দীর্ঘ ৫/৬ মাস পর ধানমন্ডি তাকওয়া মসজিদে আজ জু’মা আদায় করলাম। ধানমন্ডিতে মেয়ের বাসার সন্নিকটে তাকওয়া মসজিদ এবং আমাদের বাসার সন্নিকটে মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে সাধারণত জু’মা আদায় করি। দু’টি মসজিদেরই জু’মা আলোচনা ভালো লাগে ও শেয়ার করার চেষ্টা করি। পুরোটা পারি না, সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়ে থাকি। এতে আমার লাভ, খুতবা মনোযোগের সাথে শ্রবণ করা হয় এবং আমি মনে করি এটি খুতবার দাবীও।
কাঁঠালবাগ মসজিদের মতই তাকওয়া মসজিদেও সাড়ে বারোটায় উপস্থিত হয়ে প্রথম ফ্লোরে জায়গা না পেয়ে পরের তলায় স্থান নিতে হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এখানে নামায আদায় হয়। আজকে একটু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করলাম। সাধারণত সাড়ে বারোটায় খতিব মহোদয় আলোচনা শুরু করেন। আজকে শুরু করলেন ১২-৪০ মিনিটে এবং মাঝে সুন্নাত পড়ার কোনো সুযোগ দিলেন না। আমি এতে অত্যন্ত খুশি এবং ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, পরে সুন্নাত পড়ার সময় দেয়াতে একটি বিরাট সংখ্যক মুছল্লির কাছে খুতবা শ্রবণ গুরুত্ব পায় না। আমি খুতবা বলতে মাতৃভাষায় আলোচনা ও ছানি খুতবা দু’টি মিলেই বুঝি।
খুতবা বা বক্তৃতা অবশ্যই মানুষের বোধগম্য হতে হবে। খুতবা একটি নছিয়ত, যার মাধ্যমে রসূলুল্লাহ (সা) তাঁর উম্মতকে দ্বীন বোঝার এক অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। সকলের জন্য খুতবা শ্রবণ তিনি অপরিহার্য করে দিয়েছেন এবং সে সময়ে সকল কর্ম (নামায ও যিকির) বাদ দিয়ে মনোযোগের সাথে খুতবা শোনার নির্দেশ প্রদান করেছেন। হাদিস থেকে জানা যায়, মসজিদে প্রবেশের সাথে সাথে প্রবেশকারীর আমলনামায় উট, গরু, ছাগল--- কুরবানির ছওয়াব ফেরেশতাগণ লিখতে থাকেন এবং খতিব মহোদয় মিম্বরে আরোহণের সাথে সাথে ফেরেশতাগণ লেখা বন্ধ করে খুতবা শোনা শুরু করেন। খুতবা শুরুর পূর্বেই শতভাগ মুছল্লির মসজিদে উপস্থিত হওয়া উচিত এবং আমি মনে করি, পরে যারা মসজিদে উপস্থিত হন তাদের নামায অপূর্ণ হয়। (এ কথাগুলো ফেকাহর মাসালা নয়, কারণ ফেকায় অনেক সহজ করা হয়েছে এবং সেটিই স্বাভাবিক। এ সবই গুরুত্ব অনুধাবন ও উপলব্ধির বিষয়।)
আমি নিজে হানাফী মাজহাবের অনুসারী হলেও আহলে হাদিস ও সকল মাজহাবকে সত্যপন্থী মনে করি এবং মাজহাব নিয়ে বিরোধকে ঘৃণা করি ও এসব নিয়ে ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে দলাদলি সৃষ্টিকে কুফুরি মনে করি। ইমাম আবু হানিফা (রহ) বলেন, ‘আমার মতের বিপক্ষে কোনো হাদিস পাওয়া গেলে সেটিই আমার মত’। ২০১২ সনে সস্ত্রীক হজ্জ করার সময় ড. আব্দুল্লাহ বিন বাজ (রহ)-এর লেখা রসূল (সা)-এর নামায বইটি আমার হাতে আসে এবং গভীর মনোযোগের সাথে সেখানকার নামায, জু’মার খুতবা অবলোকন করি। হজ্জ থেকে আসার পর বুখারি শরীফের নামায অধ্যায়টি খুঁটিনাটিসহ পড়ার পর নিজেই ‘রসূল (সা)-এর নামায’ একটি প্রবন্ধ লিখি এবং সে সময়ে পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়।
মক্কা ও মদীনায় লক্ষ্য করেছি, মসজিদে কেবল আযানের সময় উল্লেখ থাকে এবং নামায পড়ানো বা খুতবা দান একান্ত ইমাম/খতিব মহোদয়ের (এটি ইমাম/খতিবের মর্যাদা এবং ধরে নেয়া হয় তাঁরা দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন)। একটি নির্দিষ্ট প্রবেশ পথ দিয়ে খতিব মহোদয় মিম্বরে আরোহণ করলে আযান হয় এবং তিনি খুতবা শুরু করেন। নামাযের সময়েও তদ্রুপ ইমাম সাহেবের দাঁড়ানোর পর মুয়াজ্জিন একামত দেন। মক্কা-মদীনায় আযানের বাক্যগুলো দু’বার ও একামতের বাক্যগুলো একবার উল্লেখ করা হয় এবং বুখারি শরীফেও তাই রয়েছে। সেখানে নামায শেষে কোনো সামষ্টিক মোনাজাত নেই এবং তাকওয়া মসজিদেও করা হলো না। কাঁঠালবাগ মসজিদেও সামষ্টিক না করে যার যা প্রয়োজন আল্লাহর কাছে একাকী পেশ করার জন্য বলা হয়। আলহামদু লিল্লাহ।
ইবাদত হুবুহ আল্লাহর রসূল (সা)-এর পূর্ণ অনুকরণ করে করতে হবে এবং কোনো বিষয়ে রসূল (সা)-এর আমলে ভিন্নতা থাকলে (এ কারণেই বিভিন্ন মাজহাবের উদ্ভব) সবার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতে হবে, তবে বিদয়াতকে অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। বিদয়াত মেনে নিলে রসূল (সা)-এর প্রতি অপবাদ দেয়া হয় যে, তিনি দায়িত্ব পালনে অপূর্ণাঙ্গতা রেখেছেন (নাউজুবিল্লাহ)। কোনো মাজহাবই বিদয়াতকে সমর্থন করে না।
জু’মার দিন খুতবা দানের নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে মসজিদে উপস্থিত হয়ে সুন্নাত নামায আদায় করে খুতবা শোনার জন্য মুছল্লিদের ধীরস্থিরভাবে বসে পড়া উচিৎ। খুতবা শ্রবণ ওয়াজিব এবং জু’মার নামাযের একটি অংশ- মুছল্লিদেরকে এটি উপলব্ধি করাতে হবে। খুতবা দানের লক্ষ্যে খতিব মহোদয় মিম্বরে আরোহণ করার সাথে সাথে মুয়াজ্জিন সাহেব আযান দিবেন এবং খতিব মহোদয় মাঝে বিরতিসহ (বিরতির পর ছানি খুতবা) টানা খুতবা দিবেন। খুতবা শেষে মুয়াজ্জিন সাহেবের একামতের সাথে সাথে নামায শুরু হয়ে যাবে এবং এমনই লক্ষ্য করেছি মক্কা ও মদীনায়। আমার জানা মতে রসূল (সা) ও সাহাদের (রা) আমলও এমনই। এমনটি হলে আশা করা যায় মুছল্লিরা সময়মত উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হবে এবং নফল নামায পড়ার চেয়ে ওয়াজিব খুতবা শ্রবণের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবে। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাওফিক দান করুন।
খুতবার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা :
আল্লাহর হামদ ও রসূল (সা)-এর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ করার পর মসজিদে তাকওয়ার সম্মানিত খতিব আলহাজ্জ হাফেজ মাওলানা মুফতি সাইফুল ইসলাম দেশে হত্যাকান্ড বেড়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং নরহত্যার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আলোচনা করেন। হত্যাকান্ডের সূচনা প্রসঙ্গে সূরা মায়েদার ২৭ নং আয়াত উদ্ধৃত করে তিনি বলেন হযরত আদম (আ)-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিল। তারা আল্লাহর নামে কুরবানি করেন কিন্তু আল্লাহ হাবিলের কুরবানি কবুল করায় কাবিল ক্ষুব্ধ হয়ে তার ভাইকে হত্যা করে। কাবিলই নরহত্যার সূচনাকারী এবং হাদিসের বর্ণনানুসারে দুনিয়ায় সকল হত্যাকান্ডের পাপের একটি অংশ কাবিলের আমলনামায় জমা হবে।
কুরআন ও সুন্নায় নরহত্যাকে জঘন্য অপরাধ এবং পরিণতি জাহান্নাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে এর ভয়াবহতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করা এবং একজন মানুষকে বাঁচিয়ে দেয়া সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করার শামিল (আল মায়েদা-৩২)। হত্যা-রাহাজানি বেড়ে যাওয়াকে তিনি কিয়ামত সংঘটনের আলামত বলে উল্লেখ করেন। মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার দুনিয়ার শাস্তি তাকে হত্যা করা, আখিরাতের শাস্তি তো আছেই। রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, একজন মু’মিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার চাইতে সমগ্র বিশ্বকে ধ্বংস করে দেয়া আল্লাহর কাছে লঘু অপরাধ। তিনি আরো বলেন, ‘আকাশ ও পৃথিবীর সকল প্রাণীও যদি একজন মু’মিনের হত্যায় শরীক থাকতো, তবে তাদের সকলকে আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করতেন’। মুসলিম-অমুসলিম সকল হত্যাকান্ডের পরিণতি একই। রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ ৪০ বছরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়’।
সূরা বনী ইসরাঈলের ৩৩ নং আয়াত উদ্ধৃত করে খতিব মহোদয় বলেন, নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারকে কিসাস গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। তবে কিসাস গ্রহণের ক্ষেত্রে যেন বাড়াবাড়ি না করা হয়। বাড়াবাড়ি বলতে একজনের পরিবর্তে অন্য কাউকে বা একাধিক ব্যক্তিকে বা হত্যাসহ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া ইত্যাদি বোঝায় যা জাহেলি জামানায় হতো এবং বর্তমানেও চলছে। নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকার সাহায্য প্রাপ্ত হবে। ইসলামী রাষ্ট্র বা সরকার বিচারের দায়িত্ব গ্রহণ করবে এবং এ ব্যাপারে আল্লাহপাকেরও সাহায্য রয়েছে। সাধারণত স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বা সামাজিক ও রাজনীতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির পথে বাধার কারণে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রায়ই দেখা যায় নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারকে আল্লাহপাক সামাজিক ও রাজনীতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেন।
দেশে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বন্যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দুঃখ-দুর্দশা তিনি তুলে ধরে বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মুছল্লিদের প্রতি আহবান জানান। নিজেদের দান-সাদাকা প্রদানের পাশাপাশি বন্যার কারণে সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহায্যার্থে করজে হাসানা প্রকল্প গড়ে তোলার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেন। করজে হাসানা অর্থ হিতকারি ঋণ। সময়মত পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তাদেরকে অবকাশ প্রদান এবং অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ না করা। তিনি বলেন, মুসলমানদের জীবনে বিপদ-মুছিবত সবই তাদের হাতের কামাই এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা। এই সময়ে উচিৎ আল্লাহপাকের নাফরমানি পরিত্যাগ করে তাঁর একান্ত অনুগত বান্দাহ হয়ে যাওয়া। আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হয়ে চলার জন্য তিনি তাওফিক কামনা করেন। সংক্ষেপিত।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment