হেরা গুহায় ওহীপ্রাপ্ত হওয়ার কয়েকদিন পরই সূরা আল মুদ্দাস্সিরের শুরুতে আল্লাহপাক তাঁর নবীকে (সা) ডেকে বলেন, ‘ওঠো মানুষকে সাবধান করো। তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো’। আল্লাহপাক দয়া করে যাদের হেদায়াত দান করেছেন তাদের কর্তব্য হলো আল্লাহর যে সব বান্দাহ তাঁকে ভুলে আছে ও তাঁর নাফরমানি করছে তাদেরকে জাহান্নামের পথ থেকে ফিরিয়ে আনা। এ পেরেশানি তাদের মাঝে থাকতেই হবে। নবুয়ত লাভের পর রসূল (সা)-এর প্রথম ও প্রধান কাজ ছিল মানুষের কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। এব্যাপারে তিনি সামান্যতম অবহেলা করেননি। সব ধরনের নিন্দাবাদ, গালমন্দ, নির্যাতন উপেক্ষা করে দিনরাত তিনি মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন। তাঁর দাওয়াতে যারা সাড়া দিয়েছেন তারা জানতে চেয়েছিল, ‘আমাদের কাজ কী’? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার যে কাজ তোমাদেরও তাই’।
মুসলমান মাত্রই একজন দ্বায়ী ইলাল্লাহ। এই দাওয়াত প্রদান থেকে সে একটি মুহূর্ত নীরব থাকতে পারে না। তার কথা, লেখনী, আমল-আখলাক সকল ক্ষেত্রে প্রকাশ পাবে যে, সে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবানকারী। সূরা আছরে আল্লাহপাক কসম খেয়ে বলেছেন, ধ্বংস থেকে বাঁচার উপায় হলো ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে মানুষকে হকের দিকে ডাকা ও ধৈর্যধারণ করা। এই কথাগুলো বলার জন্য আল্লাহ কসম খেয়েছেন, আবার বলেছেন নিশ্চয়ই ও লাফি-এর (লাফি খুসরিন) মধ্যেও তাগিদ রয়েছে। বিদায় হজ্জের ভাষণে তাঁর উম্মতকে তাগিদ দিয়ে বলে গেলেন, আমার কাছ থেকে একটি কথা হলেও তা অপরের কাছে পৌঁছে দাও।
একজন দ্বায়ী ইলাল্লাহর প্রশংসা করে আল্লাহ বলেছেন, ‘তার চেয়ে ভালো কথা আর কার হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে নেক আমল করে এবং বলে, আমি একজন মুসলমান’। আমাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধব আল্লাহর নাফরমানি করে জাহান্নামে যাবে, আর ঈমান ও নেক আমলের পুঁজি নিয়ে আমরা ঘরে বসে থাকবো এমন স্বার্থপর ব্যক্তি আল্লাহর পছন্দ নয়। দাওয়াতে দ্বীনের কাজ মূলত জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহরই কাজ। সূরা সফে আল্লাহ বলেছেন, তিনি তাদেরই ভালোবাসেন যারা দলবদ্ধভাবে আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা চালায়। তাই যারা আল্লাহর বন্ধু হতে চায় মানুষের কাছে আল্লাহর গোলামীর (ইবাদত) কথা তাদের কাছে পৌঁছাতেই হবে। সকল নবী-রসূলের এটিই ছিল প্রথম ও প্রধান কাজ।
দাওয়াতের কাজ সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য একজন দ্বায়ীর চরিত্র বা তার মধ্যে কী ধরনের গুণাবলী থাকা দরকার সেটি আমরা আলোচনা করার চেষ্টা করবো। মূলত মুহাম্মদ (সা)-কে আমাদের জন্য মডেল হিসেবে আল্লাহ পাঠিয়েছেন এবং তাঁকে অনুসরণ করা ফরজ করে দিয়েছেন। সকল কাজে-কর্মে, আচার-আচরণে তাঁকে অনুসরণ করে নিজেকে তৈরী করতে পারলে মানুষের কাছে আমাদের দাওয়াত ফলপ্রসু হবে। উত্তম চরিত্রের কারণে মুহাম্মদ (সা) মক্কাবাসীদের কাছে ছিলেন সমাদৃত। ফলে কাফির সরদারদের হাজারো মিথ্যাচার ও জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে অনেকেই রসূল (সা)-এর দাওয়াত কবুল করেছিলেন।
একজন দ্বায়ী ইলাল্লাহর গুণাবলী আল্লাহপাক নানাভাবে উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে সূরা ইয়াসিনের দ্বিতীয় রুকুতে একটি কাহিনীর উল্লেখ থেকে আমরা মৌলিক গুণ জানতে পারি। একটি জনপদে দু’জন রসূলকে প্রেরণ করা হয় এবং পরবর্তীতে তাঁদের সাহায্যার্থে আরো একজনকে রসূল হিসেবে পাঠানো হয়। দীর্ঘ চেষ্টা-প্রচেষ্টায় মাত্র একজন লোক ঈমান এনে মুসলমান হন। তখন তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর জাতির বড় সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। ছুটে আসেন তার জাতির কাছে এবং বলেন, তোমরা আনুগত্য করো সেই লোকদের যারা তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চান না এবং নিজেরা হেদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
এখানে দু’টি গুণের উল্লেখ করা হয়েছে। এক. মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকার পেছনে দ্বায়ীর দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ নেই। সে একজন নির্লোভ ব্যক্তি এবং তিনি তার কাজের বিনিময় আশা করেন কেবল আল্লাহর কাছে। দ্বিতীয়ত. সে যে বিষয়ে মানুষকে ডাকে নিজে তা আমল করে। অর্থাৎ সে তো আল্লাহর গোলামীর দিকে মানুষকে ডাকে এবং কথা-কাজ ও আচরণে পূর্ণরূপে আল্লাহর গোলাম হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে। আল্লাহর গোলামীর বাইরে তার কোনো জীবন নেই। আমানতদারিতা, প্রতিশ্রুতি পালন, লেনদেন সকল কাজে-কর্মে সে পূর্ণভাবে আল্লাহর গোলাম।
যেহেতু মুসলমান মাত্রই দ্বায়ী ইলাল্লাহ। ফলে তার কথা ও কাজে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা যা বলি অনেক সময় তা নিজেরা করি না। সূরা ছফে আল্লাহপাক ঈমানদারদের সম্বোধন করে বলেছেন, এমন কথা তোমরা কেন বলো যা নিজেরা করো না, এটি আল্লাহর কাছে বড়ই ক্রোধ উদ্রেগকারী বিষয়, তোমরা যা বলো তা নিজেরা করো না। মুসলমান আজ নিজে ইসলাম থেকে দূরে অবস্থান করছে, ফলে একটি কদর্য চরিত্র তার মধ্যে বিরাজ করছে। মানুষ শুধু তার থেকে প্রতারিতই হচ্ছে। অথচ আল্লাহপাক মুসলমানকে কল্যাণকামী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন শ্রেষ্ঠতম উম্মত, সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। অথচ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা এই মুসলমান না করে। ফলে সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের দাওয়াতে না তার ব্যক্তি-চরিত্রে, আর না সমাজে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ইসলামকে যারা জীবনোদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং আখিরাতের মুক্তিই যাদের একমাত্র কামনা তাদেরকে রসূল (সা)-এর রঙে রঞ্জিত হতে হবে। নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। আস্থা অর্জন করতে হলে চরিত্রের পরিশুদ্ধি এবং জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হতে হবে। আল্লাহর রসূল (সা) সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো ব্যক্তি ছিলেন না। নবী হওয়ার পূর্ব থেকেই সততা, আমানতদারিতা, প্রতিশ্রুতি পালন, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশির সাথে সদাচরণের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জনে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন।
বর্তমান দেশে নৈতিকতার ধ্বস নেমেছে। সবার প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই মুহূর্তে যারা চারিত্রিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে ময়দানে অবস্থান করবে এবং ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে আশা করা যায় জনতার আস্থা তাদের ওপরই আসবে। আল্লাহপাক তাঁর ঈমানদার জনগোষ্ঠীকে দুনিয়ায় খেলাফত দান করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শর্ত হলো ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হতে হবে। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর নিষ্ঠাবান বান্দা হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন। ১৯.০৮.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment