করোনা কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, করোনা বহুবিধ সমস্যায় আমাদেরকে নিপতিত করেছে। শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, পর্যটন, যোগাযোগ সকল ক্ষেত্রে আমাদেরকে পিছিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো গরীব দেশ দীর্ঘস্থায়ী এর ধকল সহ্য করার মতো ক্ষমতা রাখে না। ফলে চেষ্টা চলছে করোনাকে মানিয়ে নিয়ে চলার। তাই আজ থেকে সকল সরকারি অফিস পূর্ণদ্যোমে চলার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়মিত বেতন-ভাতা পেয়ে থাকলেও দেশের বেসরকারি খাতে চরম দুরবস্থা চলছে। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে এবং অনেকে চাকুরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। তাই সবকিছু খুলে দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
প্রতিনিয়তই আমরা মৃত্যু দেখি। মৃত্যুকে এড়িয়ে চলার কোনো সুযোগ নেই। আমরা মাত্র সতর্ক থাকতে পারি। সাপের কামড়ে মৃত্যু, পানিতে ডুবে মৃত্যু, রোড এক্সিডেন্ট, অগ্নিকান্ড ও নানাবিধ রোগে মানুষ দুনিয়া থেকে প্রতিনিয়ত বিদায় গ্রহণ করছে। এজন্য আমরা আমাদের সাধ্যমত সতর্কতা অবলম্বন করতে পারি। সাপের ভয়ে আমরা রাতে বিছানাটা ঝেড়ে এদিক-ওদিক দেখে থাকি (বিশেষ করে গ্রামে কাঁচা ঘরে), পানিতে ডোবার ভয়ে বাচ্চাদেরকে দূরে রাখি, সাঁতার না জানলে নৌকায় উঠতে রাজি হয়নি, কী কারণে কোন্ রোগ হয় সে সম্পর্কে জেনে সতর্ক হই ও রোগ-ব্যাধি হলে তার চিকিৎসা গ্রহণ করি। করোনাও এমনই একটি রোগ। ইতোমধ্যেই মানুষ করোনা সম্পর্কে অনেকখানি জেনে ফেলেছে এবং সাবধানতাও অবলম্বন করছে।
করোনা পরিস্থিতির যে উন্নতি হয়েছে এমন নয়। গতকাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯৫,৬২,২৩৮, মৃতের সংখ্যা ৭২৪,৩৯৪ এবং সুস্থ হয়েছেন ১২৫,৫৮,৪১২ জন। দেশে মোট করোনা শনাক্ত ২৫৫,১১৩, মৃতের সংখ্যা ৩,৩৬৫ ও সুস্থ হয়েছেন ১৪৬,৬০৪ জন। বিশ্বব্যাপী এ চিত্র বড় ভয়াবহ। গত ২৪ ঘন্টায় বিশ্বে নতুন করোনা শনাক্ত ২৮৩,১৬১ এবং মৃত্যুবরণ করেছে ৬,৩৭০ জন। বাংলাদেশে নতুন শনাক্ত ২,৬১১ এবং মৃত্যুবরণ করেছে ৩২ জন। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার ৩.৭ এবং আমাদের দেশে ১.৩২। করোনার দাপট অব্যাহত রয়েছে। তবে বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক কম। আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে করোনাভীতি অনেকখানি কমে গেছে। মানুষের কাছে অন্যান্য রোগ-ব্যাধির মতো করোনাও সহনীয় হয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলে করোনার তেমন কার্যকরতা লক্ষ্য করছি না। শহরে মানুষ সতর্ক হয়ে চলার চেষ্টা করছে।
অসংখ্য সৃষ্টির মতো করোনা আল্লাহর সৃষ্ট এক রোগজীবাণু। করোনার বৈশিষ্ট্য, এটি ছোঁয়াচে এবং খুব দ্রুত ছড়ায়। মানুষ যখন সীমালঙ্ঘন করে তখন আল্লাহপাক সতর্ক করার জন্য পৃথিবীবাসীর প্রতি বিপদাপদ দেন। আল্লাহর ভাষায়, এসবই মানুষের হাতের কামাই। করোনা পাক্কা মুসলিম (অনুগত), আল্লাহর দেয়া নিয়ম মেনে চলে। মানুষ এখনো করোনাকে বুঝে উঠতে পারেনি। করোনার বড় আঘাতটা এসেছে হালকা বসতিপূর্ণ উন্নত দেশসমূহের ওপর। তাদের গর্ব-অহঙ্কার মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে যেমনটি দেয়া হয়েছিল আদ ও সামুদ জাতিকে। কুরআনের ভাষায়, ওরা ছিল খুব ক্ষমতাধর। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের বস্তি ও শিশুরা করোনা থেকে অনেকখানি নিরাপদ। নানাজনে নানা ব্যাখ্যা দিলেও আমার বিশ্বাস করোনার প্রতি এটি আল্লাহরই নির্দেশনা।
আমি এক সময়ে করোনা নিয়ে অনেক পড়তাম, লিখতাম, নিজে সতর্ক থাকতাম ও লোকজনকে সতর্ক করতাম এবং নিজেকে ঘরে আটকে রাখতাম। এখন আমার উপলব্ধি, করোনাকে অতো ভয় পাওয়ার মতো নয়। অন্যান্য রোগ-ব্যাধি থেকে যেমন সতর্ক থাকি করোনা থেকেও তেমন সতর্ক থাকলেই হবে। অপ্রয়োজনে নয়, নিজের প্রয়োজনে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে ঘর থেকে বের হওয়া এবং বের হওয়ার সময়ে মাস্ক ব্যবহার এবং ঘন ঘন হাত ধোয়ার নিয়ম অনুসরণ করলেই চলবে। আর বড় প্রয়োজন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রকৃতির সাথে তাল মেলায়ে চলার চেষ্টা করা। সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণ কম হওয়ার কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং তারা রোদ-বৃষ্টি-শীতে নিজেদেরকে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের (বিশেষ করে ড. বিজন কুমার শীল) মতে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ মানুষ ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং মানুষের মধ্যে এন্টিবডি তৈরী হয়ে গেছে। যারা একবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সাধারণত আমরা জানি, শিশুরা সহজেই আক্রান্ত হয় এবং যার কারণে আমরা তাদেরকে হাসপাতালে নিতে চাই না। কিন্তু করোনা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। একটি পরিবারে বয়স্ক সবাই আক্রান্ত হলেও দেখা যাচ্ছে শিশুরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। এক্ষেত্রে এই হাদিস ‘ছোয়াচে বলে কিছু নেই’ খুবই কার্যকর। মহামারি এলাকায় না যাওয়ার জন্য সতর্কতার পাশাপাশি এই হাদিস আমাদেরকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসহ করোনা রোগীকে সেবাদানে সাহস যুগিয়েছে। মূল বিষয় হলো বিপদাপদ সবই আল্লাহর দেয়া এবং দূর হয় তাঁরই হুকুমে। সতর্ক হওয়া বান্দার দায়িত্ব এবং শেফা দান করা আল্লাহর এখতিয়ারে। আমরা আল্লাহর ওপরই নির্ভর করবো।
দেশে অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে সবকিছু খুলে না দিয়ে উপায় নেই। দেশের অভ্যন্তরে সীমাহীন বেকারত্ব এবং বিদেশফেরৎ বেকারত্বের কারণে দেশে গণ অসন্তোষ দেখা দিবে। অর্থনীতির সকল সেক্টর উন্মুক্ত করে দিয়ে বেকারত্বের লাগাম টেনে ধরা দরকার। আমাদের দেশে করোনার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর দুর্নীতি। দুর্নীতি দূর করতে না পারলে আমরা টিকে থাকতে ব্যর্থ হবে। বিপদাপদ আল্লাহপাক দেন মানুষকে সতর্ককরণ, সংশোধন, পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে। এই করোনা ঈমানদারদের ঈমান বৃদ্ধি ঘটালেও দুর্নীতিবাজরা হেদায়াত লাভে ব্যর্থ হয়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে আল্লাহর অনেক বান্দাহ তাঁর কাছে ফিরে গেছেন। আমি বিশ্বাস করি, ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধরা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই তাদের রবের কাছে ফিরে গেছেন। জালেমদের বিষয়টি স্বতন্ত্র।
করোনায় শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। অবিলম্বে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া দরকার। সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক উন্নত। স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষা বিশেষ করে এসেম্বলির ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করলাম, শিক্ষার্থীর অভাবে আট লক্ষাধিক আসন খালি পড়ে থাকবে। মসজিদগুলোয় যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় হচ্ছে তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাও সম্ভব। শারীরিকভাবে অসুস্থ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ছুটি দিয়ে বাকিদের নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো যেতে পারে।
আমার আলোচনার মূল কথা হলো করোনা স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি বিরাট অর্থনৈতিক সমস্যা। সবকিছু বন্ধ রেখে বা সীমিত পরিসরে খুলে করোনা উদ্ভূত সমস্যা মোকাবেলা সম্ভব নয়। মানুষ মোটামুটি করোনার সাথে পরিচিত হয়ে পড়েছে এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায়ও জেনে ফেলেছে। একটি বিশ্বাসী জাতি হিসেবে নিজের করণীয় সম্পন্ন করে আল্লাহর ওপর নিজেদেরকে সোপর্দ করে অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়া পরিবেশ-পরিস্থিতি ও সময়ের দাবী বলেই মনে করি। আল্লাহপাক আমাদেরকে করোনা থেকে হেফাজত করুন এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার তাওফিক দান করুন। ০৯.০৮.২০২০
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment