Skip to main content

অতীত জাতিসমূহের ধ্বংসাবলী থেকে শিক্ষা

কুরআন আমাদের সম্মুখে অতীত জাতিসমূহের ইতিহাস বর্ণনা করেছে। ইতিহাসের মতো সন-তারিখ উল্লেখ না করে ঘটনা উল্লেখপূর্বক শিক্ষা গ্রহণের জন্য আহবান জানানো হয়েছে। কুরআন আদ্যপ্রান্ত একটি হেদায়াত গ্রন্থ। কুরআনের নিজেরই উল্লেখ : ‘ইহা মানবজাতির জন্য হেদায়াত’ আবার কখনো বলা হয়েছে ‘মুত্তকীদের জন্য হেদায়াত’। অবাধ্য ও অপরাধপ্রবণ জাতির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেছেন এতে রয়েছে শিক্ষার নিদর্শন, কিন্তু মানুষ খুব কমই শিক্ষা গ্রহণ করে। দু’জন নবীর সাথে তাঁদের জনপদের লোকদের আচরণ ও পরিণতি কুরআন থেকে পড়লাম। হযরত লুত (আ)-এর জাতির ঘটনাবলী রয়েছে সূরা আল আনয়াম ৮৬-৯০, আল আ’রাফ ৮০-৮৪, হুদ ৭৪-৮৩, আল হেজর ৫৮-৭৭, আল আম্বিয়া ৭৪-৭৫, আশ শোয়ারা ১৬০-১৭৩, আন নমল ৫৪-৫৮, আল আনকাবুত ২৮-৩০, ৩৩-৩৫, আস সাফফাত ১৩৩-১৩৮, আয যারিয়াত ৩২-৩৭, আল কামার ৩৩-৩৮, আত তাহরীম ১০। হযরত শোয়াইব (আ)-এর জাতির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সূরা আল আ’রাফ ৮৫-৯৩, হুদ ৮৪-৯৫, আল হেজর ৭৮-৭৯, আশ শোয়ারা ১৭৬-১৮৯, আল আনকাবুত ৩৬-৩৭। আল্লাহপাক অসংখ্য নবী-রসূল প্রেরণ করেছেন। অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনপদে রসূল পাঠিয়েছেন। মূলত মানুষ যখন সীমালঙ্ঘন করে ও পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে এমন অবস্থায় তাদের সংশোধন ও জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রসূল পাঠানো হয়েছে। এক পাপাচারী জাতির কাছে আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর ভাইপো হযরত লুত (আ)-কে পাঠিয়েছিলেন। এরা শিরকের পাশাপাশি অশ্লীলতার চরম পর্যায়ে উপনীত হয়ে সমকামিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল এবং ভরা মাহফিলে প্রকাশ্যে অশ্লীলতায় লিপ্ত হতো। তারা রসূলকে অস্বীকার করেছিল এবং আল্লাহর আযাবের ব্যাপারে বেপরোয়া ছিল। দু’জন ফেরেশতা সুশ্রী যুবক বেশে লুত (আ)-এর কাছে আসলে তারা চড়াও হয়। মেহমানদের প্রতি সদয় হওয়ার জন্য লুত (আ)-এর সকল অনুরোধ তারা প্রত্যাখ্যান করে। দুষ্কৃতিকারীদেরকে তাদের অবস্থায় রেখে রাতের মধ্যে তাঁর স্ত্রীকে ছাড়া ঈমানদারদের সাথে করে জনপদ ত্যাগ করার জন্য ফেরেশতারা লুত (আ)-কে বলেন। প্রভাতেই তাদের ওপর আযাব শুরু হয়ে যায় এবং স্বল্পসংখ্যক ঈমানদার ছাড়া সবাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। শোয়াইব (আ)-এর জাতি তাঁকে রসূল হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে। শিরকের পাশাপাশি তারা নানা পাপাচারে লিপ্ত হওয়াসহ মাপে-ওজনে কম দিয়ে মানুষকে ঠকাতো। তারা ছিল ব্যবসায়ী জাতি ও অর্থনৈতিক দিয়ে সচ্ছল। তারা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত এবং নবীকে একজন ধৈর্যশীল নেককার হিসেবে জানা সত্ত্বেও ঈমান আনতে তারা প্রস্তুত ছিল না। নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যানই নয়, বিরত না হলে তাঁকে হত্যার হুমকি প্রদান করতো। শেষ পর্যন্ত ঈমান না আনা এবং অন্যায় আচরণ থেকে বিরত না হওয়ার জন্য আল্লাহপাক প্রলয়ংকারী আযাব দিয়ে তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেন। উপরে দু’টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে এবং শাস্তি দেয়া প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, সতর্ক করা উদ্দেশ্যে তাদের প্রতি আজাব নাযিল করা হয়। আবার বলা হয়েছে যাতে তারা বিনয়াবনত হয়। সমাজে যখন অন্যায়-অত্যাচার বিশেষ করে অশ্লীলতার প্রসার ঘটে হাদিসের বর্ণনানুসারে তখন আল্লাহপাক আযাব নাযিল করেন। বিশেষ কোনো জনপদ নয়, করোনা তান্ডবে সমগ্র বিশ্ব বর্তমানে বিপর্যস্ত। নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে। আমার প্রশ্ন, যে অপরাধে লুত (আ)-এর জাতির ওপর ভয়াবহ নাযিল হয়েছিল একই অপরাধে কোনো জাতিকে শাস্তি না দেয়াটা কি ইনসাফপূর্ণ হয়? ইউরোপ-আমেরিকা সমকামিতাকে আইনসিদ্ধ করেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত অতীত জাতিসমূহকে আল্লাহপাক উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকা জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-অর্থ-সম্পদ সর্বদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠেত্বের দাবীদার। অথচ করোনার প্রথম আঘাতটি পড়েছে ক্ষমতাগর্বী এসব জাতিসমূহের ওপর। আসলে এমন শাস্তির জন্য তারা উপযুক্ত হয়ে পড়েছিল। দুর্নীতির দিক দিয়ে যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে দেখবো শোয়াইব (আ)-এর জাতিকে আমরা ছাড়িয়ে গিয়েছি। মাপে-ওজনে কম দিয়ে বা মানুষকে ঠকিয়ে বড় হওয়ার প্রবণতা ব্যাপক রূপ লাভ করেছে। প্রাপককে তার ন্যায্য পাওনা থেকে যারা বঞ্চিত করে তাদেরকে হীন ঠকবাজ বলে উল্লেখ করে তাদের ধ্বংসের কথা সূরা মুতাফ্ফিফিনে বলা হয়েছে। শুধু দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে নেয়া-দেয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। কোনো মজুর তার মালিকের কাছ থেকে পুরো পারিশ্রমিক গ্রহণ করে তার মালিককে যদি কাজের ক্ষেত্রে ফাঁকি দেয় তাহলেও তার ধ্বংস অনিবার্য। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারের কাছ থেকে পুরো বেতন-ভাতা গ্রহণ করে সেবাদানের ক্ষেত্রে গাফিলতি করলে সেও হীন ঠকবাজদের পর্যায়ভুক্ত হবে। অধিকার হরণ তা আল্লাহর হোক বা তাঁর বান্দার হোক সেটি কবিরা গুনাহ। ওজনে কম-বেশি করা, ধোকা-প্রতারণা করা ও ভেজাল দেয়া বা যে কোনোভাবে কাউকে ঠকানো একজনের অধিকার হরণ। প্রতিটি মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান পবিত্র। একটি মুসলিমপ্রধান দেশে কোনোভাবেই মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে না। রাজনীতির অঙ্গনে ধোকা-প্রতারণা যেন মামুলি ব্যাপার। জনগণ বারবার প্রতারিত হচ্ছে, তারা ভোটাধিকার থেকেও বঞ্চিত। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সীমাহীন ঘুষ-দুর্নীতির কারণে জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত। সরকারি কেনাকাটায় সীমাহীন দুর্নীতির কথা প্রায়ই প্রকাশ পায়। এরা সবাই হীন ঠকবাজ ও জাহান্নামই তাদের ঠিকানা। মাপে ও ওজনে কম-বেশি করার অপরাধে একটি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার কথা আল্লাহপাক তাঁর কিতাবে উল্লেখ করে সতর্ক করে দিয়েছেন, মানুষের অধিকার হরণকারী পাপীষ্ঠদের জন্য আখিরাত পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আল্লাহ দুনিয়াতেও তাদের শাস্তি দিয়ে থাকেন। বর্তমান বিশ্বে অশ্লীলতার পাশাপাশি আল্লাহ ও তাঁর বান্দার অধিকারহরণ সকল সীমা লঙ্ঘন করেছে। পৃথিবীতে যে বালা-মুছিবত, বিপদাপদ আপতিত হয় আল্লাহর ভাষায় তা মানুষের হাতের কামাই। মানুষ যদি আল্লাহর বিধান মেনে চলে এবং দুনিয়ায় তাঁর সৃষ্টির সাথে সদাচরণ করে তাহলে শুধু শুধু তিনি শাস্তি দেবেন কেন? আল্লাহর দ্ব্যর্থহীন উক্তি, মানুষের ওপর বিপদাপদ যা আসে তা তাঁর অনুমতিক্রমেই আসে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, খারাপ লোকের সংখ্যা হাতে গোণা, তাদের অপরাধের কারণে সকল মানবগোষ্ঠীর ওপর কেন আযাব আসবে? আল্লাহর রসূল (সা)-এর ভাষায় এ দুনিয়ায় বিপদাপদ ভালো-মন্দ সবার ওপর সমভাবে আসে। এবারের করোনায় মৃত্যুর মিছিলে সব ধরনের লোকই শামিল রয়েছে। নেক আমলকারী ও বদ আমলকারী উভয়ই তাদের আমল নিয়ে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে উত্থিত হবে। তাই ভালো লোকদের জন্য এই গজব আর গজব থাকবে না, এটা হয়ে যাবে তাদের জন্য রহমত এবং ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই তারা সেদিন আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। কুরআনে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধ্বংসের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এটা দেখে মানুষ সতর্ক ও বিনয়াবনত হবে এবং আল্লাহর নাফরমানি থেকে ফিরে আসবে। এটি ঠিক, আল্লাহর বিপুল পরিমাণ বান্দার নছিবে তাওবা করার সৌভাগ্য হয়েছে, সমাজ থেকে অনেক জুলুম-নির্যাতনের অবসান হয়েছে, নগ্নতা-বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা হ্রাস পেয়েছে। এ সবই ইতিবাচক। পাশাপাশি ত্রাণ নিয়ে লুকোচুরি, ভূয়া বিল-ভাউচার ও দুর্নীতি এবং সেবাপ্রাপ্তিতে ভোগান্তির কথাও শোনা যায়। বালা-মুছিবত-গজবকে আকস্মিক ও দুনিয়ার নিয়ম হিসেবে মনে করা এবং এতে আল্লাহর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এমন ধারণায় বিশ্বাসী লোকের সংখ্যাও কম নয়। তাদের নছিবে কখনো ঈমান জুটবে না ও ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাও তাদের নেই। আল্লাহপাক আমাদের ঈমানে দৃঢ়তা ও তাঁর পথে ফিরে আসা এবং করোনার ভয়াবহ অবস্থা থেকে হেফাজত করুন। আমিন। ০৮.০৭.২০২০

Comments