عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ مَا خَطَبَنَا نَبِيُّ اللهِ ﷺ إِلَّا قَالَ لَا إِيْمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ
আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যার আমানত নেই তার ঈমান নেই আর যার প্রতিশ্রুতি নেই তার দ্বীন নেই’- মুসনাদে আহমাদ
বহুল প্রচলিত হাদিস। আমাদের অনেকেরই মুখস্থ এবং আমরা উচ্চারণও করি। বড় তাৎপর্যপূর্ণ হাদিস। এই দুটি আমল ঈমান ও দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত। রসুলুল্লাহ সা. স্পষ্ট বলেছেন, আমানত ও ঈমান পরস্পর সংযুক্ত। অর্থাৎ যার মধ্যে আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই। আবার তিনি বলেছেন, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন এবং ধর্ম পরস্পর সংযুক্ত। যার মধ্যে ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালনের বাধ্যবাধকতা নেই তার ধর্ম নেই অর্থাৎ সে মুসলিম নয়। যার ইমান নেই ও ধর্ম নেই তার নামাজ- রোজা-হজ- জাকাত-কুরআন তেলাওয়াত ও জিকির- আজগার কি কোনো মূল্য বহন করবে? সবাই বলবে কক্ষনো না। কারণ আগে দরকার ঈমান। কুরআন মজিদে নানাভাবে এই দু’টি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সুরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াতে মুত্তাকিদের পরিচয় প্রসঙ্গে অন্যান্য গুণের সাথে বলা হয়েছে ‘যারা প্রতিশ্রুতি দিলে তা পালন করে’। সুরা আল মুমেনুনে সফল মুমিনদের গুণাবলী উল্লেখ করতে গিয়ে ৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতিসমূহের হেফাজত করে’।
এই দু’টি গুণের অনুপস্থিতিতে কেহ মুমিন হতে পারে না আবার মুসলিমও হতে পারে না। শুধু এতটুকইু নয়, রসুলুল্লাহ সা. ভয়ঙ্কর কথা বলেছেন, আমানত রক্ষা ও প্রতিশ্রুতি পালনের বাধ্যবাধকতা যার মধ্যে নেই তার মধ্যে নেফাকি রয়েছে। মুনাফিকের চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা মুহাম্মদ সা. বলেছেন, ‘কথা বললে মিথ্যা বলে, আমানতে খেয়ানত করে, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং ঝগড়া-ঝাটি হলে অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করে’। এই চারটিই পরস্পর পরিপূরক। কোনো ঈমানদার ও মুসলমানের মধ্যে এসব দোষ-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক নয়। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমারা যাদের কাফের-মুশরিক বলে গালি দেই তারা অনেকখানি এসব মৌলিক মানবিক ত্রুটি থেকে মুক্ত। আল্লাহর সুন্নাত হলো যে জাতি যতো মৌলিক মানবীয় গুণে সমৃদ্ধ হবে দুনিয়া পরিচালনার ভার তিনি তাদের ওপর ন্যস্ত করবেন। ঈমান না থাকার কারণে এসব কাফের- মুশরিকরা জাহান্নামে যাবে এটি সত্য, আর ঈমানের দাবিদার মুনাফিকদের স্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে।
রাষ্ট্রীয়জীবনে আমানত রক্ষা ও প্রতিশ্রুতি পালনের বাধ্যবাধকতা একেবারেই শূন্য বলা যায়। যার ফলশ্রুতিতে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস নেই বললেই চলে। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ধ্বংসের কিনারায় দণ্ডায়মান। আস্থাহীনতার ফলশ্রুতিতে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ার এই দুরবস্থা এবং বহুদেশ তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করতে যাচ্ছে। আমাদের ক্ষমতাসীনরা অনর্গল মিথ্যা বলে, আমানতে খেয়ানত করে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং প্রতিপক্ষকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করে। অর্থাৎ মুনাফিকের সকল বৈশিষ্ট্যই পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠতম উম্মত, তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে, আর তোমরা নিজেরাও আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে’- সুরা আলে ইমরান ১১০। আল্লাহপাকের অভিপ্রায় মুসলমান জাতি বিশ্ব শাসন করবে। তারা বিশ্বে সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজ থেকে বিশ্ববাসীকে দূরে রাখবে। এতো কদর্য চরিত্র নিয়ে কি সেটি সম্ভব? তাই মুসলিম বিশ্ব আদেশ দানের পর্যায়ে নেই বরং কাফির-মুশরিকদের আদেশানুগত হয়ল টিকে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে।
ইসলামে ঋণদানকে উৎসাহিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে ঋণগ্রহণকে সাংঘাতিক অপছন্দ করা হয়েছে। রসুল সা. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জানাজা পড়াতে অস্বীকার করতেন। তাই মাইয়াতের জানাজার পূর্বে তার উত্তরাধিকারদের ঋণের দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণা দিতে দেখা যায়। উত্তরাধিকারদের মাঝে সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে দাফন-কাফন এবং ঋণ পরিশোধের পরে তা বন্টন করতে হয়। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ যখন কাউকে শাস্তি দিনে চান তখন তার ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেন। আমরা স্কুলজীবনে ডা. লুৎফর রহমানের পয়সাকড়ি প্রবন্ধে পড়েছি, ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির চিত্তে স্বাধীনতা থাকে না’। পাওনাদারের ভয়ে তাকে পালিয়ে বেড়াতে হয় এবং মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সে প্রায়ই ব্যর্থ হয়। ঋণখেলাপির কারণে আমাদের ব্যাংকগুলোর বড় দৈন্যদশা। ঋণখেলাপি অর্থ আমানত ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী নিরেট মুনাফিক বৈ আর কেউ নন।
ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্র সর্বত্রই খেয়ানতের মহোৎসব চলছে। যার যতটুকু দায়িত্ব সেটি তার আমানত এবং নিষ্ঠার সাথে পালন না করাটাই খেয়ানত। সন্তান পিতামাতার জন্য আমানত। তাকে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া পিতামাতার দায়িত্ব। আমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং দায়িত্বের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে বাধ্য। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির উপর অর্পিত দায়িত্ব আমানত। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আমরা কাউকে নিয়োগ দিলে সে তার নিজের কাজ যতো নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করে আমাদের অর্পিত দায়িত্ব সেভাবে পালন না করলে উল্টা করে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আবার বলেছেন, সে যদি এক টুকরো সূতা বা তার চেয়ে ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে তাহলে খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে। কী দুর্ভাগ্য! সরকারি অফিস-আদালতে কেউ গেলে মনে হয় প্রভুর দরবারে গোলাম হাজির হয়েছে। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। ঘুষ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সে তো জাহান্নামই খরিদ করে নেয়। ঘুষ তো দূরের কথা কোনো কাজ যদি দশ মিনিটে সম্ভব হয় তবে সেই কাজে আধা ঘন্টা লাগানোও জুলুম
আল্লাহপাক মুসলিম উম্মাহকে আমানত রক্ষা ও প্রতিশ্রুতি পালনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হওয়ার তৌফিক দান করুন। ১০.০৮.২০২২
Comments
Post a Comment