Skip to main content

সূরা আল মুদ্দাস্সির

দরসুল কুরআন ১. হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী, ২. ওঠো এবং সাবধান করো, ৩. তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো, ৪. তোমার পোশাক পবিত্র রাখো, ৫. এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো, ৬. বেশি পাওয়ার আশায় ইহসান করো না ৭. এবং তোমার রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করো। নামকরণ : প্রথম বাক্যের আল মুদ্দাস্সির শব্দকে নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এটি কোনো শিরোনাম নয়। নাজিলের সময়কাল : কেউ কেউ সূরা মুদ্দাস্সিরের ৭টি আয়াত প্রথম অবতীর্ণ বললেও উম্মাহর মাঝে ঐকমত্য রয়েছে যে, সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াতই রসূল (সা)-এর ওপর অবতীর্ণ প্রথম ওহী। ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর বেশ কিছুদিন ওহী আসা বন্ধ ছিল। এ সময়ে রসূলুল্লাহ (সা) বেশ হতাশ হয়ে পড়েন। হেরা গুহায় জিবরাইল (আ)-কে দেখা, পড়তে বললে আমি পারি না বলা এবং তাঁর সাথে আলিঙ্গন করা সবই ছিল রসূল (সা)-এর জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা। ওহী কী, নবুয়ত কী, ফেরেশতা কী কিছুই তাঁর জানা ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে স্ত্রী খাদিজা (রা)-কে তাঁর ভয় ও জীবনের আশঙ্কার কথা বলেন। মুহাম্মদ (সা)-এর চরিত্রের উত্তম দিক বিশেষ করে আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার, সত্য কথা বলা, আমানত সংরক্ষণ, অসহায়দের বোঝা বহন, নিজে অর্থ উপার্জন করে অভাবীদের প্রদান, মেহমানদারী ও ভালো কাজে সাহায্য করা উল্লেখ করে খাদিজা (রা) বলেন, ‘আপনার কোনো ভয় নেই বরং ভালো কিছুর জন্য আপনি খুশি হয়ে যান’। এরপর খাদিজা (রা) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে মুহাম্মদ (সা)-কে নিয়ে যান। ওয়ারাকা ছিলেন ঈসায়ী ধর্মের অনুসারী এবং একজন সুপন্ডিত ব্যক্তি। সবকিছু শোনার পর তিনি বলেন, এতো বাণী বহনকারী ফেরেশতা যিনি মুসা (আ)-এর কাছে আল্লাহর বাণী বহন করে এনেছিলেন। সূরা আলাকের পাঁচটি আয়াত নাজিলের পর বেশ বিরতি দিয়ে সূরা মুদ্দাস্সিরের সাতটি আয়াত অবতীর্ণ হয়। একদিন পথ চলতে গিয়ে আসমানে একটি আসনে জিবরাইল (আ)-কে হেরা গুহায় যেমন দেখেছিলেন তেমনি দেখে তিনি আবার ভীত হয়ে পড়েন এবং ঘরে ফিরে তাঁকে বস্ত্র দ্বারা আবৃত করে দিতে বলেন। বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়ন করা অবস্থায় এই সাতটি আয়াত অবতীর্ণ হয়। বিষয়বস্তু : সূরার প্রথম সাতটি আয়াত অবতীর্ণের পরে হজ্জের মওসুমে বাকি আয়াতসমূহ নাজিল হয়। সূরা আলাকে মুহাম্মদ (সা)-এর নবুয়তের ঘোষণা এবং সূরা মুদ্দাস্সিরের সাত আয়াতে তাঁর দায়িত্ব বলে দেয়া হয়েছে। তাঁর মূল দায়িত্ব মানুষকে সতর্ক করা এবং নিজেকে প্রস্তুত করার কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাখ্যা : (১-২) হে রসূল বা হে মুহাম্মদ সম্বোধন না করে হে বস্ত্রাচ্ছাদিত বলায় বোঝা যায় তিনি ভয় পেয়ে বাড়িতে এসে শুয়ে পড়েছিলেন। এমন সময় তাঁকে বড় দরদের সাথে বলা হচ্ছে, এক মহান দায়িত্ব তোমার ওপর অর্পিত হয়েছে, তাই আরাম করে বিছানায় শুয়ে থাকার দিন আর তোমার নেই। তুমি ওঠে পড়ো। সকল নবী-রসূলের মৌলিক কাজ ছিল মানুষকে সতর্ক করা। সকল প্রক্রিয়া অবলম্বন করে মানুষকে সতর্ক করতে থাকো। ঈমানদারদের দায়িত্বও একই। দাওয়াত দানের দায়িত্ব মু’মিনদের, কবুল করার বিষয়টি আল্লাহর। দরদ ও আন্তরিকতার সাথে দাওয়াত দিতে হবে এবং তাদের জন্য দুআ করতে হবে। মানুষ আল্লাহকে ভুলে চরম গাফিলতির মধ্যে ডুবে আছে। আল্লাহর ভয় এবং আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস ও জবাবদিহিতা সবকিছু ভুলে জাহান্নামের দিকে মানুষ দৌড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তাদেরকে সেখান থেকে ফিরায়ে জান্নাতমুখী করে দেয়ায় ছিল নবী-রসুলদের কাজ এবং তাঁদের অবর্তমানে ঈমানদারদেরর একই দায়িত্ব। ৩. দাওয়াতের বিষয়বস্তু হলো মানুষের কাছে আল্লাহর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে দেয়া। মূলত কালিমা তাইয়্যেবারই ভিন্নভাবে প্রকাশ। সর্বকালে মানুষ কখনো তারই স্বজাতি কোনো মানুষ বা কোনো দেব/দেবি বা কোনো সৃষ্টিকে বড় মনে করে তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় অবনত হয় বা পূজা-অর্চনা পেশ করে বা আনুগত্য করে। নমরুদ-ফিরাউন, আবু জেহেল-আবু লাহাবরা নিজেদেরকে বড় মনে করে মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রাপ্তির একক দাবীদার মনে করতো। আজও মানুষ নেতা-নেত্রীদেরকে বড় মনে করে তাদের নামে শ্লোগান দেয় এবং বাস্তবিকই তাদের ছাড়া তারা আর কিছু বুঝে না। আল্লাহপাক একেবারে সূচনাতে জানিয়ে দিলেন, তুমি তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে দাও। মুসলিমরা আযান শুরু করে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে, নামায শুরু করে আল্লাহু আকবার বলে এবং উঠতে বসতে বারবার আল্লাহু আকবার উচ্চারণ করে। আবার যবেহ করে আল্লাহু আকবার বলে। যেহেতু আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, তাঁর চেয়ে বড় আর কেউ নেই, তাই ভক্তি-শ্রদ্ধা পেশ বলি বা আনুগত্য বলি তাঁর মোকাবেলায় দ্বিতীয় আর কেউ পাওয়ার হকদার নেই। আরবের কাফির-মুশরিকরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। দাওয়াত দানের সাথে তাদের সবচেয়ে প্রিয় ও সর্বোত্তম মানুষটি রাতারাতি তাদের দুশমন হয়ে পড়ে। সাথে সাথে এটিও ঠিক, মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণার মধ্য দিয়ে নিজের মধ্যে সাহস-হিম্মত অনুভব করার সুযোগ লাভ করেন। যেহেতু আল্লাহর চেয়ে বড় আর কেউ নেই, নিজেকে তাঁর অভিভাবকত্বে দিয়ে সকল শক্তিকে উপেক্ষা করার মানসিক শক্তি তিনি অর্জন করেন। ৪-৫. তৎকালে শুধু নয় এখনো মানুষ মনে করে ধার্মিকতার সাথে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি হয়ে থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। বর্তমানে মাজারকেন্দ্রিক এক বিরাট জনগোষ্ঠী ধার্মিকতা খুঁজে নোংরা ও অপরিচ্ছন্নতার মধ্যে। আল্লাহপাক শুরুতেই তাঁর নবীকে পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র রাখার প্রতি তাগিদ দেন। হাদিসের কিতাবসমূহে তাহারাত একটি বড় অধ্যায় হিসেবে পবিত্র-পরিচ্ছন্নতার নানা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। দ্বায়ী ইলাল্লাহর পোশাক হবে রুচিশীল, ভদ্র ও মার্জিত। পোশাক দেখে মানুষকে চেনা যায়। একজন ব্যক্তি ভবঘুরে না দাম্ভিক, না কৃপণ, না অহঙ্কারী পোশাক তা নির্দেশ করে। পোশাকের সাথে সাথে নিজের অন্তরকেও সব ধরনের মলিনতা ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণা, কার্পণ্য সবই অপবিত্র। দ্বায়ী ইলাল্লাহ হবে উদার, ক্ষমাশীল ও প্রশস্ততার অধিকারী। মানুষের কাছে যখন দাওয়াত দিতে যাবে তখন বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সব ধরনের অপবিত্রতা থেকে মুক্ত হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে যারা দ্বায়ী তারা প্রায়ই পবিত্র হয়ে থাকেন। ৬. নবীকে শেখানোর মধ্য দিয়ে সকল মু’মিনের প্রতি আল্লাহপাকের নির্দেশনা হলো দ্বায়ী ইলাল্লাহকে নিঃস্বার্থপরায়ণ হতে হবে। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা বা সতর্ক করা নিঃসন্দেহে অতি উত্তম কাজ এবং কাজটি আল্লাহর পক্ষে করা হচ্ছে বিধায় তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করা হচ্ছে, এমন ভাবনা-চিন্তার প্রশ্নই ওঠে না। এমন কি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়েছে সেটিও নয় বরং দ্বায়ী ইলাল্লাহ তার নিজের কল্যাণে করছে সেটি অনুভব করা এবং আল্লাহপাক তাকে সুযোগ দিয়েছেন সেজন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় করা। একজন সমাজকর্মী হিসেবে সে মানুষের নানা কল্যাণ সাধন করে সেজন্যও কোনো বিনিময় প্রত্যাশা করবে না। কুরআনের ভাষায়, ‘আমরা ওদের খানা খাওয়ায় কোনো বিনিময় প্রত্যাশা করি না, এমনকি শুকরিয়াও না’। সূরা ইয়াসিনে আল্লাহপাক একজন সদ্য ঈমান গ্রহণকারী মুসলমানের উক্তি এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘তোমরা আনুগত্য করো সেই রসূলদের যারা নিজেরা হেদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং কোনো বিনিময় চান না’। ৭. আল্লাহপাক ভালো করেই জানেন, তাঁর নবী (সা)-এর দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া কী হবে? অতীতকালে সকল নবী একই দাওয়াত প্রদান করেছেন এবং দাওয়াতের জবাবে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী নবী-রসূলগণ নিন্দাবাদ, শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা, দেশত্যাগ, জেল-জুলুম ও হত্যার শিকার হয়েছেন। আল্লাহপাক আগাম জানিয়ে দেন, ‘তুমি আল্লাহরই জন্য ধৈর্য অবলম্বন করো’। উত্তম চরিত্রের কারণে নবী-রসূল এবং তাঁদের অনুসারীদের ব্যক্তিগত কোনো শত্রু নেই, তাদের শত্রুতা মূলত আল্লাহর সাথে। তাই আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমার রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করো’। এখানে আল্লাহপাক তাঁর জন্য ধৈর্য ধারণের কথা বলে দ্বায়ী ইলাল্লাহর কাজকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আল্লাহর কাজ তাঁর পক্ষে সম্পাদন করার কারণে দ্বায়ী ইলাল্লাহর মাঝে এ অনুভূতি কাজ করে যে, মহান আল্লাহ অভিভাবক হিসেবে তার সাথে আছেন এবং বিপদাপদে তিনি তাকে ছেড়ে যাবেন না। সাথে সাথে দ্বায়ী ইলাল্লাহর মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণা ও প্রতিশোধ গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা জাগে না, কারণ কাজটি আল্লাহর এবং প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহপাক আমাদেরকে নিষ্ঠার সাথে তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর পথে ডাকার এবং এ ব্যাপারে পরম ধৈর্য অবলম্বনের তাওফিক দান করুন। ৩১.০৮.২০২০

Comments