Skip to main content

আমরা তোমারই গোলামি করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই

 কুরআনের পাঠ

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম 

‘আমরা তোমারই গোলামি করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই’- সুরা ফাতেহা ৫।

এই আয়াতটি সুরাতুল ফাতেহার ৫ম আয়াত। ফাতেহা শব্দের অর্থ ভূমিকা বা মুখবন্ধ। এই সুরা দিয়ে কুরআন মজিদ শুরু হয়েছে। তাই এর নাম ফাতেহা। রসুলুল্লাহ সা.-এর উপর পূর্ণাঙ্গ সুরা হিসেবে সুরা ফাতেহা প্রথম অবতীর্ণ। আল্লাহপাক বলেছেন, ‘তোমাকে সাতটি আয়াত দেয়া হয়েছে যা বারবার আবৃতিযোগ্য’- সুরা আল হিজর ৮৭। সুরা ফাতেহা ছাড়া নামাজ নেই।

প্রতি নামাজে ও প্রতি রাকাতে আল্লাহপাক তাঁর বান্দার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করছেন, ‘আমরা তোমারই গোলামি করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই’। না’বুদু শব্দটি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ এই নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে যেমন তোমার বন্দেগি করছি তেমনি নামাজের বাইরেও তোমারই বন্দেগি করবো। আল্লাহপাকের মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হলো তাঁর ইবাদত করা (নিশ্চয়ই জিন ও মানুষকে আমি সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদত করার জন্য- সুরা যারিয়াত ৫৬)।

এই ইবাদত বেছে বেছে কিছু আনুষ্ঠানিক আচার- অনুষ্ঠানের নাম নয়। বরং চেতনা লাভের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় সর্বক্ষণ আল্লাহর হুকুম পালনের নামই ইবাদত। আমরা যে কোনো কাজ করতে গেলে দু’টি বিধান আমাদের সামনে হাজির হয়- এক. আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সা. বিধান এবং দ্বিতীয়ত বাপদাদা থেকে চলে আসা নিয়মনীতি বা নিজের প্রবৃত্তি বা মানুষের রচিত নিয়ম-কানুন। সবকিছু উপেক্ষা করে আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর নিয়ম পালনের নামই হলো ইবাদত বা গোলামি করা এবং এই বিধানের কোনো বাছবিচার করার এখতিয়ার গোলামের নেই। তার একটিই কথা ‘শুনলাম ও মেনে নিলাম’- সুরা বাকারা ২৮৫। 

কর্মব্যস্ত মানুষ, শয়তানের প্ররোচনায় তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলে যায়। আল্লাহর ইবাদত করার জন্যই তার সৃষ্টি, সেটি বারবার স্মরণ করে দেয়া এবং তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণের লক্ষ্যে দিনের সূচনায় তাকে মসজিদে হাজিরা দিতে হয় এবং ব্যস্ততার মাঝে জোহর, আসর, মাগরিব ও ঘুমানোর পূর্বে এশার জামাতে হাজির হয়ে তার দেয়া প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করতে হয়। নামাজ বারবার আল্লাহর গোলামির কথা স্মরণ করে দেয় বিধায় নামাজকে বলা হয় জিকির। আল্লাহর কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি নামাজ থেকে বের হয়ে এসে যদি ভঙ্গ করা হয় তাহলে বুঝতে হবে সে আর মুমিনও নয়, মুসলিমও নয় বরং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী একজন নিরেট মুনাফিক।

আল্লাহ তায়ালা যে গোলামির কথা বলেছেন তা সর্বক্ষণ এবং আল্লাহর স্মরণও সর্বক্ষণ। আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হলেই মানুষের দ্বারা নাফরমানি হয়। তাই আল্লাহ বলেছেন, ‘নামাজান্তে তোমরা রুজির জন্য বেরিয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো ও তাঁকে বেশি বেশি করে স্মরণ করো’- সুরা জুমা ১০। আল্লাহর এই স্মরণ কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নয়, সর্বদা এবং সর্ববস্থায় ‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করে--’- আলে ইমরান ১৯১। ইবাদত সম্পর্কে ভুল ধারণার ফলে আমাদের এই নৈতিক অধপতন এবং সীমাহীন দুর্নীতি ও অন্যায়-অবিচার। আপনি অফিসে কাজ করছেন, সেখানে আপনার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার নামও ইবাদত। আপনার ডেস্কে প্রচুর কাজ এবং চারপাশে অনেক লোক দণ্ডায়মান। কাজ রেখে নামাজ পড়ার কথা বলে বারোটার সময় ডেস্ক থেকে চলে যাওয়ার মধ্যে কোনো পরহেজগারি নেই। লাঞ্চবিরতি ও নামাজের জন্য কর্তৃপক্ষের দেয়া নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট বেশি ভোগ করার অধিকার আপনার নেই। যদি করেন সেটি হবে খেয়ানত।

আমাদের অফিস-আদালতে সীমাহীন ঘুষ-দুর্নীতি। ঘুষ-দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কখনই মুমিন ও মুসলিম হতে পারে না। রসুলুল্লাহ সা. স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ঘুষ দানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ই জাহান্নামি। ঘুষ দাবি করার তো প্রশ্নই উঠে না; কোনো কাজ যদি দশ মিনিটে হওয়া সম্ভব তার জন্য আধা ঘন্টা লাগানো জুলুম। আবার ব্যবসায়ীর ইবাদত ও আল্লাহর স্মরণ হলো সে ওজনে কম দেবে না, উৎকৃষ্ট জিনিসের সাথে মন্দটি মিশিয়ে দেবে না অর্থাৎ কোনো ধরনের ধোকা-প্রতারণার আশ্রয় নেবে না। এমনটি সম্ভব হলে তখন হবে আল্লাহর স্মরণ এবং এরই নাম ইবাদত। হালাল উপার্জন শ্রেষ্ঠতম ইবাদত। অবৈধ উপার্জনে গঠিত শরীর জাহান্নামের লাকড়ি বৈ আর কিছু নয়। আমরা নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বারবার যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করছি তার সার কথা হলো আমরা সর্বদা তাঁর হুকুম মেনে চলবো এবং কখনই তাঁর নাফরমানি করবো না।

আয়াতের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, ‘আমরা কেবল তোমারই কাছে সাহায্য চাই’। আমাদের শির আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে নত হয় না এবং সাহায্যের জন্য এই হাত কারো কাছে প্রসারিত হয় না। প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে ওয়াদা করছি এবং বিশ্বাস করি, কারো কোনো ক্ষমতা নেই। তাই কোনো দেব-দেবি, মাজার, পীর সাহেব বা নেতা-নেত্রী কারো কাছে ধর্ণা দিতে আমরা রাজি নয়। রসুলুল্লাহ সা. শিখিয়েছেন, আমাদের সকল প্রয়োজন কেবল আল্লাহরই কাছে পেশ করতে। তাঁর নিজের আমল ছিল, সকল বিপদাপদ এবং চাওয়া- পাওয়ার প্রশ্নে তিনি নামাজে দণ্ডায়মান হয়ে যেতেন। আল্লাহর কাছে চাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ নিজেই শিখিয়েছেন। আবার সুরা বাকারা ১৮৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘যে ডাকে আমি তার ডাক শুনি’। এখন প্রশ্ন, আল্লাহ কি তাঁর বান্দার সাথে মিথ্যা বলতে পারেন? সবাই একবাক্যে বলবে, অসম্ভব, কক্ষণই আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন না। তাহলে এতো দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অভিযোগের মধ্যে আমরা কেন দিনাতিপাত করছি? হয়তো আল্লাহর পরীক্ষা নয়তো তাঁর শাস্তির সম্মুখীন আমরা।

বান্দার সকল চাওয়ার প্রতিদান আল্লাহ অবশ্যই দেবেন। এটি তাঁর প্রতিশ্রুতি। আমাদের সুস্থতা, রিজিক, হেদায়াত সবই আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। দুনিয়ায় দেয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহপাকের একটি নিয়ম রয়েছে। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি এবং আল্লাহর ক্ষমতা- এখতিয়ার ও গুণাবলির এক অতি ক্ষুদ্র অংশ মানুষকে তিনি দান করেছেন। এজন্যই হাদিসে বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও, আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হও। আল্লাহপাক প্রদত্ত গুণ ও ক্ষমতার কারণে মানুষ তার চেষ্টা-প্রচেষ্টায় অনেক কিছু অর্জন করে এবং সেটি করে আল্লাহরই দেয়া শক্তি বলে। তাই রিজিক বা সুস্থতা সবই বান্দার চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও আল্লাহর মঞ্জুরির উপর নির্ভর করে। ‘নামাজ সমাপনান্তে রুজির জন্য বেরিয়ে পড়ো’- হ্যাঁ বেরিয়ে না পড়লেও আল্লাহ তাঁর বান্দার রুজির ব্যবস্থা করতে পারেন। শুধু মানুষ কেন? বিচরণশীল সকল প্রাণিরই রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহ গ্রহণ করেছেন। ‘কতো জীব-জানোয়ারই না এমন আছে যারা তাদের রিজিক বহন করে চলে না; আল্লাহই তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করেন, কাজেই তোমাদের রিজিকও তিনিই দান করবেন, তিনি সবকিছু শুনেন ও সবকিছু জানেন।’- সুরা আনকাবুত ৬০। 

‘আমরা তোমারই কাছে সাহায্য চাই’- হ্যাঁ, আমরা শুধু চাওয়ার মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখবো না, আমরা আমাদের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করবো এবং আমাদের চেষ্টা করাটা আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায়। চেষ্টা করে সফল হওয়াটা একান্তভাবে আল্লাহর অনুগ্রহ। মানুষের কাছে চাওয়াটা আল্লাহ ও রসুল সা. পছন্দ করেন না। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘উপরের হাত নিচের হাত অপেক্ষা উত্তম’, আবার বলেছেন, ‘যার ঘরে একদিনের খাবার আছে তার পক্ষে ভিক্ষা করা অবৈধ’। ওমর রা. বলেছেন, যে কাজ করে না তার খাওয়া অন্যায়। মুসলমান এক কর্মতৎপর জাতি। আলোস্য কী, তার জানা নেই। আল্লাহর সুন্নাত হলো, তাঁর যে বান্দা চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় এবং যে যতো অগ্রগামী সে ততো সফল হন। তাই আমরা চেষ্টা-প্রচেষ্টার পাশাপাশি কাতরভাবে চাইবো এবং এই চাওয়াটা বান্দাসুলভ আচরণ। কোনো কারণে আল্লাহ তাঁর বান্দার চাওয়া তাৎক্ষণিক পূরণ না করলে জমা করে রাখেন এবং এ দুনিয়ায় না পেলে আখেরাতে কড়ায়গণ্ডায় পূরণ করবেন। বান্দা তা পেয়ে মহাখুশি হয়ে যাবে।

এই আয়াতে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, আমরা আল্লাহর গোলামি করবো এবং কেবল তাঁরই কাছে চাইবো। মানুষের কাছে চাইলে মানুষ বিরক্ত হন এবং মানুষের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু আল্লাহর ভাণ্ডার অফুরন্তু এবং বান্দাকে দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁকে কারো কাছে জবাবদিহিও করতে হয় না। আল্লাহ নিজে উদার এবং তিনি দিতে চান, তাই বান্দার উচিৎ কাতরভাবে তার রবের কাছে চাওয়া। বান্দার জন্য তা উপযুক্ত হবে কি না সেটি অবশ্যই আল্লাহ দেখবেন। চাওয়াটা বান্দার দায়িত্ব এবং বারবার চাইতে হবে আর দেয়ার বিষয়টি আল্লাহর। কাতরভাবে এবং বড় আশা নিয়ে আমরা আল্লাহর কাছে চাইবো। আল্লাহপাক একনিষ্ঠভাবে তাঁর গোলামি করার এবং দুনিয়ার সবকিছু থেকে মুখাপেক্ষিহীন হয়ে কেবল আল্লাহরই মুখাপেক্ষী হওয়ার তৌফিক দান করেন। ০১.০৮.২০২২।

Comments