বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
হে ঈমানদারগণ! রুকু করো, সাজদা করো এবং তোমাদের রবের ইবাদত করো, আর নেক কাজ করো, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে (৭৭)।
আর জিহাদ করো আল্লাহর পথে হক আদায় করে। তিনি তোমাদের মনোনীত করেছেন এবং দীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোনো সংকীর্ণতা চাপিয়ে দেননি। তোমাদের পিতা ইবরাহিমের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত হও। তিনি আগেই তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’ এবং এই কিতাবেও, যাতে করে এই রসুল তোমাদের উপর সাক্ষী হয় আর তোমরাও সাক্ষী হও মানবজাতির উপর। অতএব তোমরা সালাত কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং আঁকড়ে ধরো আল্লাহকে। তিনিই তোমাদের মাওলা (অভিভাবক)। কতো যে উত্তম মাওলা তিনি এবং কতো যে উত্তম সাহায্যকারী (৭৮)।
নামকরণ :
২৭ নং আয়াতের মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা প্রচার করে দাও। চিহ্নস্বরূপ নামকরণ করা হয়েছে সুরা হজ।
নাজিল হওয়ার সময়কাল :
বর্ণনাভঙ্গি ও বিষয়বস্তুর প্রেক্ষিতে বলা যায় সুরা হজের একটি অংশ মক্কার শেষ দিকে ও বাকি অংশ মদিনার শুরুতে নাজিল হয়। প্রথম থেকে ২৪ আয়াত পর্যন্ত মনে হয় মক্কায় এবং বাকি অংশ মদিনায় অবতীর্ণ।
বিষয়বস্তু :
এই সুরায় তিনটি দলকেই সম্বোধন করা হয়েছে। মক্কার মুশরিক সমাজ, দ্বিধাগ্রস্ত ও দোটানায় পড়ে থাকা মুসলিম এবং আপোষহীন সত্যনিষ্ঠ মুসলিম। আরবের মুশরিক যারা নবি মুহাম্মদ সা.-এর দাওয়াত অস্বীকার করে আসছিল তাদেরকে ভয় দেখানো হয়েছে ও সতর্ক করা হয়েছে, দ্বিতীয়ত দোটানা মুসলমান যারা ভালো কিছু দেখলে আছি এবং বিপদাপদে নেই তাদের তিরস্কার করা হয়েছে এবং নিষ্ঠাবান মুসলমানকে আল্লাহর পথে জানমাল দিয়ে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
মদিনায় হিজরত করার পর হজের মওসূমে আল্লাহর ঘর জিয়ারতের আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিকভাবে মুসলমানদের অন্তরে জাগে। এই ঘরটি তৈরিই হয়েছিল আল্লাহর স্মরণ উপলক্ষে, কিন্তু তা মুশরিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় তাওহিদের পরিবর্তে সেটি শিরকের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং আল্লাহর ইবাদতকারিদের জন্য মসজিদে হারামের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই দুরাচারদের সেখান থেকে হটিয়ে কাবার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এবং একটি কল্যাণমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানদের প্রতি এই প্রথম যুদ্ধের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।
সুরা হজে কাবার ইতিহাস বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে আল্লাহর হুকুমে তাঁরই ইবাদতের জন্য হযরত ইবরাহিম আ. এই ঘরটি নির্মাণ করেছিলেন এবং হজের লক্ষ্যে এই ঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এই সুরায় ঈমানদারদের মুসলিম নামকরণ করা হয়েছে এবং তাদেরকে হজরত ইবরাহিম আ.-এর যথার্থ স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে।
ব্যাখ্যা :
৭৭. রুকু করো, সেজদা করো, রবের বন্দেগি করো ও নেক কাজ করো- তোমরা সফলকাম হবে। সবই পরিপূরক। এই আয়াতে বান্দাকে পুরোপুরি তার মহান মনিবের কাছে সঁপে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে নেক কাজের কোনো ফিরিস্তি দেয়া হয়নি। বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে ঈমান ও নেক আমলে যারা সমৃদ্ধ হবে তারাই সফল হবে। মানবকল্যাণে সাধিত সকল কর্মই নেক আমল বা মানবপ্রকৃতি যা দাবি করে বা যে কাজের সার্বজনীন স্বীকৃতি রয়েছে এবং যে কাজে আল্লাহপাকের অনুমোদন রয়েছে সবই নেক আমল। আল্লাহর নিষেধ থেকে বিরত থাকাও নেক আমল। নিয়তের প্রশ্নটিও জড়িয়ে আছে- আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
এটাকে সেজদার আয়াত হিসেবে গণ্য করার ক্ষেত্রে দুটি মত রয়েছে। সেজদা করো- নির্দেশসূচক কথার প্রেক্ষিতে কারো কারো মতে সেজদার আয়াত ও সেজদা করতে হবে। রুকু ও সেজদা পাশাপাশি থাকায় ইমাম আবু হানিফা রহ.সহ অনেকের মতে নামাজের কথা বলা হয়েছে। রুকু ও সেজদা নামাজের ফরজ। তবে এতটুকুতেই নামাজ হয় না। নামাজ আদায় করতে হবে রসুলুল্লাহ সা. যেভাবে নামাজ আদায় করেছেন তেমনিভাবে। যারা মনে করে কুরআনই হেদায়াতের জন্য যথেষ্ট; তারা ভুলের মধ্যে রয়েছে। রসুলের প্রতি ঈমান এবং তাঁর আনুগত্য ফরজ। তাঁর আনুগত্যের বাইরে ইসলাম নেই।
৭৮. রুকু, সেজদা, আল্লাহর বন্দেগি ও নেক কাজের মধ্যে সবই চলে আসে। তারপরও ঈমানদারদের জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্য এবং দায়সারাভাবে নয় হক আদায় করে। মূলত আল্লাহপাক তাঁর পথে জিহাদ করার জন্য ঈমানদারদের বাছাই করে নিয়েছেন। ফি সাবিলিল্লাহ না বলে ফিল্লাহ বলে পরিপূর্ণভাবে নিজেকে আল্লাহতে সঁপে দেয়া বা সুরা তওবার ২৪ নং আয়াত জিহাদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সবকিছুকে উপেক্ষা করে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার মাধ্যমে।
দীনের মধ্যে কোনো সংকীর্ণতা রাখেননি। আমাদের দীনে রয়েছে প্রশস্ততা ও উদারতা। পূর্বযুগের পাদ্রী-পুরোহিতরা মানুষের জীবনে নানাভাবে সংকীর্ণতা চাপিয়ে দিয়েছিল। নিষেধের ঝুলি নিয়ে মানুষ চলতে চায়। কিন্তু হারাম সুনির্দিষ্ট। পাকপবিত্র সবই আল্লাহপাক হালাল করেছেন। আল্লাহপাক বলেছেন, বড়ো বড়ো গুনাহ থেকে দূরে থাকলে ছোট গুনাহসমূহ আল্লাহপাক ক্ষমা করে দিবেন। ফরজ-ওয়াজিবে কোনো মতপার্থক্য নেই। সুন্নাত-মুস্তাহাব ক্ষেত্রে স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর আমলের মধ্যে পার্থক্য ছিল এবং এটি ছিল উম্মাহর জন্য সহজতা দান। দুর্ভাগ্য, এসব আমল নিয়ে উম্মাহর মাঝে বর্তমানে সৃষ্টি হয়েছে নানা মতপার্থক্য ও দলাদলি যা মোটেই কাম্য নয়। নামাজের মতো ইবাদতে ফরজ লঙ্ঘিত হলে নামাজ পুনরায় আদায় করতে হয়, ওয়াজিব ছুটে গেলে সহু সেজদা দিতে হয় এবং এর নিচে সুন্নাত-মুস্তাহাবে কোনো ভুল ধর্তব্যের মধ্যে নয়। সুন্নাত-মুস্তাহাব আমল সৌন্দর্যবর্ধক ও পরিপূরক এবং বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধিকারক।
ইবরাহিমের মিল্লাত- হজরত ইবরাহিম আ. ইহুদি, খৃষ্টান ও মুসলিম সবারই নেতা এবং তিনি ছিলেন নির্ভেজাল মুসলিম, শিরকমুক্ত ও তৌহিদবাদী। তিনিই আমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম এবং এই কুরআনেও। আভিধানিক অর্থে মুসলিম শব্দের অর্থ অনুগত। সে হিসেবে হজরত আদম আ. থেকে শুরু করে সকলের দীন ছিল ইসলাম এবং সবাই ছিলেন মুসলিম।
রসুলুল্লাহ সা. তাঁর উপর অবতীর্ণ দীন তাঁর সময়ে সাহাবায়ে কেরামের কাছে পৌঁছে দিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন ঠিক দীনের জিম্মাদারী তাঁর উম্মত হিসেবে এখন আমাদের উপর। মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে সাক্ষ্যদাতা হতে হবে।
নামাজ ও জাকাত আদায়ের পাশাপাশি সাক্ষী হওয়ার দায়িত্ব পালনের জন্য জামায়াতবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই আল্লাহপাকের নির্দেশ আল্লাহর রশি নয় আল্লাহকে আঁকড়ে ধরো। খুব শক্তভাবে ধরো বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না।
বান্দার জন্য বড়ো ভরসা হলেন আল্লাহ তায়ালা, তিনিই ঈমানদারদের অভিভাবক (মাওলা), শ্রেষ্ঠতম মাওলা। সাহায্যের জন্য তিনিই যথেষ্ট। ফলে তাঁর উপর নির্ভর করে বান্দা পুরোপুরি ভয় ও ভাবনাহীন হতে পারে।
শিক্ষা : কুরআন মজিদে বিভিন্নভাবে নাজাত প্রসঙ্গে ঈমান ও নেক আমলের কথা বলা হয়েছে। পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর আনুগত্য করতে পারলে আশা করা যায় তিনি তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু খুব ঝুঁকিপূর্ণ। দীন প্রতিষ্ঠিত না থাকলে আল্লাহকে পরিপূর্ণভাবে মানা কঠিন হয়ে পড়ে। আল্লাহর পথে জিহাদ জান্নাতে যাওয়ার পথটাকে সহজ করে দেয়। জানমাল দিয়ে জিহাদ করলে আল্লাহপাক গুনাহসমূহ ক্ষমা ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন। জিহাদের মাধ্যমে বান্দার মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়। অর্থাৎ আবেদ থেকে আল্লাহর সাহায্যকারী ও খলিফা হয়ে যায়। মূলত উম্মতে মুহাম্মদী আল্লাহর বাছাইকৃত বান্দা এবং জিহাদের মধ্য দিয়ে জমিনে হকের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের মূলোৎপাটন করা এই উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ (সুরা আলে ইমরান ১১০)।
Comments
Post a Comment