Skip to main content

খুতবার গুরুত্ব


বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

মসজিদ আল্লাহর ঘর, আমাদের সমাবেশস্থল ও শক্তিকেন্দ্র। মুসলিম পরিচয় দানকারী সকলকে দৈনিক পাঁচবার বাধ্যতামূলক আল্লাহর ঘরে হাজিরা দিতে হয়। একজন অন্ধ সাহাবিকেও রসুলুলুল্লাহ সা. জামায়াতে আসা থেকে অব্যাহতি দেননি। তিনি বলেছেন, আজান শুনলে তোমাকে আসতে হবে। সেই ঘরের একজন ইমাম (নেতা) আছেন এবং নামাজে মূলত চলে সেই ইমামের আনুগত্যের অনুশীলন (অন্যতম শিক্ষা)। নামাজে বহুবিধ কল্যাণকারিতা (ফায়দা) রয়েছে। তন্মধ্যে আল্লাহর স্মরণ প্রধানত। অর্থাৎ মানুষ যে আল্লাহর গোলাম সেটি বারবার স্মরণ এবং আল্লাহর গোলামি করার স্বীকৃতি নামাজের মাধ্যমে নেয়া হয়। আমি এখানে আনুগত্য, শৃঙ্খলা ও খুতবা নিয়ে কিছু আলোচনা করবো ইনশা-আল্লাহ। 

কাতার সোজা করা নামাজের অন্যতম শর্ত। নামাজ শুরু করার পূর্বে কাতার সোজা করার জন্য ইমাম সাহেব প্রতি ওয়াক্তে তাঁর মুসল্লিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মুসল্লিরা কাঁধে কাঁধ মিলে ও গায়ে গা লাগিয়ে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। রসুলুল্লাহ সা. সতর্ক করে বলেছেন, তোমরা কাতার সোজা করে দাঁড়াবে অন্যথায় তোমাদের দিল পরস্পর থেকে বাঁকা হয়ে যাবে। আর ফাঁকা ফাঁকা দাঁড়াবে না তাতে শয়তান তোমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে যাবে। এই যে শৃঙ্খলা ও আনুগত্য, আমাদের মাঝে কি কোনো উপলব্ধি আছে? একটি সুশৃঙ্খল ও আনুগত্যশীল বাহিনী দ্বারা অসাধ্য সাধন করা যায়। 

নামাজে মুক্তাদির কোনো ভুল নেই। কিন্তু ইমামের আনুগত্যের ক্ষেত্রে যদি কোনো শৈথিল্য বা অবহেলা হয় তাহলে সেই মুক্তাদির আর নামাজ হয় না। যতো সুন্দর করেই পাক-পবিত্র হোক এবং নামাজের আনুষঙ্গিক বিষয়াবলি যতো সুন্দরই হোক তারপরও ইমামের আনুগত্যের অবহেলায় তার নামাজ আর নামাজ থাকে না এবং আল্লাহর দরবারে গৃহিতও হয় না। কথাগুলো আমরা জেনেছি রসুলুল্লাহ সা. থেকে। আবার নামাজে নেতার (ইমামের) আনুগত্যের সীমাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ইমামের সুন্নাত-মুস্তাহাবের ভুল ধর্তব্যের মধ্যে নয়, ওয়াজিবের ভুল সহু সেজদার মাধ্যমে সংশোধন করে নিতে হয়। ফরজ ভুল হলে বা লঙ্ঘনে নামাজ হয় না; পুনরায় আদায় করতে হয়। আজ মুসলমানের মধ্যে যে বিভেদ ও অনৈক্য সবই মুস্তাহাব আমল নিয়ে। নামাজের মতো শ্রেষ্ঠতম ইবাদতের ক্ষেত্রে মুস্তাহাব আমলে ত্রটি-বিচ্যুতি বিবেচনাযোগ্যই নয় অথচ সেই আমল নিয়ে উম্মাহ দল-উপদল গঠন করে এবং মসজিদও পৃথক করে। কপালপোড়া মুসলমান! দল- উপদল সৃষ্টি করা যে কুফরি সে চেতনাও হারিয়ে ফেলেছে। 

কোনো মহল্লায় যদি কয়েকজন যুবক একজনের নেতৃত্বে কোনো ক্লাব বা সমিতি গঠন করে এবং সপ্তাহে একটি দিন একত্রিত হয় মানুষ তাদের সমীহ করে; এই সমীহ করার পেছনে কারণ হলো তাদের ঐক্যবদ্ধতা। কিন্তু আমাদের কী দুর্ভাগ্য! আমরা দৈনিক পাঁচবার একত্রিত হই এবং ইমামের আনুগত্যের মহড়া দেই; তাঁর কমান্ড ফলো করে সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করি এবং ইমামকে অনুসরণ না করে কোনো কাজ আগে করলে নামাজই নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু আমাদের মাঝে কোনো চেতনা নেই, মসজিদের বাইরে ইমামের আনুগত্য নেই। আমরা দ্বীন ও দুনিয়াকে ভাগ করে নিয়েছি। দ্বীনের নেতৃত্ব দিয়েছি ইমাম সাহেবের প্রতি, তাঁর কাজ হলো দোয়া করা। নির্বাচনের সময় কোনো ব্যক্তি জিজ্ঞেস করে না, হুজুর এবারের ভোটটা কাকে দিব? বলি, এসব দুনিয়াদার কাজ। অনেক হুজুর গর্ব করে বলেন, আমি রাজনীতি করি না। অথচ সকল নবি-রসুলের সাথে সমসাময়িক রাজা-বাদশা ও শাসকগোষ্ঠীর বিরোধের মূল কারণ ছিল রাজনীতি। কালিমা তাইয়্যেবা একটি বিপ্লবাত্মক ঘোষণা যাতে সকল ইলাহ (হুকুমকর্তা) বা শাসকগোষ্ঠীকে অস্বীকার করে কেবল আল্লাহকে মেনে নেয়ার আহবান জানানো হয়।

সাপ্তাহিক জুমার দিন ইমামের (নেতার) বক্তৃতা (খুতবা) দান ও শ্রবণ বাধ্য করা হয়েছে। এর মধ্যে যে কতো বড় কল্যাণকারিতা তা আমরা কখনো চিন্তা-ভাবনা করে দেখিনি। বক্তৃতায় রয়েছে যাদুকরী শক্তি। বক্তৃতা সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার। এই পৃথিবীতে বক্তৃতার জোরে অনেক কিছু সাধিত হয়েছে। মানুষ ছুটে চলেছে বক্তৃতা শোনার জন্য এবং প্রভাবিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কুরআন মজিদ মহান আল্লাহ তায়ালার বক্তৃতা। রসুলুল্লাহ সা. তাঁর সমাজে যখন কুরআন তেলাওয়াত করেছেন তখন একটি শ্রেণি উদ্বুদ্ধ হয়ে ঈমান এনেছে এবং অপর একটি শ্রেণি নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে প্রচণ্ড বিরোধীতা করেছে। আল্লাহর ভাষায়, এই কাফেররা বলে তোমরা কখনোই কুরআন শুনো না এবং যেখানেই কুরআন শোনানো হয় সেখানে হট্টগোল করো। আমি এই কাফেরদের কঠিন আজাবের স্বাদ আস্বাদন করাবো। এখনো এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।

জুমার দিন জোহরের চার রাকাতের স্থলে জুমার দুই রাকাত নামাজ ফরজ এবং তার পূর্বে খুতবা শ্রবণ ওয়াজিব। হাদিসের ভাষা হলো- জুমার দিন আমাদের ঈদের দিন। গোসল করে উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে সকাল সকাল উপস্থিত হয়ে মিম্বরের কাছাকাছি অবস্থান গ্রহণ করতে হবে এবং উপস্থিতির ক্ষেত্রে উট, গরু, ছাগল কুরবানির সওয়াবের কথা হাদিসে বলা হয়েছে। প্রথম কাতারে বসার ক্ষেত্রে প্রিয় নবি সা. বলেছেন, মানুষ যদি বুঝতো তাহলে প্রথম কাতারে বসার জন্য লটারি করতে হতো। হাদিসে এটাও বলা হয়েছে, খতিব মহোদয় মিম্বরে দাঁড়ানোর সাথে সাথে ফেরেশতারা সওয়াব লেখা বন্ধ করে খুতবা শোনা শুরু দেন। আমার প্রশ্ন, এমতাবস্থায় যেসব মুসল্লি পরে মসজিদে প্রবেশ করে (একামত শুরু হওয়া পর্যন্ত আসতে থাকে) তাদের নসিবে কি জুমার নামাজের সওয়াব জুটে (যেহেতু ফেরেশতারা সওয়াব লেখা বন্ধ করে দেন)?

আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষ খতিব মহোদয়ের বক্তৃতাকে খুতবার মর্যাদা দেয় না, ফলে সেটি শোনার বাধ্যবাধকতা উপলব্ধি করে না বরং পরে চার রাকাত সুন্নাত নামাজের গুরুত্ব বেশি অনুভব করে থাকে। ২০১২ সনে হজ আমার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে। আমি পড়াশোনা করেছি এবং খুব নিকট থেকে খতিব মহোদয়ের খুতবা ও নামাজ পর্যবেক্ষণ করেছি। সেখানে আমাদের মতো তিনটি খুতবা হয় না এবং সুন্নাতের জন্য আলাদা কোনো সময়ও দেয়া হয় না। স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর আমলও এমনই ছিল। এতটুকু জানা যায়, রসুলুল্লাহ সা.খুতবা প্রদানকালে কেউ যদি আসতো তাহলে বলতেন, দু’রাকাত নামাজ পড়ে বসে পড়ো (সাধারণত সাহাবায়ে কেরামের বিলম্ব হতো না)। আমাদের দেশেও অনেক মসজিদে রসুল সা.-এর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। আমার বিশ্বাস, সুন্নাহ সমর্থিত পন্থা অনুসরণ করে দু’টি খুতবা এবং পরে চার রাকাত সুন্নাত পড়ার সময় না দেয়া হলে মুসল্লিরা খতিব মহোদয়ের খুতবা শোনার গুরুত্ব অনুধাবন করবেন এবং খুতবা শোনার জন্য তারা আগে আগেই মসজিদে হাজির হবেন।

বক্তৃতা শোনানোর জন্য আমাদের নেতা-নেত্রীদের কতো প্রচেষ্টা। দুশো লোককে একত্রিত করতে তাদের ঘাম ঝরে যায়। হল ভাড়া, চিঠি ছাপানো, মেহমান ঠিক করা, লোকজন আনা এবং বিরিয়ানির প্যাকেট প্রদান কতো কিছু করতে হয়। তারপরও পুরো সময় ধরে রাখা যায় না এবং চুপ থাকার জন্য বারবার আহবান জানাতে হয়। অথচ জুমার খুতবায় স্বতস্ফুর্তভাবে হাজির হতে হয় এবং খুব মনোযোগের সাথে শুনতে হয়। পাশে কেউ কথা বললে, ভাই চুপ করো তাও বলা যায় না। যুগ যুগ ধরে আমরা খুতবা শুনি। খুতবা একটি নসিহত, মানুষকে নেক কাজে উদ্বুদ্ধকরণ এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার একটি প্রয়াস, দুর্ভাগ্য সকল মুসল্লিকে আমরা উপলব্ধি দানে সক্ষম হয়নি। ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম, বিবেক-বুদ্ধির সমার্থক। কোনো কিছু পড়া বা শোনার অর্থ হলো সেটি উপলব্ধি করার সাথে সাথে কার্যে পরিণত করা। আমরা কুরআন পড়ি পড়ার জন্য এবং খুতবা শুনি শোনার জন্য। অথচ ব্যবহারিক জীবনে এমন আচরণ করলে আমাদেরকে নিরেট মুর্খ খেতাব লাভ করতে হতো।

আল্লাহ তায়ালার দরবারে লাখো শুকরিয়া যে আমাদের দেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে খুতবার গুণমত মানের অনেক উন্নতি হয়েছে। এই খুতবা খতিব মহোদয়দের এক সপ্তাহের চিন্তা-ভাবনার ফসল। প্রযুক্তির এই যুগে অনেক মসজিদেই খুতবা ভিডিও করে ইউটিউবে ছাড়া হয় এবং তাতে মানুষ বেশ উপকৃত হন। আমি সবসময় খুতবা মনোযোগের সাথে শুনে থাকি এবং এক সময় খেয়াল হয় দাওয়াতে দ্বীনের অংশ হিসেবে ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে খুতবা শেয়ার করার। আমাদের বই পাঠের অভ্যাস খুব কম এবং সমৃদ্ধ লাইব্রেরির অভাব, তারচেয়েও বড় অভাব পাঠকের। অথচ ইউরোপ- আমেরিকায় শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরি ও ল্যাবে ঘন্টার পর ঘন্টা লেখাপড়া ও গবেষণায় ব্যস্ত থাকে। সম্প্রতি তুরস্কে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি উদ্বোধন হতে যাচ্ছে যেখানে দশ লক্ষ বই এবং একসাথে তিন হাজার শিক্ষার্থীর লেখাপড়া করার সুযোগ থাকবে। আরো কতো সুযোগ সুবিধা। আমাদের লেখক ও প্রকাশকরা বই বিক্রি না হওয়ার ভয়ে বই ছাপাতে আগ্রহী হয় না। আমাদের মসজিদগুলোয় যে খুতবা প্রদান করা হয় ইউটিউবে সংরক্ষণের পাশাপাশি বই আকারেও বাজারে আসতে পারে এবং বইগুলো দাওয়াতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হতো। 

ফেসবুকে প্রকাশিত জুমার খুতবার শ্রুতিলিখন আমার সম্পাদনায় বই আকারে প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় জুলাই ২০২১। সেই বইতে মোট ৫০টি খুতবা (বক্তৃতা) ছিল। এদিকে একটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমার কাছে ৪৮টি খুতবা রেডি রয়েছে। ২০২২ সনের শেষ দিকে আর একটি বই প্রকাশ করার চিন্তা-ভাবনা করছি। যাদের খুতবা প্রস্তুত রয়েছে -

১. মাওলানা মুফতি মাহমুদুল হাসান আশরাফী (কাঁঠালবাগ জামে মসজিদ, মিরপুর)  : ১২ 

২. মাওলানা মুফতি সাইফুল ইসলাম 

(মসজিদ উত তাকওয়া সোসাইটি, ধানমন্ডি)    : ০৬

৩. হাফেজ মাওলানা মো. শাহ আলম নূর 

(রাইনখোলা জামে মসজিদ, মিরপুর)    : ০৮     (খুতবাগুলো অধিকাংশ ২০১৫-১৬ সালের দিকের যা প্রথম বইতে প্রকাশিত হয়নি)

৪. অধ্যাপক মাওলানা রফিকুর রহমান মাদানি 

(কাঁটাবন জামে মসজিদ)    : ০৪

৫. মাওলানা মুফতি শাহ ওয়ালিউল্লাহ 

(সোবহানবাগ জামে মসজিদ, ধানমন্ডি)    : ০৩

৬. মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ জাকারিয়া 

(বাইতুন নূর জামে মসজিত, বিজয়নগর)    : ০১

৭. হাফেজ মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাইয়াফ 

(মাল্টিপ্ল্যান রেডক্রিসেন্ট সিটি মসজিদ)   : ০৫ 

৮. প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী    : ০৫

৯. অন্যান্য    : ০৪     মোট =    ৪৮টা 

খতিব মহোদয়, দ্বীনের দায়ী ও প্রকাশকদের অনুরোধ জানাবো খুতবাগুলো বই আকারে সংরক্ষণের। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রদত্ত মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন। ১৯.০৮.২০২২


Comments