়েছেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁর জাতি তাঁকে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ঘোষণা দেন, কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ নয় আমরা সবাই দক্ষিণ আফ্রিকান। ক্ষমা ঘোষণার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি দ্রুত শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন এবং নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে হয়ে পড়েন বিশ্বনেতা ও লাভ করেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার।
এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বৈষম্যহীন ও সকলের জন্য নিরাপদ একটি সমাজ গড়ে তোলা। এজন্য প্রয়োজন হিংসা থেকে দূরে অবস্থান করা। দেশে এতো মারামারি -খুনোখুনি, জুলুম-নির্যাতন তার মূলে রয়েছে পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ। সমাজটাকে সবার জন্য নিরাপদ ও বাসযোগ্য করতে হলে হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং বেরিয়ে আসার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর বিধান অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ¦ালিয়ে ভস্ম করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়।’ হিংসা -বিদ্বেষ পোষণ শুধু কবিরা গুনাহ নয় বরং সেই সাথে পূর্বের জমা করা নেকিও নিঃশেষ করে দেয়। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করতে চান এবং করেনও। প্রতিটা রাতে তিনি নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন এবং কে আছো যে রিজিক চায়, যে ক্ষমা চায় আমি তাকে রিজিক দেব ও ক্ষমা করবো। আল্লাহপাক প্রতিনিয়ত তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন কিন্তু ক্ষমা থেকে বাদ পড়ে কেবল হিংসুক ও মুশরিক। হিংসা জঘন্য অপরাধ এবং কোনো হিংসুকের রোষানলে পড়লে মানুষ সর্বস্যহারা হয়ে যায়। তাই আল্লাহপাক সুরা ফালাকে হিংসুকের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে বলেছেন।
হে আল্লাহ! হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে তুমি আমাদের রক্ষা করো এবং পরস্পরকে ক্ষমা করার মতো উদারতা দান করো। আমিন।
Comments
Post a Comment