জীবমাত্রই মরণশীল। কী আস্তিক আর কী নাস্তিক মৃত্যু নিয়ে কারো মধ্যে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই। সকলেই স্বীকার করে। মৃত্যুপরবর্তী জীবন নিয়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা আস্তিক-নাস্তিকের মধ্যে বিশ্বাস ও ধারণায় পার্থক্য রয়েছে। নাস্তিকদের এ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের বিশ্বাস, দুনিয়ার জীবনই শেষ এবং এরপরে আর কিছু নেই। ফলে দুনিয়ায় ভালো থাকার জন্য যা যা দরকার এবং মৃত্যু পরবর্তীতে মানুষ তাদেরকে স্মরণ করবে, তাদের নামে বিভিন্ন স্থাপনা থাকবে, পরবর্তী প্রজন্ম তাদেরকে নিয়ে গর্ব করবে, এর মধ্যেই তাদের জীবন ও কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ।
পক্ষান্তরে একজন মুসলিম বিশ্বাস করে দুনিয়ার জীবনই তার শেষ নয়, এরপর রয়েছে আখিরাতের জীবন এবং যেটি সীমাহীন অনন্তকালের জীবন। এই দুনিয়ার জীবন কর্মক্ষেত্র এবং আখিরাতের জীবন ফলভোগের। অর্থাৎ হয় অফুরন্ত নেয়ামতেভরা জান্নাত নয়তো ভয়াবহ আযাবেপূর্ণ জাহান্নাম-এই হলো মানবজীবনের শেষ ঠিকানা। ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ ব্যক্তিবর্গের জন্য রয়েছে জান্নাত এবং কাফির-মুশরিক ও জালেমের জন্য রয়েছে দাউ দাউ করে জ্বলা জাহান্নামের আগুন। সেখান থেকে ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই।
মৃত্যুপ্রস্তুতি বলতে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য হাসপাতালের কেবিন ঠিক করে রাখা, নামীদামী ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে রাখা, হাসপাতালে ICU বা এয়ার এ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে রাখা বা মৃত্যুর পর কোন্ কবরস্থানে সমাহিত করা হবে তা জানিয়ে রাখাকে বুঝাতে চাচ্ছি না। মৃত্যুপ্রস্তুতি বলতে মৃত্যুর কথা স্মরণ করা এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য পাথেয় সংগ্রহের জন্য সচেষ্ট হওয়াকে বুঝাচ্ছি। রসূলুল্লাহ (সা) মৃত্যুর কথা বারবার স্মরণ করার জন্য বলেছেন এবং জানাযা ও দাফনে শরীক হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং সাধারণ কবরস্থানে কবর জিয়ারতের কথাও বলেছেন।
করোনা পরিস্থিতির কারণে জানাযা ও দাফনে শরীক হওয়ার সুযোগ হ্রাস পেয়েছে। তবে টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা, ফেসবুকে মৃত্যুর কথা অহরহ জানান দিয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেও মৃত্যু নিয়ে অনেক পোস্ট দিয়ে থাকি এবং এ সম্পর্কীয় পোস্টে মাগফিরাত কামনা করে থাকি। কিন্তু এসব পোস্ট ও মন্তব্য কি নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে দেয়। মনে হয় না। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ এই বাংলাদেশ। পরকালে বিশ্বাস ও মৃত্যুকে স্মরণকারী একজন ব্যক্তি কখনই কি পারে দুর্নীতি, আত্মসাৎ, খেয়ানত, জুলুম, ভূয়া নির্বাচন, নির্বাচনে কারচুপী, ভূয়া রিপোর্ট প্রদান করতে। পারে না, কক্ষণই পারে না; নিরেট নাস্তিক একজন দুনিয়াদারের পক্ষেই কেবল সম্ভব।
আখিরাতে জান্নাতপ্রাপ্তি বড় কঠিন কাজ নয়। বিশ্বাসী বান্দার জন্য আল্লাহপাক সহজ করে দিয়েছেন। প্রয়োজন বিশ্বাস ও সৎ আমল। নেক আমলের ধারণা আল্লাহপাক মানুষের প্রকৃতিতেই দিয়ে রেখেছেন। মানবপ্রকৃতিতে যে সব কাজ ভালো ও কল্যাণকর বলে বিবেচিত সেগুলোই আল্লাহ হালাল করেছেন। পক্ষান্তরে মন্দ কাজ, মানবপ্রকৃতি যেগুলোকে ঘৃণা করে ও অপছন্দ করে আল্লাহ সেগুলোই হারাম করেছেন। বোঝা যায়, জান্নাত প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রয়োজন আল্লাহ যে কাজ করতে আদেশ করেছেন সেটি করা এবং যেটি করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। পরকালে বিশ্বাসী বান্দার পক্ষে আল্লাহর পথে চলাটা অত্যন্ত সহজ বরং বিপরিত পথে চলাটাই কষ্টকর ও অসম্ভব। যেমন, নামায সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, নামায নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ, কঠিন নয় আল্লাহর সেসব অনুগত বান্দাদের জন্য যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের ভয় রাখে। অর্থাৎ পরকালে বিশ্বাসী বান্দার জন্য নামায অত্যন্ত সহজ।
আমরা প্রতিনিয়তই মৃত্যু লক্ষ্য করছি। রোগ-শোক, দুর্ঘটনা, সম্প্রতি করোনা প্রতিনিয়তই আমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে দিচ্ছে। হাসপাতালে ডাক্তারের সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে অঢেল ধন-সম্পদের মালিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। বাঁচার কতো আকুতি। একটু আরাম পাওয়ার জন্য সবকিছু দিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তাওবা করা বা সম্পদের এক তৃতীয়াংশ অসিয়ত করার কথা কারো কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে না। মৃত্যুপ্রস্তুতি তো এরই নাম। ভুল-ত্রুটিতে পূর্ণ এ জীবন। কতো অন্যায় করেছে, মানুষের প্রতি কতো জুলুম করেছে, পাপের তো কোনো শেষ নেই। শেষ মুহুর্তে সন্তান-সন্ততিকে ডেকে ভালো কাছে নসিয়ত ও আল্লাহর পথে খরচের ব্যাপারে অসিয়ত তো করতেই পারে। পাষাণ হৃদয়, আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার কারণে আল্লাহও আত্মভোলা করে দিয়েছেন। ফলে মুখ থেকে তাওবা উচ্চারিত হয় না।
আমি আল্লাহর এক বিশ্বাসী বান্দাহ। আমি আমার আল্লাহকে অনুভব করি অত্যন্ত দয়ার্দ, ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময় হিসেবে। তিনি তাঁর বান্দাকে শাস্তি দেয়ার জন্য বাহানা তালাশ করবেন না, বরং ক্ষমা করার জন্য উপায় খুঁজবেন। আমি আশা করি, আমার আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন। এই আশাবাদের পেছনে আমলের কোনো দীর্ঘ ফিরিস্তি নেই বরং আল্লাহ সম্পর্কে আমার সুধারণা ও তাঁর বান্দাদের সাথে আমার আচরণ। আমি আল্লাহর বান্দাদের সাথে সব সময় সদাচরণ করতে না পারলেও কখনো তাদের প্রতি জুলুম করি না। আমি জুলুমকে খুব ভয় পায় এবং এটিও মনে করি জান্নাতে কোনো জালেমের স্থান নেই। ন্যায়বিচারক আল্লাহ জালেমের কাছ থেকে মজলুমের সকল পাওনা আদায় করে দিবেন এবং পূরণ না হলে মজলুমের গুনাহ জালেমের ঘাড়ে দিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
আমি মনে করি, সকল বিশ্বাসী বান্দার ধারণা আমার মতই। আল্লাহ ও পরকালের প্রতি এই বিশ্বাসই বান্দাকে সব ধরনের জুলুম-নির্যাতন ও পাপাচার থেকে দূরে রাখে। একজন বিশ্বাসী বান্দাহ সর্বক্ষণ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকে। এমন কি আছরের নামায পড়ার পর সে মনে করে মাগরিবের নামায তার ভাগ্যে নাও জুটতে পারে। মৃত্যুর দিন-ক্ষণ নির্ধারিত, বিপদাপদও আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাই সে মৃত্যু নয়, মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে চিন্তিত। মৃত্যুর দিন-ক্ষণ যেহেতু প্রচ্ছন্ন, তাই মু’মিন মৃত্যু সম্পর্কে গাফেল নয়, সে সর্বদা প্রস্তুত থাকে।
বালা-মুছিবত সবই আমাদের হাতের কামাই। অতীতকালেও বিভিন্ন জনপদে আল্লাহপাক গজব দিয়েছেন। দিয়েছেন তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করার জন্য। এবারে করোনা বিশ্বব্যাপী আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা। বর্তমান বিশ্ব জুলুম-নির্যাতন ও অশ্লীলতায় চরম সীমায় পৌঁছেছে। একটি বিশেষ জনপদ নয়, সমগ্র বিশ্বে তার প্রভাব লক্ষণীয়। করোনার আঘাত ধনী-দরিদ্র, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবার ওপর সমানভাবে আপতিত হয়েছে। আমি মনে করি, বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী এই করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। এই ঝুঁকেপড়া জনগোষ্ঠীই হলো ভাগ্যবান। মহামারি আক্রান্ত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মু’মিনের মৃত্যুকে আল্লাহর রসূল (সা) শহীদের মৃত্যু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই তার রবের কাছে উপস্থিত হবে। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসীর জন্য এটি গজব।
করোনা বলি আর রোগ-শোক ও দুর্ঘটনা বলি মৃত্যু সব সময় আমাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমাদের বড় সান্ত্বনা ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেউন’-(আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাব)। আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ। তিনি মু’মিনদের জন্য সাজিয়ে রেখেছেন অসংখ্য নেয়ামত দ্বারা সজ্জিত ও চির সুখের স্থান জান্নাতকে। এই জান্নাত দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পাওয়া সম্ভব নয়, অবশ্যই মৃত্যুর পর। আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী মু’মিনদের জন্য মৃত্যু ভয়ের ব্যাপার নয়। মু’মিন ভয় করে আল্লাহ ও পরকালকে এবং এ দুনিয়া কর্মক্ষেত্র। তাই সে পরকালের পাথেয় সংগ্রহের জন্য থাকে সর্বদা সচেষ্ট এবং মৃত্যুর জন্য থাকে সদা প্রস্তুত। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর পথে চলাটা সহজ করে দিন এবং আমাদের মৃত্যু যেন হয় তাঁর অনুগত বান্দাহ (মুসলিম) হিসেবে। আল্লাহ হুম্মামিন। ১৭.০৭.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment