মুত্তাকি কে? এ প্রশ্নে আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে এমন একটি চেহারার মানুষ যিনি বিশেষ ধরনের পোশাকে আচ্ছাদিত, মুখে শুভ্র দাঁড়ি, মাথায় টুপি এবং সম্ভব হলে হাতে তসবিহ। এমন লোককে দেখলেই মানুষ সমীহ করে। যেমন বাসে উঠলে অনেক সময় মানুষ আমাকে সমীহ করে জায়গা করে দেয়। এগুলোও মুত্তাকির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আল্লাহপাক এতটুকুতে সন্তুষ্ট নন। আল্লাহপাক চান পোশাকি তাকওয়ার পাশাপাশি মানুষের আমল-আখলাক, লেনদেন ব্যবসা-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রে তাকওয়ার বহিপ্রকাশ ঘটবে। অর্থাৎ এই মুত্তাকি বান্দার দ্বারা আল্লাহর কোনো নাফরমানি হবে না এবং তার দ্বারা আল্লাহর বান্দারা সর্বদাই উপকৃত হবে। মানুষ আল্লাহর বান্দা এবং তিনি আমাদের মনিব। আল্লাহর বান্দা হয়ে চলার জন্য তাকওয়া অপরিহার্য। তাকওয়া অর্থ আল্লাহর ভয় অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায় বেছে বেছে চলা। মনিবের আনুগত্য বা হুকুম মেনে চলার জন্য গোলামের মধ্যে দু’টি গুণ থাকতেই হবে। এক মনিবকে যথার্থ মনিব হিসেবে মনে করা এবং দুই তাকে ভয় করে চলা।
ঈমান আনয়নকারী প্রত্যেকের উপর আল্লাহপাক নামাজ ও রোজার মতো আনুষ্ঠানিক ইবাদত ফরজ করেছেন। মানুষ আল্লাহর গোলাম, নামাজ দৈনিক পাঁচবার মানুষকে সে কথা স্মরণ করে দেয় বলে নামাজকে বলা হয় জিকির। তাই নামাজের দিকে এসো একথা বলার সাথে আল্লাহর স্মরণের দিকে এসো এমনও বলা হয়েছে। আজান শোনার সাথে সাথে মসজিদে হাজির হয়ে মানুষ বড় বিনয় ও আদবের সাথে হাত বেঁধে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে, ‘আমরা তোমারই গোলামি করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই’। আর রোজা বছরে একটি মাস কেবল আল্লাহরই ভয়ে পানাহার ও যৌন কামনা-বাসনা পূরণ থেকে বিরত রাখে এবং এই বিরত থাকা কেবল আল্লাহরই ভয়ে। আর আল্লাহ নিজেও বলেছেন, ‘তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি হয়’- সুরা বাকারা ১৮৩। এই নামাজ-রোজা উদ্দেশ্যবিবর্জিত কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়। বরং বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে’- সুরা আনকাবুত ৪৫। আর রোজার কথা তো বলাই হয়েছে, মানুষকে মুত্তাকি করে।
উদ্দেশ্যকে স্মরণে রেখে মুসলমান যদি নামাজ ও রোজা আদায় করতো তাহলে অবশ্যম্ভাবী তার মধ্যে আল্লাহর ভয় (তাকওয়া) সৃষ্টি হতো এবং এমন মুত্তাকিদের জন্যই আল্লাহপাক নাজিল করেছেন মহাগ্রন্থ আল কুরআন। আল কুরআনের শুরুতেই তিনি বলেছেন, এই কুরআন মুত্তাকিদের জন্য হেদায়াত।
স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা নয়, ঈমান ও আমলের সমষ্টি যার মধ্যে রয়েছে সেই সত্যিকার মুত্তাকি যা আল্লাহপাক সুরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন।
‘তোমরা পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ ফেরাও তাতে কোনো পুণ্য নেই, বরং পুণ্য হচ্ছে এই যে, মানুষ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব ও নবিদেরকে মনেপ্রাণে মেনে নেবে এবং আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রিয় ধন-সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও দাসমুক্ত কাজে ব্যয় করবে। আর নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত আদায় করবে। যারা প্রতিশ্রুতি দিলে তা পালন করে, ক্ষুধা-দারিদ্র, বিপদে-আপদে এবং হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে পরম ধৈর্য অবলম্বন করে- এরাই হচ্ছে সত্যবাদী এবং এরাই হচ্ছে প্রকৃত মুত্তাকি’- সুরা বাকারা ১৭৭
মুসলমানদের কিবলা পরিবর্তনে ইহুদি ও মুনাফিকদের সমালোচনার জবাবে আল্লাহ বলেন পূর্ব ও পশ্চিমের মালিক তিনি এবং স্রেফ আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। বেছে বেছে ধার্মিকতার কিছ বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করা এবং তাকওয়ার কয়েকটি পরিচিত রূপের প্রদর্শনী করা আসলে সৎকাজ নয় এবং আল্লাহর কাছে এর খুব একটা মূল্যও নেই। বরং নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমান ও ঈমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে আমলের মাধ্যমে এবং সেখানেই তাকওয়া উপলব্ধি করা যায়। এখানে আল্লাহ তায়ালা প্রথমেই ঈমানের কতিপয় মৌলিক বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। ঈমান ও আমলের সম্পর্ক বীজ ও বৃক্ষের সাথে। মাটিতে বীজ বপন করা হলে সেখানে চারা গজায়। আর যদি চারা না গজায় বুঝতে হবে বীজ ত্রুটিপূর্ণ বা পচে গেছে বা কোনো পাথরখণ্ডের নিচে চাপা পড়েছে। ঈমানের বিষয়টিও তেমনি। কারো অন্তরে ঈমান থাকলে তার দ্বারা অবশ্যম্ভাবী কেবল সৎ ও কল্যাণকর কাজই সাধিত হয়। সমাজের জন্য অকল্যাণকর বা আল্লাহর নাফরমানিমূলক কাজ সাধিত হওয়া ঈমানদারের জন্য আদৌ সম্ভব নয়।
এখানে আল্লাহ তায়ালা নমুনাস্বরূপ কিছু সৎকাজের কথা উল্লেখ করেছেন। ঈমান আনায়নের পর পরই মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। মানুষের অর্জিত সম্পদের মধ্যে তার নিজের ও পরিবারের সাথে সমাজের আরো অনেকের হক রয়েছে এবং এ ব্যয় হতে হবে একান্ত আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, কোনো বিনিময়ের আশা ছাড়াই। ব্যয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহপাক অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছেন প্রথমেই আত্মীয়-স্বজন এবং পরপরই ইয়াতিম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও দাসমুক্ত কাজে। এর পরপরই নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায়ের কথা বলেছেন। এতে বোঝা যায়, জাকাতের বাইরেও আল্লাহর মুত্তাকি বান্দা অকাতরে তার ধন-সম্পদ ব্যয় করবে।
মুত্তাকি চরিত্রের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তারা প্রতিশ্রুতি প্রদান করলে তা পূরণ করে। মুসলিম জীবনে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ অকল্পনীয়। এটা মুনাফিকদের আচরণ; কোনো মুসলমান তা পারে না। ব্যাংকে ঋণ খেলাপি বা রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়েছে; কিন্তু এটি সাধারণ ব্যাপার নয় আসলে এটি ঈমান না থাকারই পরিচায়ক। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী এবং আমানতের খেয়ানতকারী (যদি রক্ষা করার প্রাণান্ত চেষ্টা না থাকে) এক একজন নিরেট মুনাফিক বৈ আর কেউ নন। এই ঘোষণা স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর এবং নামাজ আদায়কারী ও রোজা পালনকারী এই ঘোষণার বাইরে এমন কথা তিনি বলেননি।
মুত্তাকি ব্যক্তির জীবনে ক্ষুধা-দারিদ্র ও বিপদাপদ ধেয়ে আসে। সত্যপথের পথিক হিসেবে উপার্জনের সকল হারাম পথ সে এড়িয়ে চলে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের অভাব-অনটন দূর করার মতো ঈমানবিধ্বংসী আচরণ থেকে মুমিন দূরে অবস্থান করে। পরিবারে প্রাচুর্য না থাকায় ক্ষুধা-দারিদ্র্য মেনে নিয়ে হালাল উপার্জনের ওপর সন্তুষ্ট থাকার মতো ধৈর্য তার থাকতে হয়। যার মধ্যে ধৈর্য নেই সে টিকে থাকতে পারে না। তাই আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকির গুণ হিসেবে ধৈর্যের কথা উল্লেখ করেছেন। সেই ধৈর্য কেবল বাতিল শক্তির মোকাবেলায় নয় আর্থিক অসচ্ছলতার ক্ষেত্রেও অপরিহার্য।
এই পৃথিবীতে হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। বাতিল মুমিনকে সমূলে উৎখাত করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকে। একদিকে রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবি-রসুল ও তাঁদের সঙ্গী-সাথি এবং বিপরীত পক্ষে রয়েছে তাগুতের পক্ষাবলম্বনকারী কাফের ও মুনাফিক শক্তি। এ দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম থেকে নিজেকে দূরে রেখে নির্ঝঞ্জাট জীবন-যাপন বা বাতিলের সাথে আপোষরফা করে চলা মুমিনের জন্য সম্ভব নয়। আল্লাহপাকের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, ‘যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে আর যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই তোমরা শয়তানের সঙ্গী-সাথিদের বিরুদ্ধে লড়াই করো আর বিশ্বাস করো শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’- সুরা আন নেসা ৭৬। বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী দুটি পক্ষ এবং স্বয়ং আল্লাহপাক নিজেই তাদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। এই দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম থেকে যারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে তাকওয়ার পরিচিত কিছু আনুষ্ঠানিকতার মাঝে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে চলার চেষ্টা করে তাদের ঈমান বড় সংশয়পূর্ণ। বলা যায়, মুনাফিকের স্বভাব তাদের মধ্যে রয়েছে।
মুসলমান তাকেই বলে যে ব্যক্তি ইসলামকে আল্লাহপাক প্রদত্ত একমাত্র দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) হিসেবে বিশ্বাস করে এবং মেনে চলার সাথে ইসলামের বিজয় কামনা করে। আল্লাহপাক তাঁর রসুলকে পাঠিয়েছেন তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার মিশন দিয়ে (শুধু মুহাম্মদ সা.-কে নয় সকল নবি-রসুলের একই দায়িত্ব) এবং সেটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন কুরআন মজিদের তিনটি জায়গায় (সুরা তওবা-৩৩, সুরা ফাতাহ-২৮, সুরা সফ-৯)। ‘তিনিই আল্লাহ যিনি তাঁর রসুলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন, যাতে অন্য সব দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করেন। সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট’- সুরা ফাতাহ ২৮। আল্লাহর সাক্ষীর চেয়ে আর কার সাক্ষী বড় হতে পারে? আবার কোথাও বলা হয়েছে মুশরিকরা মোটেই বরদাশত করবে না। দুনিয়ার সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী আল-আমিন ও আস-সাদিক উপাধী প্রাপ্ত মুহাম্মদ সা. কালিমা তাইয়েবার দাওয়াত দানের সাথে সাথে তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও বংশের লোকদের নিকট থেকে প্রচণ্ড বিরোধীতার সম্মুখীন হন। সাহাবায়ে কেরামদের কাজ কী জানতে চাইলে জবাবে তিনি বলেন, আমার যা কাজ তোমাদেরও তাই কাজ অর্থাৎ দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে মানুষের নিকট দাওয়াত পৌঁছে দেয়া।
যার অন্তরে দ্বীনের বিজয় কামনা নেই, বাতিলের সাথে আপোষ-রফা করে চলে তার সুন্নাতি পোশাক, নামাজ- রোজা, তসবিহ-তাহলিল সবই পণ্ডশ্রম, মূল্যহীন বরং বাতিলের সহযোগী হিসেবে সে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের সাক্ষাত অনুসারী একজন নিরেট মুনাফিক। এই কথাটি রসুলুল্লাহ সা. নিজেই বলেছেন, যে লোক মারা গেল না জিহাদ করলো আর না জিহাদের বাসনা অন্তরে পোষণ করলো তার মৃত্যু হলো মুনাফিকের মৃত্যু। রসুলুল্লাহ সা. যা করেছেন, যা বলেছেন এবং অনুমোদন করেছেন সেটিই সুন্নাহ। দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা-প্রচেষ্টার চেয়ে বড় কোনো সুন্নাহ নেই এবং এই সুন্নাহ মুস্তাহাব নয়, ফরজ; যে সুন্নাহ পালনে ব্যক্তি জান্নাতে পৌঁছে যাবে (আল্লাহর স্পষ্ট ঘোষণা সুরা সফ ১২)। দুর্ভাগ্য, সুন্নাহ পালনে উম্মাহকে বিভক্ত করা হচ্ছে এবং পরস্পর দলাদলিতে মেতে উঠেছে। সবই মুস্তাহাব আমল এবং স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর নিজের আমলের ক্ষেত্রেই ছিল ভিন্নতা। এই ভিন্নতা ছিল দ্বীন পালন সহজ করার লক্ষ্যে, যে কোনো একটি আমল করলেই হলো অথচ এই মুস্তাহাব আমলকে কেন্দ্র করে আজকে উম্মাহ বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি মসজিদ পর্যন্ত আলাদা করে ফেলেছে। এই দলাদলি ও বিভক্তি সুস্পষ্ট কুফরি এবং পরিণতি জাহান্নাম (দেখুন সুরা আলে ইমরান ১০৫-১০৮, সুরা মুমিনুন ৫২-৫৩, সুরা আনআম ১৫৯)।
আমাদের মনে করায় এবং বলায় সত্যবাদী ও মুত্তাকি চিহ্নিত হবে না, হতে হবে আল্লাহর ঘোষণায়। ঈমান, আল্লাহর বান্দাদের প্রয়োজনে অর্থব্যয়, নামাজ ও জাকাত আদায় এবং প্রতিশ্রুতি পালনের সাথে সাথে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য এবং বাক্যের শেষে তিনি স্পষ্ট করেছেন হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে পরম ধৈর্য অবলম্বন করে- এরাই হচ্ছে সত্যবাদী এবং এরাই হচ্ছে প্রকৃত মুত্তাকি। তাই হকের পক্ষ অবলম্বন করে বাতিলের মোকাবেলায় মুমিনকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে। জিহাদ বিমুখ হয়ে কোনো সুন্নাহ পালন হতে পারে না। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের সঠিক উপলব্ধি দান করুন এবং বাতিলের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন। ২৬.০৭.২০২২
Comments
Post a Comment