Skip to main content

অনাড়ম্বর অথচ এক অনন্য বিয়ে


বিয়ে মানে জমকালো অনুষ্ঠান, হৈ-হুল্লোড়, বাহারি পোশাকে নগ্নতার প্রকাশ, আলোক-সজ্জা, গান- বাজনা, গায়ে হলুদ, মান-অভিমান, মোহরানা নিয়ে দরকষাকষি, যৌতুক, খানাপিনায় অপচয়, আরো কতো কী? না, এতো সব আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে ইসলামে বিয়েও এক ইবাদত। জরুরি অর্থাৎ যে সব কাজে বিলম্ব করতে নেই সেসব কাজের মধ্যে বিয়ে অন্যতম এবং আমরা তা জেনেছি প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা. থেকে। বলা যায় ছেলে-মেয়ে বালেগ হলে দ্রুত বিয়ে দেয়ার জন্য রসুলুল্লাহ সা. অভিভাবককে তাগিদই দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে ছেলে-মেয়ের চরিত্র সুরক্ষা পাওয়ার কথা বলেছেন। আর বিয়ে করতে না পারলে তাকে রোজা রাখতে বলেছেন।

বিয়েতে আনন্দ-স্ফুর্তি করতে নেই এমনটি নয়। ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম, মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি যা দাবি করে ইসলাম তা অস্বীকার করে না। বিনোদন ও আনন্দ- স্ফুর্তি সকল ক্ষেত্রে ইসলাম একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। পর্দাহীনতা ও অপচয় না করার শর্তে এবং ইসলামের সুনির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে দেশাচার ও স্বভাব-প্রকৃতির দাবি মেটানো বৈধ। ইসলামে বিয়েকে সহজ করা হয়েছে এবং জেনা-ব্যাভিচারকে কঠিন করে দেয়া হয়েছে। দুজ’ন বয়োপ্রাপ্ত নর ও নারী দু’জন সাক্ষীর মোকাবেলায় পরস্পর ইজাব কবুল করলে ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়, অবশ্য সেটা হতে হবে প্রকাশ্যে অর্থাৎ মহল্লাবাসী জানবে যে এই নর ও নারীর মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এটা ন্যূনতম শর্ত। পরিবারকে সম্পৃক্ত করে ও পারিবারিক আয়োজনের মাধ্যমে অভিভাবক তার কন্যা বা বোনকে পাত্রের হাতে তুলে দেয়ার মধ্যে রয়েছে সৌন্দর্য এবং এটিই কাম্য। বিয়ে-সাদির ব্যাপারে ছেলে-মেয়ের মতামতই অগ্রাধিকারযোগ্য।

বিবাহ বহির্ভূত একজন পুরুষ ও নারীর দেখা-সাক্ষাত, কথাবার্তা বলা এবং মোবাইলে আলাপচারিতার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে পর্দা লঙ্ঘিত হয় যেটা ইসলামে ফরজ করা হয়েছে। অবশ্য বিয়ের উদ্দেশ্যে পরস্পরের দেখা-সাক্ষাত এবং কথাবার্তা বলার সুযোগ রয়েছে। স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা. নিজেই বলেছেন, কেউ তাঁকে কোনো ছেলে বা মেয়ে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, তুমি কি তাকে দেখেছ? না দেখলে আগে দেখে নেও। এই দেখা-সাক্ষাত ও কথাবার্তা বলা অবশ্যই হতে হবে পর্দা মেনে। ছেলে-মেয়ের একে অপরকে পছন্দ করা খুবই স্বাভাবিক এবং বিষয়টি বিলম্ব না করে অভিভাবকের দৃষ্টিতে আনা উচিত। নিজেদের চাওয়া-পাওয়া শতভাগ পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। এর মধ্যে যতটা সম্ভব ততটা মেনে জীবনসঙ্গী/সঙ্গিনী বেছে নেয়া উচিত। বিয়ে-সাদির ব্যাপারে রসুলুল্লাহ সা. ধার্মিকতাকে অগ্রাধিকার দিতে বলেছেন এবং সাথে সাথে এটাও বলেছেন যে, এতে তোমার ভবিষ্যৎ শুভ হবে। মানুষ দেখে পাত্র/পাত্রীর বংশমর্যাদা, অর্থবৃত্ত ও সৌন্দর্য আর আল্লাহর রসুল সা. তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিতে বলেছেন।

গতকাল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল একটি বিয়ে অনুষ্ঠান এবং সেটা নিয়ে কিছু আলোচনা করবো ইনশা-আল্লাহ। আমরা দুই ভায়রা পাশাপাশি বাস করি। ভায়রার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় জামাই ইঞ্জিনিয়ার, চট্টগ্রামে একটি ভালো কোম্পানিতে চাকরি করে। ছেলেও ইঞ্জিনিয়ার এবং একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। গতকাল তাঁর ছোট মেয়ের (রুয়েটে অধ্যয়ন করছে) বিয়ে সম্পন্ন হলো মেয়ের ভাইয়ের সহপাঠী ও একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। ছেলেটি অত্যন্ত মেধাবী ও ডিপার্টমেন্টে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। চাকরি জীবনেও সাফল্য দেখাচ্ছে। দীর্ঘ নয় বছরের তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কিন্তু গতকাল যাদের বিয়ে সুসম্পন্ন হলো তারা পরস্পরকে ইতোপূর্বে কখনো দেখেনি বা তাদের মাঝে কোনো কথাবার্তাও হয়নি। কিন্তু তারা পরিবার সম্পর্কে জানতো এবং এটাও জানতো যে পাত্রী রুয়েটে অধ্যয়ন করছে ও পর্দানশীন।

বিয়ে-সাদির ব্যাপারে পারিবারিকভাবে কিছু কথাবার্তা হলো এবং আমি নিজেও সম্পৃক্ত ছিলাম। ছেলের খালা ও বোন ভিডিও কলে মেয়েকে দেখেন ও কথাবার্তা বলেন। উভয় পরিবার সম্মত হলে ছেলে-মেয়ে পরস্পরকে দেখানোর সিদ্ধান্ত হয় এবং সেটি গতকাল হলো। ছেলের সাথে তার বাবা-মা, খালা-খালু, মামাসহ নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজন এসেছিলেন। তাদের অভিভাবক হিসেবে ছেলের খালু খুলনা মহানগরীর আমির সাহেব উপস্থিত ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে উভয় পরিবার নিজেদেরকে ধন্য মনে করেন। আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানিতে উভয় পরিবারই পরিপূর্ণ ইসলামি পরিবার এবং ব্যবহারিক জীবনে ইসলাম মেনে চলা পরিবার। নামাজ-রোজার মতো বিয়ে-সাদির ক্ষেত্রেও আংশিক নয় পরিপূর্ণ ইসলাম অনুসরণকারী পরিবার। ছেলেপক্ষ দুপুর বারোটার দিকে এখানে আসেন। আমরা অভিভাবক পর্যায়ে প্রথমে আলোচনা করি এবং ছেলে ও মেয়ের পরিবার সম্পর্কে (পিতৃকূল ও মাতৃকূল) বিস্তারিত আলোচনা করা হয় এবং তারপর ছেলে-মেয়ের পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমে ছেলে ও তার মা-খালারা দেখা-সাক্ষাত করেন এবং পরবর্তীতে ছেলে ও মেয়েকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হয়।

ছেলে ও মেয়ে বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি দিলে অভিভাবক পর্যায়ে আমরা আবার বসে সিদ্ধান্ত নেই যে আজই বিয়ে সুসম্পন্ন হবে। দুই লক্ষ টাকা মোহরানায় এবং ৫৫ হাজার টাকা নগদে এশার পরে বিয়ে রেজিস্ট্রি ও পড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। উভয় পরিবারকে কিছু কেনাকাটা এবং ঢাকায় অবস্থানরত নিকটতম আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দানের সুযোগ দেয়া হয়। এশার পরে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় এবং মেয়ের বাবা উকিল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কাজি সাহেব খুতবা দেন (উনি একজন ভালো মানের আলেম) এবং খুলনা মহানগরীর আমির ও আমার পক্ষ থেকে নবদম্পতির অব্যাহত সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা হয়।

আমার দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ ইসলামি শরিয়া মোতাবেক বিয়েটি সম্পন্ন হয়েছে। বিয়ে কেবল দুজন নর ও নারীর মধ্যকার সম্পর্ক নয়। মূলত ছেলে-মেয়ের বিয়ের মাধ্যমে দু’টি পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। শ্বশুর- শাশুড়ি, ননদ-দেবর, শ্যালক-শ্যালিকা, বেয়াই-বেয়াইন নানাবিধ সম্পর্ক। আত্মীয়তার বন্ধনকে ইসলাম খুব গুরুত্ব প্রদান করে। আত্মীয় দ্বিবিধ- এক. রক্তসম্পর্কীয়, দুই. বৈবাহিক সম্পর্ক। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না। এই বিয়েতে কোনো কিছু নিয়ে সামান্যতম কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে সুসম্পন্ন হয়েছে। আল্লাহপাক এই বিয়েতে কল্যাণ দান করুন। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখ-শান্তি ও আনন্দে পরিপূর্ণ করে দিন এবং দু’টি পরিবারের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি আজীবন বজায় রাখুন। আল্লাহপাক নবদম্পতিকে আজীবন ইসলামের উপর অবিচল রাখুন। আমিন। ২৮.০৮.২০২২।

Comments