Skip to main content

রাজনীতি হোক অহিংস

 রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যতো নিয়ম-কানুনই থাকুক না কেন গণতন্ত্রই সর্বোত্তম। গণতন্ত্র বলতে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠন ও দেশ পরিচালনা করাকে বোঝাচ্ছি। এ প্রসঙ্গে আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞা প্রণিধানযোগ্য Democracy is a government of the people, by the people and for the people (গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার)। তাঁর আরো উক্তি, ‘ব্যালট বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী’ এবং ‘নির্বাচন জনগণের, এটা তাদের সিদ্ধান্ত’। জোর-জুলুম করে শাসন করার সুযোগ গণতন্ত্রে নেই। উন্নত বিশ্ব বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকার জনগণ তাদের দেশে শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে বেছে নিয়েছে এবং উন্নয়নের পাশাপাশি সভ্য জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে পরিচিতি লাভ করেছে। সেখানে কাউকে ইরানের শাহ, লিবিয়ার গাদ্দাফি বা ইরাকের সাদ্দামের মতো পরিণতি ভোগ করতে হয় না, আবার ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানের মতো কোনো দেশ ও জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয় না। সেসব দেশে সরকারকে টেনেহেঁচড়ে নামাতে হয় না। ইউরোপ- আমেরিকায় শক্তিশালী সেনাবাহিনী রয়েছে, কখনো শোনা যায় না, জাতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের গ্রহণ করতে হচ্ছে। নির্বাচনে কারচুপি বা ভোট ডাকাতি তাদের কল্পনাতেও নেই। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনাও নেই। কোথাও কোনো কিছু ঘটলে তার বিচার আছে। ফলে উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে মানুষ ছুটছে সেসব দেশে। ইউরোপ-আমেরিকা কেন? পার্শ্ববর্তী ভারতেও স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাহত হয়নি। বহু ভাষাভাষি ও জাতিগোষ্ঠীর বিশাল দেশ টিকে আছে কেবল গণতন্ত্রের কারণে।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ বিশেষ করে মুসলিম দেশসমূহ রাজনীতির অঙ্গনে সকল প্রকার নীতি- নৈতিকতা থেকে দূরে অবস্থানকারী বর্বর দেশ ও জাতিতে পরিণত হয়েছে। ভাবখানা এমন যে, তারা যতখানি রাজনীতি সচেতন ইউরোপ-আমেরিকার ছাত্র- জনতা ততটা নয় বা তারা রাজনীতি বুঝে না। আমাদের রাজনীতি সচেতনতা হলো কীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় বা ক্ষমতা দখল করা যায়। আমাদের রাজনীতির অঙ্গনে সততা ও ন্যায়পরায়ণতা বলতে কিছু নেই। শুধুই ধোঁকা-প্রতারণা ও মিথ্যাচার। অথচ কী দুর্ভাগ্য! আমরা এক বিশ্বাসী জাতি। আল্লাহকে বিশ্বাস করি, পরকালকে বিশ্বাস করি, আবার বেহেশত-দোজখকেও বিশ্বাস করি। আল্লাহপাক আমাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠতম জাতি, তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানব জাতির কল্যাণ সাধনের জন্য, তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে’। কোথায় সেই শ্রেষ্ঠত্ব, কোথাায় কল্যাণ সাধন আবার কোথায় সেই আদেশ দান? আমরা যাদের কাফের- মুশরিক বলে গালি দেই তাদের দান খয়রাতে টিকে আছি এবং আদেশ দান নয় তাদের আদেশানুগত গোলাম।

পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য যে সব মৌলিক মানবীয় গুণের প্রয়োজন তা থেকে আমরা অনেক দূরে। মৌলিক মানবীয় গুণ বলতে আমরা বুঝি সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারি, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন ও মানুষের সঙ্গে সদাচরণ। নবি হওয়ার পূর্ব থেকেই এসব মানবিক গুণে ভূষিত ছিলেন আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.। তাইতো শৈশব থেকে তিনি জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন ও উপাধি লাভ করেছিলেন আল আমিন ও আস সাদিক। তাঁর উম্মত দাবিদাররা অনর্গল মিথ্যা বলে। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আমার উম্মতেরা সব পারে, মিথ্যা বলতে পারে না এবং বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। এই মিথ্যাচার ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে জাতি আজ চরম আস্থার সংকটে ভুগছে। ফলে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না এবং কারো প্রতি কোনো আস্থা নেই। এই চরিত্র নিয়ে মুসলিম দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা এক একজন নিরেট মুনাফিক এবং মুনাফিকের সকল বৈশিষ্ট্য আমাদের চরিত্রে রয়েছে। ফলে দুনিয়ার জীবনে আমরা ভোগ করছি চরম লাঞ্ছনা এবং আখেরাতে রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।

গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো আইনের শাসন, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনের পরে সরকার আর কোনো বিশেষ দলের থাকে না, হয়ে পড়ে জনগণের সরকার। দুর্ভাগ্য, আমরা তা পারিনি। আমরা বিরোধীতা সহ্য করতে প্রস্তুত নই। কয়দিন আগে সরকারি ছাত্র সংগঠনের পরস্পর মারামারির প্রেক্ষিতে পুলিশের লাঠিচার্জে মাননীয় স্বরাষ্টমন্ত্রী তাঁর পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে বললেন, পুলিশের বাড়াবাড়ি হয়েছে। ফলে পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ তার কিছুদিন পূর্বে ভোলায় বিরোধী দলের মিছিলে দু’জন নিহত হলে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য শোনা যায়নি। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পুলিশকে সতর্ক করে দিলেন এবং পাশাপাশি নিজ দলের লোকদের অন্যায়-অপকর্মকে প্রশ্রয় দান করলেন। যার ফলশ্রুতিতে বিরোধী দলের সকল প্রোগ্রামে হামলা করা হচ্ছে এবং পুলিশ দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে।

একটি দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জাতির গর্ব ও অহংকার। সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে আমাদের পাঠ্য ছিল বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন। সেখানে পুলিশ জনগণের বন্ধু, অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে পুলিশকে দেখা হয়। লেখক আব্দুল হাই একজন নারীর গর্ব ও অহংকার এভাবে তুলে ধরেছেন, 'আমার ভাই পুলিশে চাকরি করে'। জার্মানির এক হোটেলে ঢাবির জনৈক অধ্যাপক মারা গেলে জার্মান পুলিশ তদন্ত করে জানায় যে, তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী সন্দেহ পোষণ করলে জার্মান দূতাবাস থেকে বলা হয় 'জার্মান পুলিশ মিথ্যা বলে না'। অভিনন্দন বৃটিশ ও জার্মান পুলিশকে। কিন্তু আমরা কী পারবো? 

আমাদের দেশের পুলিশও পারে, খুব পারে। তাদের পেশাদারিত্ব বজায় রাখার সুযোগ করে দিলেই পারবে। তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার না করলেই সম্ভব। মটিভিশনের জন্য ইসলামই যথেষ্ট। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, দুটি চোখ কখনো জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে না। এক. আল্লাহর ভয়ে যে চোখ থেকে অশ্রু ঝরে দুই. জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে যে চোখ বিনিদ্র রজনী যাপন করে। দ্বিতীয়টি মূলত দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকই বোঝানো হয়েছে। 

রাজনীতির অঙ্গনে এমন বৈরিতা আমরা পছন্দ করি না। আমাদের সামনে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ার উদাহরণ রয়েছে। আমরা চাই না আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে তেমন পরিস্থিতি ঘটুক। আমরা চাই, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা। সমঝোতার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের সামনে পথ চলা দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনই পারে দেশটাকে সঠিক পথে চলার ক্ষেত্র তৈরি করতে। যেহেতু আমাদের পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস নেই, ফলে কেয়াটেকার সরকার ছাড়া উত্তরণের কোনো পথ দেখি না। হিংসা-বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। হিংসা জঘন্য অপরাধ। আল্লাহপাক স্বয়ং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁর কাছে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলেছেন। হিংসুক ব্যক্তি চরম দরিদ্র। তার কোনো নেক আমল অবশিষ্ট থাকে না। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়, তেমনি হিংসা মানুষের সকল নেক আমল নিঃশেষ করে দেয়। আমরা নেলসন মেন্ডেলা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। উদারতা ও প্রশস্ততা এবং প্রতিপক্ষকে ক্ষমার মাধ্যমে তিনি বিশ্বনেতাতে পরিণত হয়েছেন এবং লাভ করেছেন নোবেল পুরস্কার।

পবিত্র কুরআন ও হাদিসে ক্ষমার অসংখ্য কথা রয়েছে। প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করলে ক্ষমাকারীকে পুরস্কৃত করার প্রতিশ্রুতি স্বয়ং আল্লাহপাক দিয়েছেন। কতো পুরস্কার দেবেন তা  আল্লাহই ভালো জানেন। ক্ষমার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন নেলসন মেন্ডেলা, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহিম লিংকন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি- ‘শাস্তির চেয়ে ক্ষমা মহৎ’। তাই আসুন, হিংসা-বিদ্বেষ-প্রতিশোধ স্পৃহা ভুলে গিয়ে আমরা পরস্পরকে ক্ষমা করে এক ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হই। আল্লাহপাক আমাদেরকে তৌফিক দান করুন। আমিন। ৩০.০৮.২০২২

Comments