কুরআন মজিদে বেশ কিছু নবী-রসূল সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। তন্মধ্যে হযরত ইব্রাহিম (আ) উল্লেখযোগ্য। তাঁর সম্পর্কে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে সূরা বাকারা ১২৪-১৩৬, ২৫৮, ২৬০, আলে ইমরান ৬৫০৬৭, আন নেসা ১২৫, আল আনয়াম ৭৪-৯০, আত তাওবা ১১৪, হুদ ৬৯-৭৬, ইউসুফ ৬, ইব্রাহিম ৩৫-৪১, আল হিজর ৫১-৬০, আন নাহল ১২০-১২৩, মারইয়াম ৪১-৪৯, আল আম্বিয়া ৫১-৫৩, আল হাজ্জ ২৬-২৭, আশ শোয়ারা ৬৯-৮৭, আল আনকাবুত ১৬-২৭, ৩১-৩২, আস সাফফাত ৮৩-১১১, সোয়াদ ৪৫-৪৭, আয যোখরুফ ২৬-২৭, আয যারিয়াত ২৪-৩২, আল হাদীদ ২৬, আল মোমতাহেনা ৪।
হজ্জের আনুষ্ঠানিকতার মাঝে কুরবানি অন্যতম। মদীনায় হিজরতের পর রসূল (সা) দু’টি উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা চালু করেন। ঈদুল আযহায় দুই রাকাত নামাযের পর বড় ইবাদত হলো সমর্থবান ব্যক্তি কর্তৃক আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে পশু কুরবানি করা। হযরত ইব্রাহিম (আ) আল্লাহর নির্দেশক্রমে তাঁর কলিজার টুকরো সন্তান ইসমাইল (আ)-কে কুরবানি করার লক্ষ্যে গলায় ধারালো ছুরি চালালে আল্লাহপাক একটি পশু কুরবানির বিনিময়ে ইসমাইল (আ)-কে বাঁচিয়ে দেন। এটি ছিল এক অভাবনীয় ঘটনা এবং আল্লাহপাক সন্তুষ্ট হয়ে পরবর্তি কালের লোকদের জন্য স্মরণ হিসেবে পশু যবেহকে জারি করে দেন। সাহাবায়ে কেরাম কুরবানি সম্পর্কে জানতে চাইলে রসূলুল্লাহ (সা) জবাবে বলেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের সুন্নাত।
কেবল আনুষ্ঠানিক পশু কুরবানিই নয়, মানুষের জীবনে নানাভাবে ত্যাগ ও কুরবানি চলে আসে এবং ত্যাগের মাধ্যমেই আল্লাহর নৈকট্য (কুরবানি) লাভ করা যায়। হযরত ইব্রাহিম (আ) ছিলেন আল্লাহপাকের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। তাঁকে বলা হয় ‘খলিলুল্লাহ’। তাঁর জীবনে এসেছিল পরীক্ষার পর পরীক্ষা। তাঁর জন্ম হয়েছিল এক পুরোহিত পরিবারে। পিতা আযর ছিল নমরুদের প্রধান পুরোহিত। নমরুদ নাস্তিক ছিল না, ছিল আল্লাহতে বিশ্বাসী কিন্তু ছিল মূর্তিপূজারি মুশরিক। ইব্রাহিম (আ) মূর্তিপূজার বিরুদ্ধাচরণ করলে পিতা আযরের সাথে বাকবিতন্ডা হয় ও একপর্যায়ে পিতা হয়ে সন্তানকে হত্যা করতে চেয়েছিল এবং শেষে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কোনো এক মেলার দিনে ইব্রাহিম (আ) লোকচক্ষুর অগোচরে মন্দিরে প্রবেশ করে সব মূর্তি ভেঙ্গে বড়টার ঘাড়ে কুঠার ঝুলিয়ে রাখেন। সবাই অভিমত পোষণ করে যে, একজন যুবক মূর্তির বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং সেটি তারই কাজ হবে।
মূর্তিপূজা ছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, বলা যায় তাদের রাষ্ট্রীয় দ্বীন। নমরুদের দরবারে হযরত ইব্রাহিম (আ)-কে নেয়া হলে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয় এবং ভবিষ্যতে আর কেউ যাতে এমন দুঃসাহস দেখাতে না পারে সেজন্য প্রকাশ্যে আগুনে পুড়ায়ে মারার ব্যবস্থা করা হয়। বলা যায় নমরুদ ও আযর এবং তাদের অনুসারীরা তাদের ভাষায় ধর্মপরায়ণ আর ইব্রাহিম (আ) ছিলেন ধর্মদ্রোহী। আমাদের দেশেও যথার্থ ধর্মের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে শিরক-বিদয়াতে লিপ্ত এক শ্রেণির মানুষ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা বলে মামলা করে। এটি ছিল ইব্রাহিম (আ)-এর জীবনে প্রথম পরীক্ষা এবং সে পরীক্ষায় আল্লাহপাকের অনুগ্রহে তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হন।
মানুষ আল্লাহকে ভুলে গিয়ে যুগে যুগে ধর্মীয় ও রাজনীতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার আতিশয্যে তাদের পূজা শুরু করে দেয়। ভক্তির আতিশয্যে নবী-রসূলকে আল্লাহর অংশ হিসেবে পুত্রের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে, অথচ তাঁদের আগমনই হয়েছিল মানুষকে আল্লাহর গোলাম বানানোর জন্য। ব্যক্তি ও সৃষ্টিপূজা অস্বীকার করে ইসলাম মানুষকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও মহানত্ব শিখিয়েছে। হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর সন্তান হিসেবে মূর্তিসংস্কৃতি থেকে দূরে থাকাটাই হবে তাঁকে যথার্থ অনুসরণ। তিনি ছিলেন খাঁটি মুসলিম ও শিরকমুক্ত।
আল্লাহপাক নমরুদের সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত থেকে তাঁকে রক্ষা করেন। যখন তিনি দেখলেন, তাঁর জাতি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করছে তখন তিনি মাতৃভূমি ত্যাগ করে অজানা উদ্দেশ্যে রওনা হন। কোনো রুটি-রুজি বা আশ্রয়ের চিন্তা ছিল না। আল্লাহর ওপর নির্ভরতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তিনি। আল্লাহর ওপর নির্ভর করে কেউ তাঁরই পথে অগ্রসর হলে আল্লাহ তখন তাঁর হয়ে যান। বিভিন্ন জনপদে ঘোরার পর এক সময়ে তিনি বার্ধক্যে উপনীত হন। তখনও তিনি নিঃসন্তান। স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর মিশন অব্যাহত রাখার জন্য তিনি আল্লাহর কাছে সন্তান কামনা করেন। দুআর বরকতে আল্লাহ তাঁকে অতি ধৈর্যশীল এক পুত্র সন্তান দান করেন।
আবার পরীক্ষা। আল্লাহর হুকুমে স্ত্রী ও সন্তানকে মরুভূমিতে রেখে আসলেন। স্ত্রীর কোনো বাদ-প্রতিবাদ নেই। শুধু জানতে চেয়েছেন, এটি কি আল্লাহর হুকুম? জবাব পেয়েছেন, হ্যাঁ। তারপরের কাহিনী আরো বেশি মর্মস্পর্শী। ছেলে যখন (ইসমাইল আ.) দৌড়াদৌড়ি করার বয়সে উপনীত হন তখন স্বপ্নে দেখেন, প্রিয়তম জিনিসকে কুরবানি করার। বারবার উট যবেহ করার পর একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি। বৃদ্ধ বয়সে প্রাপ্ত চোখ-জুড়ানো সন্তানের চেয়ে প্রিয় আর কিছু তাঁর ছিল না। স্বপ্নের কথা ছেলেকে অবহিত করলে ছেলে জবাব দেন, ‘আব্বা! আপনি তাই করুন যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন। ইনশা-আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজন পাবেন’।
দিনক্ষণ ঠিক করে স্ত্রীর সাজিয়ে দেয়া সন্তানকে ইব্রাহিম (আ) নিয়ে গেলেন যবেহ করার জন্য। শয়তানের সকল প্ররোচণা ও সন্তানবাৎসল্য সবকিছুর ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি বিজয়ী হয়। আর আল্লাহ তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দার ত্যাগ ও কুরবানির মূল্যদানে কখনই কার্পণ্য করেন না। মানুষ কিয়ামত পর্যন্ত ইব্রাহিম (আ) ও তাঁর পরিবারের ত্যাগ ও কুরবানি গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তিভরে স্মরণ করবে। হজ্জের আনুষ্ঠানিকতায় সবই ইব্রাহিম (আ) ও তাঁর পরিবারের স্মরণ। সাফা-মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি, কংকর নিক্ষেপ, জমজমের পানি পান, কুরবানি সবকিছু তাঁদেরই স্মৃতি বহন করে চলেছে। ইসমাইল (আ)-এর জীবনরক্ষার্থে মা’র কী ব্যাকুলতা এবং মরুভূমিতে তাঁদের প্রয়োজনে সৃষ্ট জমজম কূপ হাজার হাজার বছর ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষের পিপাসা মেটাচ্ছে। এ এক বিষ্ময়! মানুষের হেদায়াতের জন্য এটিই যথেষ্ট হতে পারে। হতভাগা যারা কোনো কিছু থেকেই তারা হেদায়াত পায় না। ওরা বধির (কানে শুনে না), অন্ধ (চোখে দেখে না), চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও অধম।
হযরত ইব্রাহিম (আ) ছিলেন আল্লাহর অনুগত (মুসলিম)। আনুগত্যের ক্ষেত্রে নিজের জীবন, মাতৃভূমি, পরিবার ও সন্তান কোনো কিছুর মায়া-ভালোবাসা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। পিতা ইব্রাহিমের (আ) সন্তান হিসেবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ অর্থাৎ নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে জীবনের সফলতা। রসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সন্তান হিসেবে পিতাকে মর্যাদার আসনে আসীন করার লক্ষ্যে আল্লাহর হুকুমে তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণের সময় হযরত ইব্রাহিম (আ) ও তাঁর পরিবারের প্রতি দরুদ পাঠের ব্যবস্থা করেছেন।
আজ মুসলিম জাতি আল্লাহর আনুগত্য ও রসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুসরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চরম অধপতনে নিমজ্জিত। চরম স্বার্থপরতা, ঘুষ-দুর্নীতি, পরস্পর ঘৃণা-বিদ্বেষ, গর্ব-অহঙ্কার, মিথ্যাচার, বাগাড়ম্বর তাদেরকে পেয়ে বসেছে। মুসলিম নামধারী এসব দুর্বৃত্তদের সংস্পর্শে মানুষ কেবল দুর্গন্ধই অনুভব করে, ফলে তাদের কপালে জুটে কেবল ঘৃণা। অথচ এই মুসলমানদের একটি অংশ এখনও নামায পড়ে ও কুরবানি দেয়। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার যে নজির ইব্রাহিম (আ) ও তাঁর পরিবার প্রদর্শন করেছেন তার ছিটেফোটাও সন্তান হিসেবে আমাদের মাঝে নেই। অথচ এখনো আমরা উচ্চারণ করি, ‘নিশ্চয়ই আমার নামায, (কুরবানি) আমার যাবতীয় ইবাদত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য, যাঁর কোনো শরীক নেই। এই নির্দেশই আমাকে দেয়া হয়েছে এবং সবার আগে আমিই আনুগত্যের শির নতকারী (মুসলিম)’-আনয়াম ১৬২।
আমাদের মুখে উচ্চারণ ও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা আর আল্লাহর জন্য নই। আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করে এবং হারাম-হালালের বাছ-বিচার না করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার চেষ্টা করি। এই করোনা থেকেও আমরা শিক্ষা গ্রহণ করছি না। মৃত্যুর এতো পোস্ট ও মন্তব্য লেখা শুধুই গতানুগতিতা। আমাদের উপলব্ধিতে মৃত্যুর চিন্তা একেবারেই অনুপস্থিত, আখিরাত তো অনেক দূর। ইব্রাহিম (আ) আল্লাহর ভালোবাসায় সবকিছু উজাড় করে দিয়ে হলেন খলিলুল্লাহ। তাঁর সেই ত্যাগ ও কুরবানিতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যে আমরা তো তাঁরই সুন্নাত হিসেবে বছর বছর কুরবানি করি। হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ইবরাহিম (আ)-এর মতো একনিষ্ঠ মুসলিম হওয়ার তাওফিক দান করো। আমিন। ১২.০৭.২০২০
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment