Skip to main content

জুমা আলোচনা (মসজিদ উত তাকওয়া)

১২.০৮.২০২২

যুবসমাজ জাতির কলব, যুবসমাজ ভালো থাকলে জাতি ভালো থাকবে

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

আজ জুমায় মসজিদ উত তাকওয়া, ধানমন্ডির সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি সাইফুল ইসলাম আল্লাহর হামদ ও রসুলল্লাহ সা.-এর ওপর দরুদ ও সালাম পেশের পর একটি হাদিস উদ্ধৃত করেন, ‘জেনে রেখ! তোমাদের শরীরের মধ্যে এক টুকরো গোশ্তপিণ্ড আছে, যদি তা সংশোধিত হয়, তবে গোটা শরীরই সংশোধিত হয়। আর যদি খারাপ হয়; তবে সমস্ত শরীরই খারাপ হয়ে যায়। মনে রেখ তাহলো কলব বা দিল’- বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত। কলব মূলত চালিকাশক্তি। কলব যদি ঠিক থাকে তাহলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সঠিক পথে চালানো সম্ভব। ওহির জ্ঞানে কলব সমৃদ্ধ হয় এবং তখন সঠিক পথে চলা সম্ভব হয়।

আজ আন্তর্জাতিক যুব দিবস। এ বছর দিবসটির থিম হলো ‘বয়স-নির্বিশেষে সাম্য : সব বয়সীদের জন্য এক বিশ্ব’। ২০০০ সালের ১২ আগস্ট দিবসটি প্রথম উদযাপিত হয়েছিল। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলির সাথে যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করে তাদের অধিকার বুঝে নেয়ার বিষয়ে সচেতন করে তোলা। খতিব মহোদয় বলেন, মানবদেহে কলবের যে অবস্থান জাতীয় জীবনে তেমনি যুব সমাজের অবস্থান। সমাজ পরিবর্তনে যুব সমাজের ভূমিকা অবিশ্বরণীয়। ‘যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার’- উল্লেখ করে খতিব মহোদয় বলেন, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এই যুব সমাজই পারে সকল অন্যায়-অবিচার দূর করে সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে। যুব সমাজের নৈতিক অধপতন ও নানা সামাজিক অপরাধের জড়িত হওয়ার প্রেক্ষিতে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে এর কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করেন।

১. খতিব মহোদয় প্রথমেই উল্লেখ করেন যে, যুব সমাজের নৈতিক অধপতন ও অপরাধের সাথে জড়িত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো মাদকের প্রসার। বিভিন্ন পুলিশী তদন্তে দেখা যায় ধর্ষণ ও খুনের মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডের সাথে মাদকের যোগসূত্র রয়েছে। ঐশির মতো মেয়ের পক্ষে পিতা-মাতাকে হত্যা করার মতো নৃশংসতার সাথে মাদকের যোগসূত্র আমরা লক্ষ করেছি। কিশোর অপরাধ এবং বিভিন্ন কিশোর গ্যাং গড়ে উঠার ক্ষেত্রেও মাদককে দায়ী করা হয়। বিভিন্ন তদন্তে মাদকের সম্পৃক্ততা থাকলেও আমাদের দেশে মদের লাইসেন্স দেয়া হয়। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, সকল নেশার দ্রব্য অবৈধ-হারাম। আমাদের এই যুব সমাজকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই মাদককে নির্মূল করতে হবে। এটি কেবল আইন দিয়ে সম্ভব নয়। আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি নৈতিকতা অর্থাৎ মানুষের মধ্যে আল্লাহ ও আখেরাতের ভয় জাগ্রত করতে হবে।

২. অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার প্রসার। বর্তমানে নগ্নতা ও পর্দাহীনতা সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনার পেছনে বড় কারণ অশ্লীলতা ও পর্দাহীনতা। পর্দা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য। আল্লাহপাক পর্দা ফরজ করেছেন এবং তিনি একে নারীর নিরাপত্তার গ্যারান্টি বলেছেন। পর্দা যারা মেনে চলে তাদের প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এতে করে তাদের চেনা সহজ হবে এবং তাদের কোনোরকম উত্তক্ত করা হবে না’ (সুরা আহজাব ৫৯)- পর্দানশিন নারী মানেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে, তারা সহজলভ্য না, তাদের প্রতি চোখ তুলে তাকানো বা উত্তক্ত করার ক্ষেত্রে যে কাউকে চিন্তা করতে হয়। খতিব মহোদয় দুঃখ করে বলেন, পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে বোঝার উপায় নেই যে ব্যক্তিটি ছেলে না মেয়ে। অথচ রসুলুল্লাহ সা. ছেলেকে মেয়ের পোশাক এবং মেয়েকে ছেলের পোশাকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়াকে লানত করেছেন। আঁটসাট প্যান্ট ও গেঞ্জি গায়ে রাস্তায় চলাফেরা করা কোনো সভ্য বা মুসলিম নারীর পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। পর্দাহীন নারী-পুরুষই কেবল জাহান্নামে যাবে না, তাদের অভিভাবককেও (হাদিসের ভাষায় দায়ূস) জাহান্নামে যেতে হবে। শৈশব থেকেই সন্তানকে পর্দা মানার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য খতিব মহোদয় তাঁর মুসল্লিদের প্রতি অনুরোধ জানান।  

৩. নৈতিক শিক্ষার অভাব। মানুষের মাঝে নৈতিকতার উদ্ভব ঘটে ধর্মীয় শিক্ষা ও উপলব্ধি থেকে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা ধর্মকে বাদ দিয়ে উদ্বুদ্ধকরণের (Motivation) নানা কর্মসূচি গ্রহণ করি। অথচ মানবসমাজের জন্য যা কিছু ক্ষতিকর তা সবই ইসলামে নিষিদ্ধ এবং কল্যাণকর যা কিছু তা সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে রয়েছে প্রভূত সওয়াব। খতিব মহোদয় বলেন, পিতা-মাতা হিসেবে আমরা সবাই কল্যাণ চাই এবং সন্তানকে ভালো প্রতিষ্ঠানে দেয়া ও তার ভালো রেজাল্টের জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালাতে কোনো দোষ নেই। সবই ঠিক আছে কিন্তু পাশাপাশি দ্বীন শিক্ষার ব্যাপারে আমরা একেবারেই গাফেল। শৈশব থেকে দ্বীনের সাথে পরিচয় থাকলে এসব ছেলে-মেয়েদের ধ্বংস হয়ে যাওয়াকে রোধ করা সম্ভব। কুরআনের জ্ঞান শৈশবে পেলে এবং নামাজে অভ্যস্ত হলে এই সন্তান বাবা-মার অনুগত হয়ে চলতে পারে এবং অশ্লীলতার পথ পরিহার করতে পারে। নামাজ সম্পর্কে আল্লাহর নিজের উক্তি, নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে।

৪. ভালো বন্ধু নির্বাচনের অভাব। আমাদের ছেলে- মেয়েরা কাদের সাথে মেশে এবং কারা তার বন্ধু-এসব নিয়ে অধিকাংশ বাবা-মা উদাসীন। প্রথমত বাবা- মাকেই সন্তানের বন্ধু হতে হবে এবং তাদেরকে প্রচুর সময় দিতে হবে। চাকরিজীবী বাবা-মার জন্য খুবই কঠিন। তদুপরি আমাদের সবকিছু সন্তানের জন্য। আমাদের বাড়ি-গাড়ি, ধন-সম্পদ সবই হলো কিন্তু সন্তান যদি মনের মতো না হয়ে নেশাগ্রস্ত বা উচ্ছৃঙ্খল হয় তাহলে আমাদের সকল অর্জন ধ্বংস হয়ে যাবে। শৈশবে সন্তানকে আদর করতে হবে, তাদের সাথে খেতে হবে, ঘুরতে হবে, খেলতে হবে এককথায় আপনার সময়ের একটু অংশ সন্তানদের দিতে হবে।

৫. ভালো বই পাঠে অভ্যস্ত করা। কুরআন-হাদিসের পাশাপাশি চরিত্রগঠনমূলক বইপাঠে সন্তানদের উৎসাহ দিতে হবে। রসুলুল্লাহ সা. ও সাহাবায়ে কেরামসহ মনীষীদের জীবনীভিত্তিক বই-পুস্তক তাদের কিনে দিতে হবে। ইসলামের আলোকে শিশু-কিশোরদের চরিত্রগঠনমূলক (উদ্বুদ্ধকরণ) প্রচুর বই বাজারে এখন পাওয়া যায়। অভিভাবকদের এসব বিষয়ে ভাবতে হবে। খতিব মহোদয় বলেন, আগামী রবিউল আউয়াল মাসে রসুলুল্লাহ সা. জীবনের উপর রচিত একটি উন্নতমানের বই দশ থেকে ষোল বছর বয়সী কিশোরদের হাতে তুলে দেয়ার একটি পরিকল্পনা ‘মসজিদ উত তাকওয়া সোসাইটি’ এবং তাঁর একটি প্রতিষ্ঠান ‘আলোকিত জ্ঞানী’ গ্রহণ করেছে। তাতে দশ হাজার যুবকের কাছে বইটি পৌঁছানোর খেয়াল তাঁদের রয়েছে। 

৬. তথ্য-প্রযুক্তির প্রভাব। তথ্য-প্রযুক্তি মানুষের হাতের নাগালে। এর ভালো ও মন্দ দু’টি দিকই রয়েছে। আমাদের যুবসমাজ কোনটি গ্রহণ করে সেটিই প্রশ্ন। মানুষের ঘরে ঘরে, হাতে হাতে এন্ড্রয়েড ফোন। ছোট শিশু থেকে সব বয়সী মানুষ এন্ড্রয়েড ফোনে আসক্ত। যুবসমাজের চরিত্রবিধ্বংসী নানা উপকরণ রয়েছে এই ফোনে। নাটক, সিনেমা, গল্প সবকিছুকে যুবচরিত্র ধ্বংস কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আপনারা সতর্ক না হলে আপনাদের সন্তান ধ্বংস হওয়া অর্থ আপনারা ধ্বংস হয়ে যাবেন। আপনার ছোট্ট শিশুকে ফোন ধরিয়ে না দিয়ে তার সাথে খেলেন ও সময় দিন। বাচ্চারা আনন্দ খুঁজে। তারা খেলতে ও ঘুরতে পছন্দ করে। কিশোর ছেলেটার ল্যাপটব ও মোবাইল মাঝে-মধ্যে চেক করুন। বাবা-মার এ অধিকার রয়েছে। ভালো কিছু তাদেরকে দিতে হবে। এখন চরিত্রগঠনমূলক নানা প্রোগ্রাম হয়ে থাকে। তাদের সাথে করে দেখেন। হামদ-নাতের প্রোগ্রামেও তাদেরকে শরীক করান। তাদের সাথে রূঢ় আচরণ করবেন না। বন্ধুর মতো আচরণ করুন।

৭. সন্তান বয়োপ্রাপ্ত হলে বিয়ের ব্যবস্থা করুন। মানুষের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ প্রকৃতিগত। সন্তান বিয়ের উপযুক্ত এবং বিয়ে করতে চায় এমতাবস্থায় অভিভাবক হিসেবে আপনার বাধাপ্রদানের ফলে সন্তানের গুনাহের সাথে আপনিও সেই গুনাহের অংশীদার হয়ে পড়বেন। তাই অহেতুক বিলম্ব না করে এই জাহিলিয়াতের সয়লাবে ঈমান নিয়ে বাঁচার স্বার্থে সন্তানকে বিয়ে দিয়ে দিন। তাহলে সন্তানের চরিত্র সংরক্ষিত হবে ইনশা-আল্লাহ।

খতিব মহোদয় বলেন, সন্তান বাবা-মার বড় আদরের ধন। আপনাদের সকল কর্মপ্রচেষ্টা সন্তানকে কেন্দ্র করে। তাই সন্তান যাতে আপনার চোখকে শীতল করতে পারে তজ্জন্য কোনো অবহেলা না করে তার প্রতি যত্নবান হন এবং তাকে একজন আদর্শবান হিসেবে গড়ে তুলুন। আল্লাহপাক সকল বাবা-মাকে সন্তান দ্বারা তাদের চোখকে শীতল করে দিন। আমিন। সংক্ষেপিত এবং কিছুটা পরিমার্জিত। 

Comments