Skip to main content

দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন অপেক্ষা আখিরাতের স্থায়ী জীবনই মু’মিনের কাম্য

তোমাদের যা কিছু দেয়া হয়েছে তা দুনিয়ার জীবনের ক্ষণস্থায়ী সামগ্রী মাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা কিছু রয়েছে তা উত্তম ও স্থায়ী। তা সেই সব লোকের জন্য যারা ঈমান আনে ও তাদের রবের ওপর নির্ভর করে, যারা বড় বড় গুনাহ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকে এবং ক্রোধ হলে ক্ষমা করে, যারা তাদের রবের ডাকে সাড়া দেয়, নামায কায়েম করে এবং নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে, আমি যা রিযিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করা হলে তার মোকাবেলা করে। খারাপের প্রতিদান সমপর্যায়ের খারাপ। কিন্তু যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপস করে চলে তাকে পুরস্কৃত করা আল্লাহর দায়িত্ব। আল্লাহ যালেমদের পছন্দ করেন না। সূরা আশ শূরা ৩৬-৪০ দুনিয়ার জীবনে আমাদের অবস্থান, স্থায়িত্ব ও ভোগ-ব্যবহার নিয়ে চিন্তা করলে আল্লাহর ঘোষণা খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। সীমাহীন এই বিশ্বজগতে আমাদের পৃথিবী খুবই ক্ষুদ্র, কতো ক্ষুদ্র কল্পনা করাও কঠিন। পৃথিবীর বিশালায়তনের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান এবং সেই বাংলাদেশে আমার অবস্থান অতি নগণ্য। আবার বিশ্বজগত ও পৃথিবীর জন্ম এবং মানুষের আবির্ভাব এবং এর স্থায়িত্বও আমার জানা নেই। তবে আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই পৃথিবীতে আমার অবস্থান বড়জোর শতবর্ষ এবং সেটি হলে আমার জন্য হবে তা বিশাল পাওনা। তারপরও বার্ধক্য বলে কথা, সেটি আর এক বিড়ম্বনা। সুস্থভাবে জীবন-যাপন আল্লাহপাকের বড় অনুগ্রহ। দুনিয়ার জীবনে উপার্জনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা, তারপর উপার্জন করে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য চলে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। মনে করি, আমি হলাম পৃথিবীর সেরা ধনীদের একজন। এরপর আমার এই ধন-সম্পদ আমি কতটুকু ভোগ-ব্যবহার করতে পারি। হয়তো আমার ৫০টি গাড়ি আছে, দেশ-বিদেশে মিলে ১০০টি বাড়ি আছে। কিন্তু একটি সময়ে মাত্র ১টি গাড়ি এবং ১টি বাড়িই আমি ব্যবহার করতে পারি। আবার একটি বাড়িতে হয়তো হাজারটি দুয়ার ও সমসংখ্যক কক্ষ আছে। কিন্তু আমি মাত্র একটি কক্ষই ব্যবহার করতে পারি। এ দুনিয়ায় ধনী-দরিদ্র যে কোনো ব্যক্তি খুব সামান্যই ভোগ করতে পারে। মৃত্যুর সাথে সাথে সবকিছু রেখে একেবারে খালি হাতে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করতে হয়। নবী-রসূলগণ মৃত্যুর পরে আমাদেরকে আর একটি জগতের সন্ধান দিয়েছেন। সেটি হতে পারে আল্লাহর ভাষায় উত্তম-উৎকৃষ্ট এবং স্থায়ী, আবার ভিন্নতরও হতে পারে। রসূল (সা) থেকে আমরা সেখানে দু’ধরনের পরিণতির কথা জানতে পারি। একটি আনন্দ ও সুখভোগের স্থান জান্নাত এবং বিপরিত ভয়াবহ দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণার স্থান জাহান্নাম। জান্নাতের বিশালায়তন, এর উপভোগের সামগ্রীর যে বর্ণনা আমরা পাই তা দুনিয়ার কোনো কিছু দিয়ে কল্পনা করা সম্ভব নয়। সেখানে না আছে কোনো রোগ-ব্যাধি, না আছে বার্ধক্য, না আছে কোনো কটু কথা ও দুঃখ-যন্ত্রণার কোনো বিষয়। কেবলই সুখ, সুখ আর সুখ। মোট কথা জান্নাতে সে যা চাবে তাই পাবে। দুনিয়ার জীবনে সকল চাওয়া পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয় কিন্তু আখিরাতে বান্দার কোনো চাওয়া অসম্পূর্ণ থাকবে না। আর সে জীবনটা হবে চিরস্থায়ী, শুরু আছে যার কোনো শেষ নেই। আখিরাতে স্থায়ী জীবনের সুখ-সম্ভোগের অধিকারী ব্যক্তিবর্গের কিছু গুণাবলী আল্লাহপাক আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। জান্নাতের অধিকারী হওয়ার জন্য প্রথম যে গুণের কথা বলা হয়েছে, সেটি হলো ঈমান। ঈমানদার ব্যক্তি মাত্রই আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার কথা তিনি নানাভাবে বলেছেন। অর্থাৎ দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-মুছিবত সকল অবস্থায় সে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হয়ে ধৈর্যধারণ করে, আবার ক্ষমতা ও ধন-সম্পদ পেয়ে সে অহঙ্কারী না হয়ে তার রবের অনুগ্রহ মনে করে সে হয় বিনয়ী ও আল্লাহর বান্দাদের প্রতি দয়ার্দ। দ্বিতীয়ত যে গুণের কথা বলা হয়েছে তা হলো, সে বড় বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে থাকে। আল্লাহপাক মানুষের প্রকৃতিতে গুনাহ ও নেকির একটি উপলব্ধি দান করেছেন। তারপরও আল্লাহ নবী-রসূলদের মাধ্যমে নানাভাবে তা বর্ণনা করেছেন। মূলত কবিরা গুনাহ বলতে অধিকার হরণকে বোঝায়, সেটি আল্লাহর হোক বা তাঁর বান্দাহ ও সৃষ্টির হোক। আল্লাহর হক হলো, মানুষ একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর হুকুম পালন করবে এবং হুকুম পালনে তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করবে না। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দার প্রতি যে সব হুকুম ফরজ করেছেন তা অমান্য করা কবিরা গুনাহ। সব ধরনের অশ্লীল কাজ কবিরা গুনাহ, তারপরও গুরুত্ব বোঝাতে এটি পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ জান্নাতপ্রত্যাশী আল্লাহর কোনো বান্দাহ দ্বারা অশ্লীল কাজ সংঘটিত হয় না, হোক তা পর্দাহীনতা, নগ্নতা, বেহায়াপনা বা যিনা-ব্যাভিচার। জান্নাতি লোকদের আর একটি বড় গুণ হলো, ক্রোধ হলে তারা ক্ষমা করে। অর্থাৎ এরা প্রতিশোধপরায়ণ নয়; পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে তারা প্রশস্ততা ও উদারতা প্রদর্শন করে। ক্ষমার বিষয়টি কুরআন ও হাদিসে নানাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা লাভের সহজ উপায় হিসেবে তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করার কথা হাদিসে বলা হয়েছে। ভাষাটি এমন, ‘যে তার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার অপরাধ ক্ষমা করবেন’। রবের ডাকে সাড়া দেয়ার মাধ্যমে তাঁর সকল হুকুম পালনের বিষয় চলে আসে। গোলাম মনিবের হুকুম পালনের জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। নামায ও যাকাতের গুরুত্ব উপলব্ধির জন্য পৃথকভাবে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। নামাযের সময় হলে সে ছুটে যায় আল্লাহর ঘরে, আবার রমযান মাস এলে রোযা পালন করে, হিসাব করে যাকাত আদায় করে ও হজ্জ পালন করে। আল্লাহর হুকুম পালনের ক্ষেত্রে তার মধ্যে কোনো শৈথিল্য নেই। মু’মিনদের একটি বড় গুণ হলো, নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে তারা পরামর্শ করে। অর্থাৎ যেখানে একাধিক ব্যক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্টতা আছে সেখানেই পরামর্শ। জান্নাতপ্রত্যাশী লোকেরা স্বৈরাচার হয় না। নিজেকে বড় মনে করে অহঙ্কারী হয় না। যেখানে আল্লাহর বিধান পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ হয় সেখানে কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় ও কাজে বরকত হয়। মু’মিন কৃপণ ও অর্থলোলুপ হয় না। তার সম্পদে নিজের অধিকারের সাথে সাথে আল্লাহর হক ও তাঁর বান্দাদের হক স্বীকার করে এবং আদায় করে। বাড়াবাড়ি করলে মোকাবেলা করে অর্থাৎ মু’মিন ভীরু ও কাপুরুষ হয় না। মু’মিন যেমন উদার ও ক্ষমা করতে জানে, সাথে সাথে জালেমের জুলুমের বদলা নিতেও জানে। সব সময় ক্ষমা করার নীতি অবলম্বন করলে জালেমের জুলুমের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই তাকে থামিয়ে দেয়ারও প্রয়োজন হতে পারে। তবে সীমালঙ্ঘন করা যাবে না। অর্থাৎ থাপ্পড়ের বিনিময়ে লাঠির আঘাত নয়। অন্যায়ের প্রতিবিধান সমপরিমাণ অন্যায়। সন্তান অন্যায় করেছে তজ্জন্য পিতাকে আঘাত করা বা বাড়িঘর ভাংচুর করা যাবে না, যেটি সাধারণত হয়ে থাকে। সবচেয়ে উত্তম হয় ক্ষমা করে দিয়ে পরস্পর সংশোধন করে নেয়া। এমতাবস্থায় মজলুমকে পুরস্কৃত করা আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যায়। জালেম আল্লাহর কাছে চরম ঘৃণার পাত্র এবং জালেমকে তিনি শাস্তি দেবেনই। জালেমকে শাস্তি দানের ক্ষেত্রে সব সময় তিনি আখিরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন না; দুনিয়াতেই দিয়ে থাকেন। আখিরাতে চিরস্থায়ী সুখের স্থান জান্নাতে যাওয়ার লক্ষ্যে তাঁর বর্ণিত গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার তাওফিক আল্লাহ আমাদের সবাইকে দান করুন। আমিন। ১১.০৮.২০২০

Comments