জু’মা বক্তৃতা
০৭.০৮.২০২০
আজ মিরপুর কাঁঠালবাগ জামে মসজিদে জু’মার খুতবায় সম্মানিত খতিব আলহাজ্জ মাওলানা মাহমুদুল হাসান আশরাফী আল্লাহর হামদ ও রসুল (সা)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশের পর সাহাবায়ে কেরামের (রা) মর্যাদা এবং মায়ের প্রতি ভক্তি ও তাঁর হেদায়াতের জন্য হযরত আবু হুরাইরা (রা)-এর মনের আকুতি তুলে ধরেন।
করোনাকালে বাড়ি থেকে আসার পর ঢাকায় এই প্রথম জু’মা আদায়। এক সময় ঘরকে মসজিদে রূপান্তর করে নিলেও এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে জামায়াতের সাথে আদায় করছি। আলহামদু লিল্লাহ। অবশ্য বাড়ি থেকেই মসজিদে নামায আদায় শুরু করেছিলাম। ঢাকায় মসজিদসমূহে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়। মসজিদে প্রবেশের সময় শরীরের তাপ পরীক্ষার (আমার ছিল ৯৭.৫) সাথে হাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয়। মুছল্লিদের অধিকাংশই মাস্ক পরিহিত (২/১ জন বাদ) এবং হাতে জায়নামায ও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কাতারে (অর্থাৎ মাঝখানে একজন দাঁড়াতে পারবে) সবাই দাঁড়ায়। ফলে মসজিদ থেকে করোনা সংক্রমণের ভয় নেই বললেই চলে। সতর্কতা অবলম্বন বান্দার দায়িত্ব এবং হেফাজতের মালিক আল্লাহ। আমরা তাঁরই ওপর ভরসা করি।
কাঁঠালবাগ জামে মসজিদ শহরের বড় মসজিদসমূহের একটি। নীচতলায় এসি থাকা এবং খতিব মহোদয়কে সামনা-সামনি দেখে খুতবা শোনার লক্ষ্যে মুছল্লিরা অনেক পূর্বেই মসজিদ পূর্ণ করে ফেলে। খতিব মহোদয়ের কণ্ঠ বলিষ্ঠ এবং ভাষা প্রাঞ্জল। ১২.২৫ এসে নীচতলায় জায়গা না পেয়ে দোতলায় মিম্বর বরাবর জায়গা নিয়ে দু’রাকাত নামায পড়ে বসে পড়ি। দোতলায় সাউন্ডবক্সের কারণেই হয়তো খুতবা শুনতে কষ্ট হয় (একটু অস্পষ্ট লাগে)। তারপরও যতটুকু বুঝেছি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
খতিব মহোদয় সূরা তাওবা থেকে তাঁর আলোচনা শুরু করেন। কুরআনের বাণী, ‘মুহাজির ও আনসারদের মাঝে যারা প্রথম দিকে ঈমান এনেছে এবং পরে যারা একান্ত নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হয়েছে, তিনি তাদের জন্য এমন এক সুরম্য জান্নাত তৈরী করে রেখেছেন যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে; আর সেটাই হবে সর্বোত্তম সাফল্য’-সূরা তাওবা ১০০। মুহাজির ও আনসার বলতে রসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবায়ে কেরামকে (রা) বোঝানো হয়েছে। আল্লাহপাকের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, তিনি তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহকে পেয়ে সন্তুষ্ট। শুধু তাই নয়, তাঁদের জন্য জান্নাতেরও ঘোষণা রয়েছে।
সাহাবী বলতে বোঝায় যারা রসূলুল্লাহ (সা)-এর সাক্ষাত লাভ করেছেন, তাঁর প্রতি ঈমান এনেছেন এবং ঈমানের ওপর ইন্তেকাল করেছেন। সাক্ষাত লাভ করেছে অথচ ঈমান আনেনি তারা সাহাবী নন; যেমন আবু জেহেল ও আবু লাহাব প্রমুখ কাফিররা। আবার ঈমান আনার পর যারা মুরতাদ হয়ে গেছে তারাও সাহাবী নন। তিনি বলেন, নবী-রসূল ছাড়া সকল উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম মর্যাদার অধিকারী হলেন রসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীগণ। তিনি তাঁদের উচ্চ মর্যাদা ও প্রশংসা সম্বলিত অনেকগুলো হাদিস উদ্ধৃত করার পাশাপাশি তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীদের ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করেন।
তাঁর কথার সার কথা হলো, সাহাবায়ে কেরামের প্রতি বিদ্বেষ মূলত রসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি বিদ্বেষ এবং রসূলের (সা) প্রতি বিদ্বেষ তো আল্লাহর প্রতিই বিদ্বেষ। সাহাবায়ে কেরামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী একটি শ্রেণির তিনি তীব্র সমালোচনা করেন এবং তাদেরকে ভ্রষ্ট হিসেবে উল্লেখ করেন। উম্মাহর মাঝে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন, রসূলুল্লাহ (সা)-এর ইন্তেকালের পরে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে হযরত আলী (রা)-কে এই শ্রেণি অগ্রাধিকার দিতে চায়। অথচ সাহাবায়ে কেরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত ওমর ফারুক (রা) খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমরা সাহাবায়ে কেরামের মাঝে কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং যারা বিদ্বেষ পোষণ করে তাদেরকে ঘৃণা করি। তাদের প্রতি আল্লাহপাকের অভিসম্পাত।
হযরত আবু হুরাইরা (রা)-এর মাতৃভক্তি ও মায়ের হেদায়াতের জন্য তাঁর তীব্র আকুতি তিনি তুলে ধরেন। আবু হুরাইরা (রা) ইয়েমের অধিবাসী ছিলেন। তিনি সপরিবারে মদীনায় হিজরত করেন এবং সর্বক্ষণ রসূলুল্লাহ (সা)-এর সান্নিধ্যে থাকেন। তিনি যাতে রসূল (সা)-এর মুখনিঃসৃত বাণী ভুলে না যান সেজন্য রসূলুল্লাহ (সা)-এর দুআ চান। তাঁর দুআর বরকতে তিনি সর্বাধিক সংখ্যক হাদিস মুখস্ত করতে সক্ষম হন এবং সে সংখ্যাটি ছিল ৫৩৭৫। সর্বক্ষণ মসজিদে কাটানোর কারণে তিনি কোনো আয়-উপার্জন করতে পারতেন না। ফলে খুব দারিদ্রের মধ্যে তাঁর দিন অতিবাহিত হতো। অবশ্য সে সময়ে সবারই প্রায় একই অবস্থা। একদিন ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির অবস্থায় রসূলুল্লাহ (সা) সবাইকে দু’টি করে খেজুর দিলে তিনি লক্ষ্য করেন, আবু হুরাইরা (রা) একটি খেয়ে অপরটি রেখে দিচ্ছেন অথচ তিনি ছিলেন সবচেয়ে ক্ষুধার্ত। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমার মা ক্ষুধার্ত আছেন। রসূল (সা) তাঁকে আরো দু’টি খেজুর দেন।
আবু হুরাইরা (রা)-এর মা তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। ফলে রসূলুল্লাহ (সা)-এর দেয়া খেজুরকে তিনি সম্মানের সাথে গ্রহণ করেননি এবং আবু হুরাইরার (রা) সাথে বেশ মন্দ ব্যবহার করেন। মসজিদে নববীতে ফিরে এসে তিনি খুব মনক্ষুন্ন হয়ে থাকেন। মা সম্পর্কে বলতে গেলে রসূল (সা) বলেন, আমি তোমার মা’র বিচার করতে পারবো না। তাঁর মায়ের হেদায়াতের জন্য তিনি রসূল (সা)-কে দুআ করতে বলেন। রসূলুল্লাহ (সা) তাঁর মা’র জন্য দুআ করেন এবং তিনি এই বিশ্বাস নিয়ে বাড়ি ছুটে যান রসূল (সা)-এর দুআ ব্যর্থ হতে পারে না। তাঁর বাড়ি পৌঁছা আগে না দুআ কবুল আগে-এটিই ছিল তাঁর প্রধান বিবেচ্য। তিনি বাড়ি পৌঁছে দেখেন, তাঁর মা এইমাত্র গোসল সেরেছেন এবং তিনি ইসলাম গ্রহণ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। তাঁর মা কালিমা তাইয়্যেবাহ পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এটি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক ঘটনা। সকলেরই উচিৎ মাতা-পিতার প্রতি অশেষ ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং তাঁদের হেদায়াতের জন্য চেষ্টা ও দুআ করা।
হযরত আবু হুরাইরা (রা)-এর নাম ছিল আব্দুস শামস (অরুণ দাস)। তিনি তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখেন আব্দুর রহমান। তিনি বিড়াল খুব পছন্দ করতেন। একদিন মসজিদে নববীতে রসূল (সা)-এর মজলিসে তাঁর চাদরের মধ্য থেকে বিড়াল ছানাটি বেরিয়ে পড়লে সবাই মুচকি হেসে উঠেন। এ সময়ে তিনি আব্দুর রহমানকে আবু হুরাইরা (বিড়াল ছানার বাপ) বলে ডেকে উঠেন। রসূলুল্লাহ (সা)-এর মুখ নিঃসৃত এই ডাক তাঁর খুব পছন্দ হয় এবং তিনি নিজেকে আবু হুরাইরা হিসেবে পরিচিত হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। সেই থেকে তাঁকে সবাই আবু হুরাইরা হিসেবেই জানে।
শুধু পশু-পাখি নয় সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া প্রদর্শন প্রিয়তম নবী (সা)-এরই শিক্ষা। তিনি গাছ লাগানোর জন্য তাগিদ দিয়েছেন এবং এটাকে ছদকায়ে জারিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবু হুরাইয়া (রা)-এর বিড়াল ছানার প্রতি দরদকে তিনি স্বীকৃতি দিয়ে জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শনই শিক্ষা দিয়েছেন। ভারতের গোমাতার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও এদেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর পশুপ্রেম প্রদর্শন করতে গিয়ে কুরবানির বিরুদ্ধে নানা কৌশলে বিষোদগার করার তিনি তীব্র সমালোচনা করেন। ওরা পশুপ্রেম দেখায় অথচ মুসলমানকে হত্যা করতে একটুও ওদের বাধে না। ইসলাম বিদ্বেষ থেকেই ওরা এসব করে থাকে।
মুসলমানদের সকল কর্মকান্ড ও ভালোবাসা সবই আল্লাহকে কেন্দ্র করে। পশু জবেহ আল্লাহর নির্দেশ এবং ছওয়াবের নিয়তেই মুসলমানরা পশু জবেহ করে থাকে। সর্বাবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টিকে লক্ষ্য করে জীবন অতিবাহিত করার জন্য তিনি তাঁর মুছল্লিদের প্রতি আহবান জানান। সংক্ষেপিত।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment