(জু’মা বক্তৃতা)
কুচিয়ামোড়া বাজার জামে মসজিদে ২৪ জুলাই কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ (অব) প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে দেশ-বিদেশের করোনা পরিস্থিতি ও আসন্ন ঈদুল আযহা উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। আল্লাহপাকের সৃষ্ট এক অতি ক্ষুদ্র জীবাণু করোনার ধ্বংসকারিতা এবং ইতোপূর্বে সংঘটিত মহামারি সম্পর্কে তিনি মুছল্লিদেরকে অবহিত করেন। বিশ্বে দেড় কোটিরও অধিক লোকের করোনা আক্রান্ত হওয়া ও ছয় লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানি প্রসঙ্গে বলেন, করোনা সমগ্র বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। মাত্র কয় মাসের ব্যবধানে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর ও গর্বিত রাষ্ট্রগুলোকে একযোগে আঘাত হেনে মানুষের চরম অসহায়ত্ব প্রকাশ করে দিয়েছে।
কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে তিনি বলেন বিপদ-মুসিবত সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে (সূরা তাগাবুন)। চীন থেকে উদ্ভব হওয়া করোনা আশে-পাশের ঘনবসতি ও দরিদ্র দেশগুলোকে বাদ দিয়ে সুদূর আমেরিকা ও ইউরোপে আঘাত হানা আল্লাহপাকেরই ফয়সালা বলতে হয় এবং তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের সাথে সাথে চান যে, তাঁর বান্দারা নাফরমানি পরিহার করে তাঁর অনুগত হোক। বাংলাদেশ একটি দরিদ্র, ঘনবসতি ও অসচেতন জনগোষ্ঠীর দেশ। ইউরোপ-আমেরিকায় যখন মানুষ ব্যাপকভাবে আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছিল সে সময়ে ধারণা করা হচ্ছিল যে, বাংলাদেশে করোনা দেখা দিলে ১৫/২০ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রতি রহম করেছেন।
প্রফেসর হিলালী ঢাকায় তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, চার মাসের মধ্যে আজই তিনি জুমার নামায আদায় করছেন এবং গত ঈদের নামাযও ঘরে আদায় করেছেন। অবশ্য তিনি তাদের ঘরকে মসজিদে পরিণত করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ছেলেদের সাথে করে জামায়াতে আদায় করেছেন। তারা সাধারণত ঘরে অবস্থান করতেন এবং কোনো কারণে সামান্য সময়ের জন্য ঘর থেকে বের হলে দ্রুত কাজ শেষে ঘরে ফিরে কাপড়-চোপড় ডিটারজেন্ট পাউডারে ধোয়ার সাথে সাথে গোসল সেরে নিতেন। স্বাস্থ্যবিধি পালনের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করে বলেন, সরকার তার নাগরিকদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছেন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে সরকারি নির্দেশ মেনে চলা তার নাগরিকদের অপরিহার্য বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অতীতেও অনেক বড় বড় মহামারি দেখা দিয়েছে এবং তাতে বিপুল পরিমাণ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। খলিফা ওমর (রা)-এর শাসনামলে সিরিয়া সীমান্তে যুদ্ধ চলছিল। সে সময়ে খলিফা সেখানে রওনা হয়েছিলেন এবং কাছাকাছি পৌঁছার পর জানতে পারেন যে, সিরিয়ায় মহামারি আকারে প্লেগ দেখা দিয়েছে। সেনাপ্রধান হযরত আবু ওবায়দাহ (রা) যুদ্ধের ময়দান থেকে এগিয়ে এসে খলিফার সাথে সাক্ষাত করেন। খলিফা মুহাজির ও আনসার নেতৃবৃন্দের সাথে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছতে সমর্থ হননি। অবশেষে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ করলে তাঁরা খলিফাকে ফিরে যেতে বলেন। আবু ওবাইদাহ (রা) খলিফাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি কি তকদিরকে অস্বীকার করতে চান’? খলিফা তাঁর কাছ থেকে এমন কথা প্রত্যাশা করেননি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উঁচুস্তরের সাহাবী এবং জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ জনের একজন।
এমন সময়ে হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা) বলেন, ‘আমার একটি হাদিস জানা রয়েছে’। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ‘কোনো এলাকায় মহামারি দেখা দিলে তোমরা সেখানে যাবে না এবং মহামারি আক্রান্ত এলাকায় অবস্থান করলে সেখান থেকে বের হবে না। তোমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে অবস্থান করবে এবং মহামারিতে মৃত্যু হলে শহীদ হিসেবে গণ্য হবে’। হাদিসটি শোনার পর ওমর (রা) মদীনায় ফিরে গেলেন এবং বললেন, ফিরে যাওয়াটাই আমাদের তকদির। সেই যুদ্ধে মহামারিতে সেনাপতি আবু ওবাইদাহ (রা)সহ অনেক বিশিষ্ট সাহাবী শহীদ হন। পরবর্তিতে আমর ইবনে আস (রা) সেনাপতি নিযুক্ত হয়ে সৈন্যদের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার নির্দেশ দেন এবং পাহাড়-পর্বত, বনে-জঙ্গলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে অনেকে প্রাণে বাঁচেন। সেই যুদ্ধে ২৫ হাজার সৈন্য প্লাগ মহামারিতে মারা যান।
বিপদাপদ আল্লাহ দেন এবং দূর করার মালিকও তিনি। তাই তাঁর পথে ফিরে আসার মাধ্যমে বিপদ থেকে পানাহ চাইতে হবে এবং সাথে সাথে বান্দাহ হিসেবে যেটা করণীয় সেটিও পালন করতে হবে। কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে ভয় না পেয়ে ঘনঘন গরম পানি পান, লবণমিশ্রিত গরম পনিতে গার্গিল করা, সস্তা লেবু (ভিটামিন সি) বেশি করে খাওয়া, শরীরে কমপক্ষে ১৫ মিনিট রৌদ্র লাগানো (ভিটামিন ডি) এবং পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণের ওপর তিনি গুরুত্ব প্রদান করেন।
তিনি বলেন, কয়দিন পরে দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা করোনার কারণে ঈদগাহে জামাত করা সম্ভব হবে না এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদের নামায মসজিদে আদায় করতে হবে। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা একটি পরিবারের জন্য একটিই যথেষ্ট এবং গরু, উট সাতটি পরিবার মিলে করা যায়। একটি পরিবারের জন্য একটি ছাগলই যথেষ্ট, সদস্য যাই হোক না কেন। রসূলুল্লাহ (সা) সাধারণত দু’টি দুম্বা কুরবানি করতেন। একটি তাঁর ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে এবং অপরটি তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে। জবেহ হতে হবে আল্লাহর নামে অর্থাৎ বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে। (মৃত ব্যক্তির পক্ষে এককভাবে কুরবানি দিলে পশুর গোশত সদকা করে দিতে হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হলে জীবিত ও মৃত সব চলে আসে।)
পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানির গোশত থেকে কিছু দেয়া যায় না। প্রতিবেশি বা আত্মীয় হলে অন্যান্যদের মতো হাদিয়া হিসেবে দেয়া যায়। গোশত বন্টনে প্রচলিত তিনভাগে কোনো সমস্যা নেই। কুরবানির গোশত অমুসলিমকেও দেয়া যায়। অবশ্য সেটি যেন খাসির গোশত হয়। যারা কুরবানির নিয়ত করেছেন তাঁরা নখ ও চুল কুরবানির আগ পর্যন্ত কাটবেন না। এতে ছওয়াব রয়েছে।
জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। নফল নামায, রোযা, কুরআন তেলাওয়াত, যিকির-আযগার, দান-সদকা বেশি বেশি করাতে অনেক ফজিলত রয়েছে। ৯ জিলহজ্জ রোযা রাখা সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে এ দিনে রোযা রাখা আগের ও পরের বছর গুনাহের কাফ্ফারাস্বরূপ। এই সময়ের একটি বড় আমল তাকবির পড়া (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ)। চাঁদ দেখার পর থেকে ঈদের নামাযের আগ পর্যন্ত উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ একটি সুন্নাত আমল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) ও আবু হুরাইরা (রা) বাজারে গিয়ে উচ্চস্বরে তাকবির পড়তেন এবং তা শুনে অন্যান্য সাহাবীরাও পড়তেন।
ওয়াজিব/সুন্নাতে মুয়াক্কাদা হিসেবে তাকবির পড়তে হবে ৯ জিলহজ্জ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ্জ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামায শেষে সালাম ফেরানোর পরে। আল্লাহপাক আমাদের কুরবানিসহ সকল ইবাদত অনুষ্ঠান কবুল করুন এবং করোনাসহ সকল বিপদাপদ থেকে হেফাজত করুন। আমিন। ২৪.০৭.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment