বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
‘আর তোমরা সবাই আল্লাহর বন্দেগি করো। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। বাপ-মা’র সাথে ভালো ব্যবহার করো। নিকটাত্মীয় ও এতিম- মিসকিনদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্বসাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন বাঁদী ও গোলামদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো। নিশ্চিত জেনে রাখো, আল্লাহ এমন কোনো ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না যে আত্মঅহংকারে ধরাকে সরা জ্ঞান করে এবং নিজের বড়াই করে।’
নামকরণ : এই সূরায় বিভিন্ন বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। সূরাগুলোয় সাধারণত বিষয়ভিত্তিক কোনো শিরোনাম নির্ধারণ না করে চিহ্নস্বরূপ নামকরণ করা হয় এবং এভাবে এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে সূরা আন নিসা অর্থাৎ এটি সেই সুরা যাতে নিসা বা রমণী শব্দটি উল্লেখ রয়েছে।
নাজিলের সময়কাল : মদিনায় অবতীর্ণ। বিভিন্ন সময়ে ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্দেশনা হিসেবে নাজিল হয়েছে। তৃতীয় হিজরির শেষ থেকে চতুর্থ হিজরির শেষ দিকে বা পঞ্চম হিজরির প্রথম দিকে অবতীর্ণ হয়েছে।
বিষয়বস্তু : কোনো একক বিষয় নয় বরং মদিনায় ইসলাম একটি রাষ্ট্রীয় দীন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করায় শরিয়তের বিধি-বিধান সেখানেই নাজিল হয় এবং সেটি প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে। ওহুদ যুদ্ধে ৭০জন সাহাবি শাহাদত বরণ করেন। অনেকে বিধবা হন আবার অনেকে এতিম হন। এই সূরায় উত্তরাধিকার আইন, এতিমদের লালন-পালন, যুদ্ধের ময়দানে ভয়কালীন নামাজ, পানির অভাবে তায়াম্মুমের বিধান ইত্যাদি শরিয়তের হুকুম নাজিল করা হয়েছে। কাফের, মুশরিক, আহলে কিতাব ও মুনাফিকদের সাথে আচরণ কেমন হবে তাও বলা হয়েছে। মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভের ফলে মুসলমানদের এক নিরাপদ আবাস গড়ে উঠে এবং মক্কা ও আশেপাশে ইসলামে দিক্ষীত সবাইকে হিজরত করে মদিনায় চলে আসারও নির্দেশ প্রদান করা হয়। অনুকূল পরিবেশে আল্লাহর পক্ষ থেকে আচার-আচরণ ও নানাবিধ সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ব্যাখ্যা : ইসলামের মৌল দাবি হলো মানুষ কেবল আল্লাহকেই ইলাহ মানবে এবং তাঁরই আনুগত্য করবে। আল্লাহ ছাড়া সকল আনুগত্য অস্বীকার করবে। এটি কেবল তখনই সম্ভব যখন জমিনে আল্লাহর দীন অর্থাৎ তাঁর কর্তৃত্ব (ঈমানদারদের নেতৃত্ব) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মদিনায় রসুলুল্লাহ সা.-এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর ইসলাম মানার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা-প্রতিবন্ধকতা ছিল না। এই আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহর আনুগত্য করো আর তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। আল্লাহর সাথে শরীক না করা অর্থ- তাঁর জাতে, আনুগত্যে, ক্ষমতা-এখতিয়ার ও গুণাবলীতে কাউকে না মানা। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর বন্দেগি অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের মোকাবেলায় আর কোনো আইন, বিধি-বিধান বা আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে আর কোনো হুকুম মানা যাবে না। এটা হলো ইসলামের মৌলিক দাবি। তাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার চিন্তা-চেতনা রিক্ত কোনো দলের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক ছাড়া ঈমানগত সম্পর্ক থাকতে পারে না। আল্লাহর কাছে মনোনীত একমাত্র দীন বা জীবনব্যবস্থা হলো ইসলাম (আলে ইমরান ১৯)। এর বাইরে যতো বাদ-মতবাদ তা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষবাদ, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, একনায়কতন্ত্রবাদ যে নামেই হোক কেন তা সবই বাতিল এবং এসব মতবাদের সমর্থক, কর্মী, নেতা সবাই আল্লাহর সাথে শিরকের অপরাধে অপরাধী। প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব লোক যদি নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, যাকাত দেয়, হজ করে ও নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে তবুও কি? হ্যাঁ, ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামকে মেনে চললেও আর্থিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে না মানার কারণে তারা পরিপূর্ণ মুসলিম হতে পারে না। আল্লাহর বাণী, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না; নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন’- সূরা বাকারা ২০৮। জীবনের যে অংশে তারা ইসলাম মানে না সেখানে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অর্থাৎ আল্লাহর সাথে শিরক করে এবং এইসব শিরককারীর ইবাদত আল্লাহর কাছে গৃহিত হয় না। জীবনে পরিপূর্ণ ইসলাম না মানা প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশ মানবে এবং কিছু অংশ অমান্য করবে, তাহলে দুনিয়ার জীবনে রয়েছে জিল্লতি ও আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব’- সূরা বাকারা ৮৫। আজকের বিশ্বে মুসলমানদের এই জিল্লতির মূলে রয়েছে দীনকে পরিপূর্ণভাবে না মানা।
কুরআন মজিদ পড়তে গিয়ে আমরা বারবার পাই ঈমান ও নেক আমলের কথা এবং ঈমান ও নেক আমলে যারা সমৃদ্ধ তারাই হবে সফলকাম। নেক আমলের একটি দিক হলো সদাচরণ এবং অন্যটি হলো আর্থিক বিষয় সম্বলিত- কেনাবেচা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সবধরনের লেনদেন ও রুজি- রোজগারে সততা, বিশ্বস্ততা, প্রতিশ্রুতি পালন, আমানত সংরক্ষণ এবং মানবীয় সকল গুণাবলীতে সমৃদ্ধ হওয়া। এখানে আল্লাহর বন্দেগির সাথে সাথে তাঁর বান্দাদের সদাচরণের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সদাচরণ করা আল্লাহর বন্দেগিরই অংশ। কুরআন মূলত একটি আইন গ্রন্থ এবং তার পাশাপাশি আল্লাহর দেয়া আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে মানুষকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
বাবা-মার সাথে ভালো ব্যবহার :
আল্লাহর সকল সৃষ্টি বিশেষ করে সেরা সৃষ্টি সকল মানুষ সদাচরণ পাওয়ার হকদার। এখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথমেই বলা হয়েছে বাবা -মার সাথে ভালো ব্যবহার করো। সূরা বনি ইসরাইলে বলা হয়েছে বাবা-মা কোনো একজন বা উভয়ই যদি বার্ধক্যে উপনীত হন তাহলে তাদের শানে উহ্ পর্যন্ত বলো না। মৃত্যুর পরও বাবা-মার জন্য সন্তানের করণীয় বলে দেয়া হয়েছে এবং বাবা-মার জন্য দোয়া করার ভাষাও আল্লাহপাক শিখিয়ে দিয়েছেন (রব্বির হামহুমা কমা রব্বা ইয়ানি ছগিরা)।
নিকটাত্মীয়ের সাথে সদাচরণ :
সদাচরণের ক্ষেত্রে আল্লাহপাক নিজেই অগ্রাধিকার ঠিক করে দিয়েছেন। নিকটাত্মীয় বলতে রক্ত সম্পর্ক ও বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা সম্পর্ককে বোঝায়। ভাই-বোন, ভাইপো-ভাগ্নে-ভাগ্নি বা শ্বশুরকূলের লোকজনের সাথে নানা কারণে সবসময় সম্পর্ক বজায় রাখা কঠিন হয়। তারপরও জান্নাতের প্রত্যাশী একজন ব্যক্তি আত্মীয়-স্বজনের সাথে সর্বদা সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সচেষ্ট থাকবে। হাদিসের ভাষায় বলা হয়েছে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক এমন নয় যে, কেহ ভালো ব্যবহার করলে তুমিও তার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। বরং কেহ তোমার সাথে মন্দ ব্যবহার করলে তার সাথে উত্তম ব্যবহার করার নামই আত্মীয়তার হক।
এতিম-মিসকিনের সাথে সদাচরণ :
এরা সমাজের অসহায় ব্যক্তি। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের সাথে সদাচরণ করা। হাদিসের কিতাবসমূহে এতিম-মিসকিনের প্রসঙ্গে হাজারো উক্তি রয়েছে। আদর করে এতিমের মাথায় যে হাত বুলাবে তার হাতের নিচে যতো চুল থাকবে তার আমলনামায় তত নেকি লেখা হবে। যে ঘরে এতিম রয়েছে তার সাথে যদি সদাচরণ করা হয় তাহলে কিয়ামতের দিন আমি ও সে একত্রিত উত্থিত হবো। আল্লাহপাক সূরা মাউনে এতিমকে ধাক্কা দেয়া (অপমান করা) ও মিসকিনের খাবার না দেয়াকে পরকালে অবিশ্বাসের সাথে তুলনা করেছেন। এতিম- মিসকিনদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ যদি কেহ খেয়ানত করে তাহলে সে মূলত আগুনই ভক্ষণ করে।
আত্মীয় প্রতিবেশী ও অনাত্মীয় প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ :
প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে রসুলুল্লাহ সা. বারবার সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, মুমিন নয়, মুমিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। যে পেটপুরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে সে মুমিন নয়। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, জিবরাইল আ. প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে আমাকে এতো সতর্ক করছিলেন যে, মনে হতো প্রতিবেশীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার করা হবে। এখানে আত্মীয়-অনাত্মীয় পৃথকভাবে বলা হয়েছে এবং আগে আত্মীয়ের কথা বলাতে বোঝা যায় আত্মীয়ের মর্যাদা সর্বদাই অগ্রগামী।
পার্শ্বসাথীর সাথে সদাচরণ :
আস্সাহিবি বিজজানবে অর্থ অন্তরঙ্গ বন্ধু হতে পারে আবার চলার পথে সঙ্গীসাথি হতে পারে। একজন বিশ্বাসী বান্দা সবসময়ই তার নিজ অপেক্ষা অপরকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। লিফটে উঠতে গিয়ে বা দোকানে কেনাকাটা করতে গিয়ে বা বাসে বসতে গিয়ে দেখা যাবে কারো খুব বেশি প্রয়োজন, এমন ক্ষেত্রে কোনো ভাই বা বোনকে অগ্রাধিকার দেয়া সৌজন্য ও ঈমানদারসুলভ আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ।
মুসাফিরের সাথে সদাচরণ :
নিজ বাড়িতে একজন ব্যক্তি খুব সচ্ছল ও কোনো সমস্যা না থাকলেও সফরে নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এমতাবস্থায় তার সাথে সদাচরণের জোর তাগিদ দিয়েছেন আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.। যাদের দোয়া কবুলের গ্যারান্টি রয়েছে তন্মধ্যে মুসাফিরের দোয়া অন্যতম। একজন মুসাফির কারো বাড়িতে তিনদিন অবস্থানের অধিকার রাখেন।
মালিকাধাধীন বাঁদী ও গোলামদের প্রতি সদাচরণ :
মালিকানাধীন বাঁদী অর্থ যুদ্ধলব্দ বা ক্রীত দাসদাসী যা বর্তমানে বিলুপ্ত। গোলাম বা অধীনস্থদের সাথে সদাচরণের জোর তাগিদ আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা. করেছেন। তুমি যা খাবে তাদেরকে তাই খেতে দিবে, যা পরিধান করবে তাদেরকে তাই দিবে। তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে অধীনস্থদের নিকট উত্তম। রসুলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকালের সময় নামাজ ও দাসদাসির কথা তাঁর জবান থেকে বারবার বেরিয়ে আসছিল।
আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের সাথে সদাচরণের জোর তাগিদ দেয়ার সাথে সাথে বলেছেন, তিনি সেসব লোককে অপছন্দ করেন যারা দাম্ভিক ও অহঙ্কারী এবং যারা বড়াই করে। সাধারণত দাম্ভিক ও অহঙ্কারী ব্যক্তিবর্গই মানুষকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। এরা সমাজে নিজেদের বড়ো মনে করলেও আসলে বড়ো নয়। এরা মানুষের কাছে সাধারণত ঘৃণা ও নিন্দার পাত্র।
মানুষের দ্বারা মানুষ নির্যাতিত হবে, অপমানিত হবে, লঞ্ছিত হবে- সেটি আল্লাহপাক কোনভাবেই সহ্য করেন না। সূরা হুমাযায় আল্লাহপাক বলেছেন, নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনাসামনি গালাগাল করে ও পেছনে দোষ প্রচার করে। তাদের পরিণতি হুতামা। আর সেটা হলো দাউ দাউ করে জ্বলা আগুন, প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত ও উৎক্ষীপ্ত। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের পরস্পর সদাচরণের তৌফিক দান করুন। ৩০.১০.২০২৪
Comments
Post a Comment