Skip to main content

নৈতিক গুণাবলীসম্পন্ন মু’মিনরাই সফলকাম

‘নিশ্চিত কল্যাণ লাভ করেছে ঈমান গ্রহণকারী লোকেরা যারা নিজেদের নামাযে ভীতিমিশ্রিত বিনয় অবলম্বন করে, যারা বেহুদা কাজ থেকে দূরে থাকে, যারা যাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর, যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, তবে নিজেদের স্বামী-স্ত্রী এবং (পুরুষের বেলায়) নিজেদের মালিকানাধীন (দাসী)-দের ওপর (এ বিধান প্রযোজ্য) নয়। এ ক্ষেত্রে (হেফাজত না করা হলে) তারা কিছুতেই তিরষ্কৃত হবে না। অবশ্য এ ছাড়া অন্য কিছু চাইলে তারাই হবে সীমালঙ্ঘনকারী। যারা তাদের আমানত ও ওয়াদা-চুক্তির রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং নিজেদের নামাযসমূহের পূর্ণ হেফাজত করে। এ লোকগুলোই হচ্ছে (মূলত যমীনে আমার যথার্থ) উত্তরাধিকারী, জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী; সেখানে চিরকাল থাকবে’- সূরা আল মু’মিনুন ১-১১ সূরা আল মু’মিনুন মক্কীযুগের মাঝামাঝি সময়ে অবতীর্ণ। সে সময়ে যারা ঈমান এনেছিলেন বাহ্যত তারা নানাভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সমাজের অপেক্ষাকৃত সজ্জন ও যুবকরাই রসূল (সা.)-এর দাওয়াতে সাড়া দিয়েছিলেন। তাদের এই সাড়া দেয়াকে অনেকে চরম বোকামী ও ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেছিল এবং নির্বুদ্ধিতার কারণেই নাকি তারা বিপদের মুখে পড়েছিল। নিজেদের আত্মীয়-স্বজন-বংশ ও পাড়া-প্রতিবেশি সবার কাছ থেকে তারা উপেক্ষা ও নিন্দাবাদ এবং ইসলামের দুশমনদের কাছ থেকে নানাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করছিলেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়-‘নিশ্চিত কল্যাণ লাভ করেছে ঈমান গ্রহণকারী লোকেরা’। আল্লাহতায়ালা যে ফালাহ বা কল্যাণের কথা বলেন তা দুনিয়া ও আখিরাত উভয়বিধ কল্যাণকেই বুঝায়। তৎকালীন সমাজের মানুষের আচার-আচরণ ও লেন-দেন সর্বত্রই একটা কদর্য চিত্র দৃশ্যমান ছিল। মারা-মারি, হিংসা-বিদ্বেষ, মিথ্যা-শঠতা-ধোঁকাবাজি, আমানত ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, নগ্নতা- বেহায়াপনা, যিনা-ব্যভিচার, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই সকল অপকর্ম সে সমাজে চালু ছিল। ঐতিহাসিকরা আইয়ামে জাহিলিয়াত বা অন্ধকার যুগ হিসেবে সেই সমাজটাকে আখ্যায়িত করেছেন। সেই সমাজের মানুষকে তিনি কালিমা তাইয়্যেবার দিকে আহবান জানালেন এবং তাঁর আহবানে যাঁরা সাড়া দিলেন তিনি তাঁদের শোনালেন দুনিয়ার এ জীবনই শেষ নয়; এরপর আর একটি জগত রয়েছে যেখানে মানুষের সকল কাজের হিসাব প্রদান করতে হবে এবং ভালো কাজের প্রতিদান জান্নাত ও মন্দ কাজের প্রতিফল জাহান্নাম দেয়া হবে। আখিরাতে জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। সেই পরিবর্তিত হওয়া (সফলকাম ব্যক্তিবর্গ) মানুষগুলোর চরিত্রবৈশিষ্ট্যই এই সূরার শুরুতে তুলে ধরা হয়েছে। সফলকাম ব্যক্তিদের গুণ শুরু করা হয়েছে নামায দিয়ে অর্থাৎ যারা নামাযে ভীতিমিশ্রিত বিনয় অবলম্বন করে। নামাযে দন্ডায়মান হওয়া কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। বিশ্বজাহানের মালিক ও বাদশাহর সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়া। আমরা সাধারণত কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সম্মুখে উপস্থিত হতে হলে সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হয়ে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই উপস্থিত হই। অন্য কোনো ধরনের চিন্তা-ভাবনা সে সময়ে আমাদের মনে উদয় হয় না। নামাযের বিষয়টি তার চেয়ে কম গুরুত্বের নয়। তাই আযান হওয়ার সাথে সাথে সব কাজ বন্ধ রেখে একজন মু’মিন মসজিদ পানে ছুটে চলে। সে প্রমাণ করে যে সে আল্লাহর গোলাম এবং বারবার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে, ‘আমরা তোমারই গোলামী করি ও তোমারই কাছে সাহায্য চাই’। অন্তরের খুশু-খুজু (বিনয়) প্রকাশ পায় নামাযে তার একাগ্রতা এবং কিয়াম, রুকু-সেজদা ও নামাযে ফরজ-ওয়াজিব পালনে ধীরস্থিরতার মধ্য দিয়ে। নামাযরত এক ব্যক্তিকে দাঁড়ি নাড়াচাড়া করতে দেখে রসূল (সা) বলেন, নামাযে খুশু থাকলে সে এমনটি করতো না। মু’মিনের দ্বিতীয় গুণ উল্লেখ করা হয়েছে যে সে বেহুদা কাজ-কর্ম থেকে দূরে থাকে। মু’মিন মানে একজন শরীফ ব্যক্তি। অপ্রয়োজনীয়, গুরুত্বহীন ও অপরের নিন্দাবাদ বা আজে-বাজে কাজের সাথে মু’মিনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সময় অত্যন্ত দামী। অযথা ব্যয় করার মতো বিষয় নয়। মু’মিনের তৃতীয় গুণ হলো সে যাকাতের পন্থায় তৎপর। আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতা ও প্রবৃদ্ধি। নিজের অর্থ-সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করলে সম্পদ পবিত্র হয় এবং সম্পদের বৃদ্ধিও ঘটে। সাথে সাথে এ অর্থও প্রযোজ্য যে সে নিজের ও সমাজের পরিশুদ্ধি কাজে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকে। মু’মিনের চতুর্থ গুণ, তারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার বড় উদাহরণ হলো বল্গাহীন যৌনজীবন। যিনা-ব্যভিচার সব ধর্ম ও সমাজে অত্যন্ত ঘৃণ্য ও নিন্দনীয়। আবার ধার্মিকতার নামে অনেকে মানুষের যৌনচাহিদাকে একেবারে অবদমিত করে রাখতে চায়। ইসলাম মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে মানুষের বিবাহিত জীবন-যাপনকে অত্যন্ত পবিত্র ও উৎসাহিত করেছে। মু’মিনের পঞ্চম গুণ উল্লেখ করা হয়েছে এই বলে যে সে আমানত ও ওয়াদাচুক্তির রক্ষণাবেক্ষণ করে। অসংখ্য গুণের মধ্যে এখানে সফলকাম ব্যক্তিদের দু’টি গুণের বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সাথে সাথে এটাও বুঝতে হবে যে যাদের মধ্যে এ দু’টি গুণের অনুপস্থিতি রয়েছে তারা আর মু’মিন থাকে না; রসূল (সা.)-এর ঘোষণা মোতাবেক হয়ে পড়ে মুনাফিক। দু’টি গুণই ব্যাপক আলোচনার দাবী রাখে। ক. আমানত। কারো নিকট কোনো কিছু গচ্ছিত রাখলে যথাযথভাবে তা ফেরৎ দেয়া যেমন আমানত, তেমনি কারো ওপর কোনো দায়িত্ব অর্পিত হলে তা যথাযথভাবে পালন করাও আমানত। সন্তান-সন্ততি পিতা-মাতার কাছে আমানত আবার পিতা-মাতাও সন্তান-সন্ততির কাছে আমানত; মালিকের নিকট তার কর্মচারী আমানত আবার কর্মচারীর নিকট মালিকের হকও আমানত, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলের কাছে জনগণ আমানত আবার জণগণের কাছে দায়িত্বশীলের অধিকারও আমানত। আবার বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থা, অফিস-আদালত সর্বত্রই কর্তৃত্বশীলের কাছে অধীনস্থরা আমানত আবার অধীনস্থদের কাছে কর্তৃত্বশীলও আমানত। সবাই নিজ নিজ আমানত সংরক্ষণ করলে একটি মানব সমাজ শান্তি-সমৃদ্ধি ও কল্যাণের শীর্ষে আরোহণ করতে পারে। রসূল (সা.) বলেছেন- ‘আমরা যদি কাউকে কোনো ব্যাপারে দায়িত্বশীল করি, আর সে তার নিজের কাজ যতো নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করে, আমাদের অর্পিত দায়িত্ব যদি সেভাবে পালন না করে তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে উল্টা করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’। তিনি আরো বলেন- ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি যদি এক টুকরো সূতা বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে তাহলে কিয়ামতের দিন খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে’। রসূল (সা.)-এর এ কথাও স্মরণযোগ্য যে, কোনো ব্যক্তি তার মালিকের হক ও আল্লাহর হক যথাযথভাবে পালন করলে সে মালিক অপেক্ষা ৭০ বছর আগে জান্নাতে যাবে। পরস্পরের হক যথাযথ পালন না করার কারণে আজ মালিক তার অধীনস্থদেরকে সন্দেহ ও অবিশ্বাস করে এবং অধীনস্থরা মনে করে মালিক তাকে বঞ্চিত করছে। যার মধ্যে আমানতদারী নেই রসূল (সা.) তাকে মু’মিন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজী নন। তিনি বলেন- ‘যার মধ্যে আমানত সংরক্ষণ নেই তার ঈমান নেই’। খ. ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন। আল্লাহপাক ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালনকে কল্যাণপ্রাপ্ত মু’মিনদের অন্যতম গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দুর্ভাগ্য আমাদের। ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালনের বাধ্যকতা থেকে আমরা অনেক দূরে অবস্থান করছি। রাজনীতিক নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, বড় বড় আমলা ও সরকারী কর্মচারী কেহই আর ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালনে আন্তরিক নয়। ব্যবসায়ীদের একটি অংশ এখন ঋণখেলাপী। অর্থাৎ ঋণ নিয়ে সময়মত পরিশোধ করে না। এটা কোনো মুসলমানের চরিত্র নয়। এ সবই মুনাফিকদের চরিত্র। নির্বাচনের সামনে রাজনীতিকরা নানাভাবে লোভনীয় ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি প্রদান করে থাকে এবং বিজয়ী হওয়ার সাথে সাথে সব ভুলে যায়। সরকারি অফিস-আদালতে সবার প্রতি ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এটা জনগণের অধিকার। তারা সময়মত অফিস করবে এবং যথাসময়ে জনগণকে সেবা প্রদান করবে এটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ কোনো কাজ যদি ১০ মিনিটে সম্ভব হয় তাহলে তার জন্য আধা ঘন্টা সময় লাগানো জুলুম। আবার উপরি বা ঘুষ কোনো মু’মিন নয় কেবল পরকালে অবিশ্বাসী কাফির ও মুনাফিকরাই দাবী করতে পারে। ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী ব্যক্তি ধার্মিক নন। কারণ রসূল (সা.) বলেন- ‘ঐ ব্যক্তির ধর্ম নেই যার ওয়াদা-প্রতিশ্রুতির ঠিক নেই’। কোনো একটি জনপদের মানুষের মধ্যে আমানত সংরক্ষণ ও ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালনের বাধ্যবাধকতা থাকলে সে সমাজ দ্রুত সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে, কোনো সন্দেহ নেই। সে সমাজে সুশাসন নিশ্চিত হবে, মানুষ ন্যায়-ইনসাফ ভোগ করবে, পরস্পরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ, সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর হয়ে একটি শান্তি ও নিরাপদ সমাজে রূপ লাভ করবে। রসূল (সা.)-এর ছোঁয়ায় কেবল বিশ্বাসের বদৌলতেই আরবের বর্বর সমাজ থেকে বের হয়ে সে সব মু’মিনরা সর্বোত্তম চরিত্রে ভূষিত হয়েছিলেন এবং যাঁদের হাতে গড়ে ওঠেছিল মদীনায় একটি সফল ইসলামী সমাজ। কল্যাণপ্রাপ্ত লোকদের গুণাবলী শুরু করা হয়েছে ‘নামাযে বিনয় অবলম্বন করে’ এ কথা বলে আবার শেষও করা হয়েছে নামাযের কথা বলে (নামাযসমূহের পূর্ণ হেফাজত করে)। এ সব গুণের অধিকারীরাই এ যমীনে আল্লাহর যথার্থ প্রতিনিধি এবং এরাই জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকার। এই সূরাটি যখন রসূল (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয় তখন বলেন- এইমাত্র আমার ওপর ১০টি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, কেউ যদি এই মানে উত্তীর্ণ হতে পারে তবে তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা রয়েছে। ১৪/০৮/২০২০

Comments