সৃষ্টির সেরা মানব জাতিকে আল্লাহপাক বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। সাথে সাথে ভালো ও মন্দ দু’টি প্রবণতা এবং ভালোকে ভালো ও মন্দকে মন্দ জানা তার প্রকৃতিতে দান করেছেন। তারপরও লোভ-লালসা ও শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ পৃথিবীতে নানাবিধ অন্যায়-অবিচার করে। বিবেক-বুদ্ধি দানের পরও আল্লাহপাক প্রথম মানুষ আদম (আ)-কে হেদায়াতসহ একজন নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন, যারা হেদায়াত অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই। তারই ধারাবাহিকতায় অসংখ্য নবী ও রসূল আল্লাহ দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন এবং সর্বশেষ নবী ও রসূল হলেন মুহাম্মদ (সা)।
নবী-রসূলদের শিক্ষা ভুলে গিয়ে মানুষ পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছে নানা অনাচার। মানবসৃষ্টির সূচনালগ্নে আদম (আ)-এর ছেলে কাবিল কর্তৃক ভাইকে হত্যার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে শুরু হয় আল্লাহর নাফরমানি। শয়তানের চ্যালেঞ্জ (মানুষকে আল্লাহ থেকে গাফেল করবে) আল্লাহপাক মেনে নিয়ে ভালো ও মন্দ করার স্বাধীনতা দিয়েই মানুষ ও শয়তানকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আসলে মানব জাতির জন্য আল্লাহ এই পৃথিবীকে করেছেন একটি পরীক্ষাগার এবং প্রশ্নও প্রকাশ করে দিয়েছেন। কল্যাণ ও অকল্যাণ স্পষ্ট করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন, তাঁর প্রদত্ত হেদায়াত যারা মেনে চলবে তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত নেয়ামতেভরা জান্নাত এবং যারা অমান্য করবে তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি জাহান্নাম।
আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ (হুকুমকর্তা) মেনে তাঁর আনুগত্য করার বিধান দিয়ে আল্লাহ নবী-রসূল পাঠিয়েছেন। সকলের দাওয়াত ছিল একই অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং রসূলকে মেনে নেয়া। মানুষ গোমরাহীর চরম পর্যায়ে উপনীত হলে সংশোধনের লক্ষ্যে আল্লাহপাক সেই সমাজে নবী-রসূল পাঠিয়েছেন। কোনো সমাজের মানুষই তাঁদেরকে সাদরে গ্রহণ করেনি। অথচ তাঁরা ছিলেন সেই সমাজে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। নবী-রসূলগণ সব সময়ই কঠিন বিরোধীতার মুখোমুখি হন। হক ও বাতিলের এই দ্ব›দ্ব চিরন্তন। নবী-রসূলদের সাথে সমসাময়িক স্বৈরশাসকদের দ্বন্দের ইতিহাস কুরআন মজিদে নানাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে রয়েছে মুসা (আ)-এর সাথে ফিরাউন ও ইব্রাহিম (আ)-এর নমরুদের দ্বন্দ্ব এবং আদ ও সামুদ জাতির মতো বিভিন্ন জাতির নাফরমানির নানা বর্ণনা।
সর্বশেষ নবী হিসেবে মুহাম্মদ (সা)-এর কালটা ছিল সবচেয়ে অধপতিত এবং ঐতিহাসিকরা একে আইয়ামে জহেলিয়াত বলে আখ্যায়িত করেছেন। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-হত্যা-রাহাজানিসহ হাজারো অপরাধে নিমজ্জিত ছিল সেই সমাজ। মানুষ কেনাবেচা হতো, নারী জাতির অবস্থা ছিল বড় করুণ, কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে পিতা অপমান বোধ করতো এবং জীবন্ত কবর দিতে কুণ্ঠিত হতো না। এমন সমাজে মুহাম্মদ (সা) ছিলেন ব্যতিক্রম। সকল মানবীয় সৎ গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। তিনি ছিলেন তাঁর জাতির কাছে আল-আমিন ও আস-সাদিক। সৎ বলে তিনি সমাজ বা জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন না। যুববয়সে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে যুবসংগঠন। তিনি ছিলেন আমানত সংরক্ষণকারী, বিবাদ-বিসংবাদ মিমাংসাকারী এবং কাবা শরীফে কালো পাথর প্রতিস্থাপনকারী হিসেবে মক্কার নেতৃবৃন্দ তাঁকেই পছন্দ করেছিলেন। সুদীর্ঘ ৪০টি বছর ধরে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তিনি সমাদৃত ছিলেন ও ছিলেন তাদের মাথার মুকুট।
সমাজের সমস্যায় তাঁর প্রাণ কাঁদতো। কিন্তু সমাধান তাঁর জানা ছিল না। ৪০ বছর বয়সে হেরাগুহায় ওহীপ্রাপ্তির পর আল্লাহর নির্দেশক্রমে তিনি মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেন। সমাজের কোনো সমস্যাকে চিহ্নিত করে তার সমাধান লক্ষ্যে তিনি কোনো ভূমিকা নেননি। ধনীর বিরুদ্ধে দরিদ্রদের, প্রভুর বিরুদ্ধে দাসদের বা পুরুষের বিরুদ্ধে নারীকে উস্কায়ে দেননি বরং সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে মানুষকে আহবান জানান, ‘হে দুনিয়ার মানুষ! তোমরা সবাই বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তাহলেই তোমরা সফলকাম হবে’। এই সহজ-সরল উক্তি মক্কাবাসীরা মেনে নিতে পারেনি। তাঁর আপন চাচা আবু লাহাবসহ সমাজের নেতৃবৃন্দ প্রচন্ডভাবে বিরোধীতা করে। নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী তাঁর বিরুদ্ধে জাতির সাথে গাদ্দারির কোনো অভিযোগ ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হয় হাজারো অভিযোগ ও নিন্দাবাদ। আল্লাহপাক স্বয়ং তাঁকে সান্ত¡না দেন, এ অবস্থা স্থায়ী হবে না এবং শীঘ্রই এর অবসান ঘটবে।
দাওয়াত দানের সাথে সাথে মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর সাথীদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন-নিপীড়ন। এটি নতুন নয়, অতীতেও যারা কালিমা তাইয়্যেবার দাওয়াত নিয়ে এসেছেন তাঁদের সাথেও একই আচরণ করা হয়েছে। করা হয়েছে সীমাহীন অত্যাচার, কল্পনাতীত জুলুম-নির্যাতন। স্বৈরশাসকরা এই দাওয়াতের মধ্যে নিজেদের পরাজয় উপলব্ধি করেছে; তাই সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। সর্বোত্তম চরিত্রের মানুষগুলোর কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে দেশছাড়া করেছে, কাউকে জেলখানায় আবদ্ধ করেছে। কিন্তু কোনো কিছুই তাঁদেরকে সত্য থেকে টলাতে পারেনি। এ দ্বন্দ্ব কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। দেশে দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার যে প্রচেষ্টা বা আন্দোলন চলছে তা ইসলামের দুশমনরা সহ্য করতে পারছে না। মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকরা ইসলামী আন্দোলনকে নাম দিয়েছে পলিটিক্যাল ইসলাম। নমরুদ, ফিরাউন, আবু জেহেলরা একই অপবাদ দিয়েছে। তারা মনে করতো নবী-রসূলরা সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে এবং তাদেরকে উৎখাত করতে চায়।
সকল নিপীড়ন-নির্যাতন উপেক্ষা করে মুহাম্মদ (সা) পরম ধৈর্যাবলম্বন করে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যান। একতরফা মার খেয়েছেন, কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নয়। আল্লাহর পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, হাত সংবরণ করো ও নামায কায়েম করো। দীর্ঘ তেরোটি বছর জুলুম-নির্যাতনের মোকাবেলায় পাল্টা একটি ব্যবস্থাও গ্রহণ করেননি। তাওহিদ, আখিরাত ও রেসালাতের বিশ্বাসের দাওয়াতের প্রেক্ষিতে যারা তাঁর সঙ্গী-সাথী হয়েছেন তাঁদেরকে তিনি পাপ-পঙ্কিল সমাজ থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী মৌলিক মানবীয় গুণসম্পন্ন ব্যক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হন। তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন এক একজন পরশ পাথর। সততা, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন, উত্তম আচরণ, বিপদাপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সর্বগুণে গুণান্বিত মানুষগুলো সহজেই সাধারণ মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হন। ফলে ঘৃণা, হিংসা-বিদ্বেষ ও জুলুম নির্যাতনের মধ্যেও মুহাম্মদ (সা)-এর সাথীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং প্রতিকূল পরিবেশে তাঁরা খাঁটি সোনায় পরিণত হন।
মুহাম্মদ (সা)-এর দাওয়াতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, পরিণতি ও ফলাফল সম্পর্কে তাঁর ও তাঁর সাথীদের স্পষ্ট ধারণা ছিল। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল আখিরাতের নাযাত যে সম্পর্কে বারবার মক্কীযুগের সূরাসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দ্বীন যে একদিন বিজয়ী হবে সে বিশ্বাসও তাঁদের মাঝে দৃঢ় ছিল। অত্যাচার-নির্যাতনে দিশেহারা সাহাবায়ে কেরাম (রা) আল্লাহর সাহায্য কামনার কথা বললে জবাবে রসূল (সা) বলেন, ‘জুলুম-নির্যাতনের আর দেখলে কী? অতীতকালে যারাই এ পথে অগ্রসর হয়েছেন তাঁদের ওপরই সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন নেমে এসেছে। কাউকে করাত দিয়ে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে, কাউকে লোহার চিরুণী দিয়ে তার শরীর থেকে গোশত পৃথক করা হয়েছে; তারপরও কেউ ঈমান ত্যাগ করেননি। সেদিন দূরে নয়, যেদিন একজন ষোড়শী স্বর্ণালঙ্করসহ সানা থেকে হাজরা মাউত একাকী হেঁটে যাবে, আল্লাহ ছাড়া তাকে আর কাউকে ভয় করতে হবে না’। মুহাম্মদ (সা) সেদিন তাঁর সাথীদেরকে একটি নিরাপদ সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
এই যমীনে মু’মিনদের খেলাফত দানের জন্য আল্লাহপাক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখানে তিনি শর্ত আরোপ করেছেন ঈমান ও ঈমানের দাবী অনুসারে নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়ার (সূরা নূর ৫৫)। সমাজের সকল অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত থেকে নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ রাখতে সক্ষম হলে এবং মানুষের কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে পারলে ইনশা-আল্লাহ আখিরাতে ক্ষমার পাশাপাশি আল্লাহপাক এ দুনিয়াতেও তাদের বিজয় দান করবেন। সে সময়ে তাদের সকল দুঃখ-কষ্টের অবসান হবে এবং তারাসহ সব মানুষ পাবে মুক্তির স্বাদ। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমাপ্রাপ্তির উপযোগী গুণাবলী সম্পন্ন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন। ১৮.০৮.২০২০
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment