সম্প্রতি করোনার মাঝে যশোরে বিয়ের গায়ে হলুদ উপলক্ষে পারলার থেকে সেজে মটর সাইকেল শোভাযাত্রা করে কনে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়। সেই শোভাযাত্রার পুরোভাগে থেকে কনে মটর সাইকেলে চড়ে নেতৃত্ব প্রদান করে। পত্র-পত্রিকায় সেই খবর সচিত্র ছাপা হয় এবং ফেসবুকে তা বেশ আলোচিত-সমালোচিত হয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক রীতিনীতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে সমাজে অশ্লীলতা ও বেয়াহাপনা ছড়িয়ে দেয়ার এক অপপ্রয়াস বলেই অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। লজ্জাশীলতা নারীচরিত্রের ভূষণ। বিয়ের কথা শুনলে স্বাভাবিকভাবে নারীর মাঝে লাজুকতা সৃষ্টি হয়। অনেক সময় বিয়ের মাহফিলে নারী কবুল শব্দ উচ্চারণ করে বেশ অস্ফুট স্বরে।
ধর্মীয় মূল্যবোধ ও রুচিবোধসম্পন্ন জনমানসকে আধুনিকতার নামে অশ্লীল ও উচ্ছৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্যেই মূলত এ ধরনের তৎপরতা। করোনাকালে মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার কথা। এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং মসজিদসমূহে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামায আদায় করা হচ্ছে। অথচ তারা ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সরকারি বিধিবিধান ও সামাজিক রীতিনীতি উপেক্ষা করে একটি মহড়া দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। আমাদের সমাজে এমন অনেকে আছেন যারা নামায-রোযা-যাকাত-হজ্জ ও দান-সাদাকায় খুবই আন্তরিক; কিন্তু ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে মানতে অনিচ্ছুক। এ ধরনের লোকদের ইবাদত-বন্দেগী আল্লাহর কাছে একেবারেই মূল্যহীন। বরং এদের জন্য রয়েছে দুনিয়ার জীবনে জিল্লতি ও আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব।
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম (জীবনব্যবস্থা)। মানুষের জীবনে উৎসব, আনন্দ-স্ফুর্তি ও তাদের হাসি-কান্না সকল কিছুতে ইসলাম একটি সীমারেখা দান করেছে। ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম। মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে ইসলাম অস্বীকার করে না, শ্লীলতার মধ্যে সে তার আনন্দ উপভোগ করবে সেটিই স্বাভাবিক। সামাজিক রীতিনীতি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে সেখানে আপত্তি করা হয়নি। ইসলামে নারী-পুরুষ সবার জন্য পর্দা ফরজ করা হয়েছে। নামায-রোযা-যাকাত-হজ্জ আনুষ্ঠানিক ইবাদতসমূহ যেমন ফরজ পর্দা করাটাও তেমনি ফরজ। পার্থক্য করার কোনো সুযোগ নেই। বরং পর্দাহীন নারীর স্বামী/পিতা/ভাই যদি পর্দাহীনতার ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ না করে হাদিসের ভাষায় তাদেরকে ‘দাইউস’ বলা হয়েছে এবং এরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। পর্দাহীন নারী-পুরুষ ফরজ লঙ্ঘনের অপরাধে জাহান্নামে যাবে (যদি তাওবা করে সংশোধিত না হয়)।
বিয়েকে রসূলুল্লাহ (সা) সুন্নাত করেছেন এবং তাঁর উম্মতদেরকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। কোনো কোনো সময় বিয়ে ফরজ-ওয়াজিব পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ইসলামে বিয়ে অত্যন্ত সহজ। মহরানা ধার্য করে দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে পরস্পর ইজাব কবুল করার মধ্য বিয়ে সম্পন্ন হয়। অবশ্য সেটা হতে হবে প্রকাশ্যে অর্থাৎ মহল্লাবাসী জানবে। নারীর সম্মান ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে মহরানা ফরজ করা হয়েছে। কিন্তু তা বরের সামর্থের মধ্যে করা হয়েছে। ইসলামের সোনালী যুগে বিয়েতে মহরানা কখনই বাধা হয়নি। ঘরে কিছুই নেই (লোহার একটি আংটিও না) এমন একজন সাহাবীকে কুরআন শিখিয়ে দেয়াকে মহরানা ধরে আল্লাহর রসূল (সা) বিয়ে দিয়েছিলেন।
দারিদ্রও বিয়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়নি। বরং বিয়ে করার মধ্য দিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে সচ্ছলতার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘তোমাদের মধ্যে যাদের স্ত্রী নেই, তোমরা তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করো, একইভাবে তোমাদের দাসদাসীদের মধ্যে যারা ভালো তাদেরও; যদি তারা অভাবী হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা অচিরেই তাঁর অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেবেন; আল্লাহ তায়ালা প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ’- সূরা নূর ৩২।
বয়োপ্রাপ্ত হলে ছেলে-মেয়ে বা বিপত্নীক পুরুষ বা বিধবা নারী ঘরে থাকলে অভিভাবককে বিয়ের ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছে। একটি বিষয় লক্ষণীয়, অসচ্ছল হলে তাকে সচ্ছল করে দেয়ার একটি ওয়াদা আল্লাহর পক্ষ থেকে করা হয়েছে। এব্যাপারে আবু বকর (রা)-এর উক্তি-‘বিয়ের ব্যাপারে আল্লাহর আদেশ মেনে চলো, তাহলে তিনি তাঁর ওয়াদা পূরণ করবেন’।
রসূলুল্লাহ (সা) ও সাহাবাদের (রা) যুগে নিজেদের চরিত্র হেফাজত করার লক্ষ্যে অনাড়ম্বর ও বাহুল্য বর্জিত হয়ে তাঁরা বিয়ে সম্পন্ন করেছেন। অধিকাংশ বিয়েতে মসজিদে আকদ হওয়ার পর ওলিমা হিসেবে খেজুর বিতরণ করা হয়েছে। সচ্ছল হলে রসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে বলেছেন, ছাগল জবেহ করে খানার ব্যবস্থা করো। কুফুও (বংশীয় ও আর্থিক বিষয়ে সমকক্ষতা) বাধা হয়নি। সম্ভান্ত কুরাইশ বংশীয় জয়নব (রা)-কে বিয়ে দেয়া হয়েছিল জায়িদ (রা)-এর মতো একজন দাসের সাথে। খলিফাতুল মুসলেমিন ওমর (রা) তাঁর ছেলেকে বিয়ে দিয়েছিলেন এক গরীব দুধ বিক্রেতার মেয়ের সাথে। বিয়ের ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ (সা) ধার্মিকতাকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলেছেন এবং তাতে ভবিষ্যৎ শুভ হবে বলে জানিয়েছেন।
আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা হিসেবে করোনা বিশ্ববাসীকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে। আমাদের সমাজজীবনে এনেছে নানা পরিবর্তন। অনেক লোককে একত্রিত করা বা প্রদর্শনীমূলক কাজ হ্রাস পেয়েছে। রসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ অনুসারে আমরাও বিয়েকে অনাড়ম্বর ও সহজ করতে পারি। বর্তমান সমাজে বিয়ে কঠিন এবং যিনা-ব্যাভিচার সহজ হয়ে পড়েছে। যিনা-ব্যাভিচার শুরু হয় পর্দাহীনতা, নগ্নতা, বেহায়াপনার মধ্য দিয়ে। হাদিসে যা চোখের যিনা,কানের যিনা ও যবানের যিনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিয়ে মানুষকে অনেক পাপ থেকে রক্ষা করে ও অন্তরে প্রশান্তি দান করে।
একটি মুসলিম সমাজে বিয়ে শুধু একটি সামাজিক চুক্তিই নয়, সাথে সাথে ইবাদতও। দুর্ভাগ্য, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় ইবাদতের অনুভূতিই ক্রমান্বয়ে লোপ পাচ্ছে। যশোরে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে যা ঘটলো তা অধিকাংশ বিয়ের অনুষ্ঠানে লক্ষণীয়, পর্দাহীনতা ও অশ্লীলতার যেন সয়লাব। পর্দা একজন মুসলিম নারীর ভূষণ, শরীফ বংশের পরিচায়ক; ভদ্রতা ও শালীনতার প্রতীক। আল্লাহপাক আমাদেরকে সব ধরনের অশ্লীলতা পরিহারের তাওফিক দান করুন। ২৭.০৮.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment