Skip to main content

মুহররম আল্লাহর মাস এবং আশুরার রোজা বিগত বছরের গুনাহের কাফ্ফারা

 জুমার খুতবা

০৫.০৮.২০২২


বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম 

মিরপুর কাঁঠালবাগান জামে মসজিদে জুমার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল সা.-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর সুরা তওবা ৩৬ নং আয়াত তেলাওয়াত করেন। আজকে হিজরি বছরের প্রথম মাস এবং প্রথম জুমা। তিনি বলেন, ১৪৪৪ হিজরি আমরা শুরু করলাম। আমাদের রোজা, হজ, ঈদ এবং ইবাদত- বন্দেগি চন্দ্র মাসের সাথে সংশ্লিষ্ট। দুর্ভাগ্য, আমরা চন্দ্র মাসের হিসাব জানি না এবং জানার চেষ্টাও করি না। এমনকি বাংলা ভাষার সন তারিখও আমরা জানি না। ইংরেজিপ্রীতি আমাদের মধ্যে চরমভাবে পেয়ে বসেছে। অন্য ভাষা জানা ও শেখায় কোনো দোষ নেই। কিন্তু নিজের স্বকীয়তা বাদ দিয়ে নয়। একজন মুসলমান হিসেবে হিজরি সনের মাস ও তারিখ সম্পর্কে একটু জানার জন্য তিনি আহবান জানান।

খতিব মহোদয় বলেন, আমাদের সমাজে মুহাররম মনেই কারবালা। কারবালার ঘটনার পূর্বেও মুহাররম ও আশুরা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ইসলামে চারটি মাস বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। সুরা তওবায় ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আসলে যখন আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তখন থেকেই আল্লাহর লিখন ও গণনায় মাসের সংখ্যা বারো চলে আসছে। এর মধ্যে চারটি মাস হারাম। এটিই সঠিক বিধান। কাজেই এ চার মাসে নিজেদের ওপর জুলুম করো না। আর মুশরিকদের সাথে সবাই মিলে লড়াই করো যেমন তারা সবাই মিলে তোমাদের সাথে লড়াই করে এবং জেনে রাখো আল্লাহ মুত্তাকিদের সাথেই আছেন।’ মূলত হজের সফরকে নির্বিঘ্ন করার জন্য প্রাচীন কাল থেকেই জিলকদ, জিলহজ ও মুহাররম এবং ওমরাহের জন্য রজব মাসকে আল্লাহর পক্ষ থেকে হরাম ঘোষিত হয়ে আসছে। এই সময়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সেটি মেনে আসছে।

আশুরা অর্থাৎ ১০ মুহাররম  নানা ঘটনার জন্য বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। ঐদিন হজরত মুসা আ. এবং বনি ইসরাইলরা ফেরাউনের জুলুম-নির্যাতন থেকে বাঁচার লক্ষ্যে মিশর থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ফেরাউনের বাহিনী তাঁদের ধাওয়া করেন। পেছনে ফেরাউনের সৈন্যবাহিনী এবং সম্মুখে লোহিত সাগর; এমতাবস্থায় মুসা আ. আল্লাহপাকের নির্দেশে পানিতে লাঠির আঘাত করলে সেখানে রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। মুসা আ. বনি ইসরাইলদের সাথে করে সাগর পার হয়ে যান এবং সেই পথে ফেরাউন তার সৈন্যবাহিনীসহ নেমে পড়লে সদলবলে ডুবে মরে। তখন থেকে মুসা আ. ও তাঁর অনুসারীরা আশুরার দিনটিকে নাজাত দিবস হিসেবে পালন করে আসছিলেন এবং আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া হিসেবে রোজা পালন করতেন। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, মুসা আ. আমার ভাই এবং রোজা পালনের আমিই বেশি হকদার।

রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার রোজাকে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করতেন। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পরেও তিনি আশুরার রোজা পালন করতেন এবং সাহাবিদেরকে উৎসাহিত করতেন। তিনি বলেছেন, আশুরার রোজা বিগত বছরের গুনাহের কাফফারা। তবে ইহুদিদের সাথে পার্থক্য করার জন্য তিনি আশুরার সাথে আর একটি দিন যোগ করে পালনের জন্য বলেছেন। এবারের আশুরা মঙ্গলবার। খতিব মহোদয় তাঁর মুসল্লিদের সোম ও মঙ্গল কিংবা মঙ্গল ও বুধবার রোজা রাখার কথা বলেন। কয়েকটি আমল নবি মুহাম্মদ সা. বিশেষ গুরুত্বের সাথে পালন করতেন, সাধারণত ছাড়তেন না। তন্মধ্যে আশুরার রোজা, আইয়ামে বীজের রোজা, ফজরের পূর্বে দুই রাকাত সুন্নাত, জিলহজ মাসের প্রথম দশকের রোজা। এ প্রসঙ্গে খতিব মহোদয় উম্মুল মুমিনিন হাফসা (রা.) থেকে হাদিস উদ্ধৃত করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) চারটি আমল কখনো ত্যাগ করতেন না। আমলগুলো হলো—

এক. আশুরার রোজা। দুই. জিলহজ্জের প্রথম দশকের রোজা। তিন. প্রতি মাসের তিন দিন তথা আইয়ামে বিজের রোজা, চার. ফজরের ফরজের আগের দুই রাকাত নামাজ। (নাসায়ি, মিশকাত : ২০৭০)

আশুরা আমাদের সমাজে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে প্রিয়তম নবি সা.-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রা.-এর এই দিনে শাহাদতবরণ। সেদিন ইমাম হোসাইন রা. যুদ্ধের উদ্দেশ্যে কারবালায় গিয়েছিলেন না। কুফাবাসীর আমন্ত্রণে তিনি ৭০ জন আত্মীয়-স্বজন নিয়ে কুফা যাওয়ার পথে ইয়াজিদের বাহিনী কর্তৃক কারবালায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। স্বৈরশাসক ইয়াজিদের পেটুয়া বাহিনী সকল নীতি-নৈতিকতা ও ইসলামের বিধান অমান্য করে ইমাম হোসাইন রা.-এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এই ঘটনায় দুঃখভারাক্রান্ত হন এবং গভীর শ্রদ্ধাভরে ইমাম হোসাইন রা.-কে স্মরণ করেন। ইমাম হোসাইন রা.-এর এই আত্মত্যাগ যুগে যুগে সকল স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রেরণা হয়ে আছে। দুর্ভাগ্য, একশ্রেণির মানুষ আশুরাকে কেন্দ্র করে সীমাহীন বাড়াবাড়ি করে। হায় হোসাইন! হায় হোসাইন! করে বুক চাপড়ানো, শরীরকে রক্তাক্ত করা মোটেই ইসলামসম্মত নয়। কারো মৃত্যুতে ইসলামে তিন দিনের শোক পালনের অনুমতি রয়েছে এবং এই সময়ে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশিরা তাদের খানাপিনার ব্যবস্থা করবে। স্বামীর ইন্তেকালে একজন নারীর শোক পালনের সময় চার মাস দশ দিন। 

ইমাম হোসাইন রা.-এর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নামে যুগ যুগ ধরে মাতম করা ইসলামী শরিয়াহসম্মত নয়। আহলে বাইতের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন অবশ্যম্ভাবী এবং সেটি হতে হবে রসুলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাহ মোতাবেক। আমরা তাঁদের মাগফেরাত কামনা করবো এবং অন্তরে ভক্তি-শ্রদ্ধা লালন করবো। সাথে সাথে তাঁদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে গিয়ে কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবো না। সবাই আল্লাহর কাছে ফিরে গেছেন এবং প্রত্যেকেই তাঁদের আমলের প্রতিদান পাবেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে কারো প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না। 

খতিব মহোদয় আশুরার ফজিলত লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর মুসল্লিদের প্রতি আবারও মঙ্গলবারের সাথে সোম বা বুধবার যোগ করে দুটি দিন রোজা রাখার আহবানের মধ্য দিয়ে তাঁর আলোচনার সমাপ্তি টানেন। সংক্ষেপিত। 

শ্রুতিলিখন : প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।

Comments