Skip to main content

জুমার খুতবা ০৪.১০.২০২৪


বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

রসুলপ্রেম ঈমানের অপরিহার্য দাবি

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

মাল্টিপ্ল্যান রেডক্রিসেন্ট সিটি (কুশিয়ারা, পদ্মা ও সুরমা ভবন), মিরপুর জামে মসজিদের সম্মানিত ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাইয়াফ শুরুতে আল্লাহপাকের হামদ ও রসুলুল্লাহ সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করেন। খতিব মহোদয় কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, একজন মুমিন তার নিজের জান- মাল, পিতা-মাতা ও সবকিছু অপেক্ষা আল্লাহ, তাঁর রসুল ও তাঁর পথে জিহাদকে অগ্রাধিকার দিবে। এ প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী, ‘হে নবি! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয় -স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাকো এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে খুবই পছন্দ করো- এসব যদি আল্লাহ ও তাঁর রসুল এবং তাঁর পথে জিহাদ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফয়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। আল্লাহ ফাসেকদের কখনো হেদায়াত (সত্য পথের সন্ধান) দান করেন না’- সুরা তওবা ২৪।

যেসব জিনিস মানুষের খুব প্রিয় এবং যার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত সেসব একে একে উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যদি আল্লাহ, তাঁর রসুল ও তাঁর পথে জিহাদ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তাহলে আল্লাহপাক অপেক্ষা করার সাথে ফাসেক উল্লেখ করে বলেছেন, তাদের জন্য কোনো হেদায়াত নেই। একজন মুমিনের জীবনে আল্লাহ, তাঁর রসুল এবং তাঁর পথে জিহাদ অপেক্ষা কোনকিছু প্রিয় হতে পারে না। আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে ভালোবাসা অর্থ সর্বদা তাঁদের অনুসরণ করা। আল্লাহপাক অন্যত্র বলেছেন, যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও তাহলে রসুলকে অনুসরণ করো। জীবনের সকল ক্ষেত্রে রসুলুল্লাহ সা.-কে অনুসরণের জন্য একজন মুমিনকে সর্বিক্ষণিক প্রস্তুত থাকতে হবে। খণ্ডিতভাবে মানা নয় রসুলুল্লাহ সা.-কে পরিপূর্ণভাবে মানতে হবে। সকল ব্যবস্থাপনার উপরে দীনের বিজয় ছাড়া পরিপূর্ণ তাঁকে মানা সম্ভব নয়। এজন্য আল্লাহর পথে জিহাদকে ফরজ করা হয়েছে এবং এখানে একই সাথে আল্লাহ, তাঁর রসুল ও তাঁর পথে জিহাদকে সবকিছুর উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং গুরুত্ব দানের ক্ষেত্রে কোনকিছু যেন বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেজন্য সতর্ক করা হয়েছে।

মানবচরিত্রের সকল সৎ গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিল রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনে। অতি শৈশব থেকে সততা, বিশ্বস্ততা, প্রতিশ্রুতি পালন, আমানতদারি সকল মৌলিক মানবীয় গুণে তিনি ভূষিত ছিলেন এবং তাঁর সমাজের লোকেরা তাঁকে আল আমিন ও আস সাদিক ডাকতেন। আল্লাহপাক নিজেই সাক্ষ্য দান করেছেন, ‘নিঃসন্দেহে তুমি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত’- সুরা কালাম ৪। তিনি ছিলেন মুমিনদের জন্য আদর্শ যাঁকে মেনে চললে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ লাভ সম্ভব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’- সুরা আহযাব ২১। কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্বাসীদের জন্য তিনি মডেল। শৈশব থেকে বার্ধক্য এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রেই তিনি আদর্শ।

কুরআন মজিদে অসংখ্য জায়গায় নবির উচ্চ মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। সুরা আহযাবের ৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিঃসন্দহে নবি ঈমানদারদের কাছে তাদের নিজেদের তুলনায় অগ্রাধিকারী, আর নবির স্ত্রীগণ তাদের মা। আল্লাহপাক অন্যান্য নবিকে তাঁদের জাতির ভাই হিসেবে উল্লেখ করলেও মুহাম্মদ সা.-কে তাঁর উম্মতের কাছে পিতৃমর্যাদা এবং স্ত্রীগণকে মা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হাদিসের ভাষায় বলা হয়েছে, সবকিছু অপেক্ষা এমনকি নিজের জীবন অপেক্ষা রসুলুল্লাহ সা.-কে অধিক ভালো না বাসলে ঈমানের দাবি পূরণ হয় না।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.-কে শুধু মুসলমান নয়, শুধু আরববাসী নয় সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তাঁকে অনুসরণ বা তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ- ভাষা-লিঙ্গ সকলের জন্য কল্যাণ নিশ্চিত হবে। আল্লাহপাকের বাণী, ‘হে নবি! আমি তোমাকে জগদ্বাসীর জন্য রহমত করেই পাঠিয়েছি’ সুরা আম্বিয়া ১০৭। তাঁর পরে আর কোনো নবি এই ভূপৃষ্ঠে আসবে না। কিয়ামত পর্যন্ত তিনি সকল মানুষের নবি, সকলের জন্য পথপ্রদর্শক। এই হলো আল্লাহপাক প্রদত্ত আমাদের নবির মর্যাদা।

নবি মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি সামান্য কষ্ট তিনি সহ্য করেননি। নবিও একজন মানুষ, তাঁরও প্রাইভেসি রয়েছে এবং তাঁরও বিশ্রাম প্রয়োজন। নবির সান্নিধ্য পেতে কার না মন চায়? সাহাবিরাও চাইতেন, নবির একটু সাহচর্য পেতে, একটু সময় নিয়ে কথা বলতে। রসুলুল্লাহ সা. সাহাবিদের মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতেন না। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধুর বিষয়টি এড়িয়ে যাননি। আল্লাহর বাণী, ‘হে ঈমানদারগণ! নবিগৃহে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করো না, খাবার সময়ের অপেক্ষায়ও থেকো না। হ্যাঁ যদি তোমাদের খাবার জন্য ডাকা হয়, তাহলে অবশ্যই এসো কিন্তু খাওয়া হয়ে গেলে চলে যাও, কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না। তোমাদের এসব আচরণ নবিকে কষ্ট দেয় কিন্তু তিনি লজ্জায় কিছু বলেন না। নবির স্ত্রীদের কাছে যদি তোমাদের কিছু চাইতে হয় তাহলে পর্দার আড়াল থেকে চাও। এটা তোমাদের ও তাদের মনের পবিত্রতার জন্য বেশি উপযোগী। তোমাদের জন্য আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেয়া মোটেই জায়েজ নয়, এটা আল্লাহর দৃষ্টিতে মস্তবড় গুনাহ’- সুরা আহযাব ৫৩। এতটুকুতে যদি হয় মস্তবড় গুনাহ হয় তাহলে যারা নবির শানে বেয়াদবি করে এবং চরিত্রের দিকে অঙ্গুলি তুলে তাদের অপরাধের মাত্রা কতবড় হবে?

তথাকথিত প্রগতিশীলরা বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ সম্পর্কে নানাবিধ কথা বলে। রসুলুল্লাহ সা. পঁচিশ বছরের একজন যুবক হয়ে চল্লিশ বছরের এক বিধবা মহিলাকে নিয়ে পঁচিশ বছর দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন। খাদিজা রা.-এর ইন্তেকালের পরে তিনি একজন বিধবা সাওদা রা.-কে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল পঞ্চাশ বছর। তাঁর প্রথম স্বামী সাকরান রা. আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীদের একজন ছিলেন। সাকরান রা. ইন্তেকালের পরে মুহাম্মদ সা. সাওদা রা.-কে বিয়ে করেন। রসুলুল্লাহ সা.-এর স্ত্রীদের মধ্যে আয়িশা রা. ছিলেন মাত্র কুমারী। বিয়ের সময়ে তাঁর বয়স ৬/৭ বছর হলেও তাঁর দাম্পত্য জীবন শুরু মদিনায় যখন তাঁর বয়স ৯/১০ বছর। এই বয়সে আরবের মেয়েরা বয়োপ্রাপ্ত হয়ে পড়েন। রসুলুল্লাহ সা.-এর অধিকাংশ বিয়ে নানা পারিপার্শিক কারণে এবং বলা যায় মহান আল্লাহপাকের ইচ্ছাক্রমেই হয়েছে। পৃথিবীর অনেক বড়ো বড়ো মানুষের বিয়ে হয়েছে তাদের ভাষায় নাবালিকার সাথে। মরহুম শেখ মুজিবের যখন বিয়ে হয় তখন তাঁর স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র আট বছর। আসলে নবি মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি বিদ্বেষ থেকেই ইসলামের শত্রুরা অপপ্রচার চালায়।

নবি মুহাম্মদ সা.-এর সম্মান ও মর্যাদা স্বয়ং আল্লাহপাক নিজেই দান করেছেন। তিনি এবং তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী নবির সা. প্রতি দরুদ পাঠ করেন এবং ঈমানদারদের প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশ করেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবির প্রতি দরুদ পাঠান। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠাও’- সুরা আহযাব ৫৬। সর্বোত্তম দরুদ হলো দরুদে ইবরাহিম যা আমরা নামাজে নিয়মিত পড়ে থাকি। সংক্ষিপ্ত দরুদ হলো ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহিস্সালাম’ যা আমরা নবির নাম উচ্চারণ হওয়ার সাথে সাথে পড়ে থাকি। নফল ইবাদতের মধ্যে ঈমানদারদের জন্য অধিক সওয়াবের আমল হলো নবির উপর দরুদ ও সালাম প্রেরণ।

মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহপাক সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী বলেছেন, যিনি শৈশব থেকে তাঁর জাতির কাছ থেকে আল-আমিন ও আস- সাদিক হিসেবে পরিচিত, যাঁকে আল্লাহপাক জগতবাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন সেই বিশ্বনন্দিত মহামানব সম্পর্কে কটূক্তি কোনো ঈমানদার সহ্য করতে পারে না। কারণ ঈমানদারদের কাছে আল্লাহর রসুল সা. তার নিজের জীবন, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা সবকিছু অপেক্ষা প্রিয়। যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে কষ্ট দেয় তাদেরকে আল্লাহ দুনিয়ায় ও আখেরাতে অভিশপ্ত করেছেন এবং তাদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক আজাবের ব্যবস্থা করেছেন। আবু লাহাব নবির সা. প্রতি বেয়াদবি করলে আল্লাহ তায়ালা সুরা লাহাব নাজিল করে তার প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এবং তার পরিণতি হিসেবে করুণ মৃত্যু দান করেছেন। আরবের কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে প্রথম যুদ্ধ বদরের ময়দানে ধ্বংস করেছেন। পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে জাহেলি সমাজের কবর রচনা করেছেন।

খতিব মহোদয় বলেন, আল্লাহ, কুরআন বা ইসলামের কোনো বিধান সম্পর্কে কটূক্তি বা অস্বীকার করলে মুসলমান আর মুসলমান থাকে না, হয়ে যায় মুরতাদ। মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে মুরতাদ তওবা করে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু রসুলের শানে বেয়াদবি শুধু মুরতাদ নয়, তার ফিরে আসার সুযোগ নেই। তাকে হত্যা করা রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। রসুল সা.-এর সময়ে তাঁর শানে কেহ বেয়াদবি করলে তাকে কোনো সাহাবি তাৎক্ষণিক হত্যা করে ফেললে রসুল সা. তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। সম্প্রতি ভারতের মুম্বাই শহরে রসুল সা.-এর প্রতি কটূক্তি করলে সেখানকার মুসলমানরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। মিরপুর ও শাহ আলী থানার ইমামদের উদ্যোগে মিরপুর এক নম্বর গোল চত্তরে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে শরীক হওয়ার জন্য খতিব মহোদয় তাঁর মুসল্লিদের প্রতি আহবান জানান। নবির সা. প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা প্রকাশের লক্ষ্যে তিনি তাঁর মুসল্লিদের পরিপূর্ণভাবে নবিকে সা. অনুসরণের জন্য আহবান জানান ও দোয়া করেন।

Comments