Skip to main content

কুরবানির বিনিময়েই সম্ভব দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ

কুরবানির শিক্ষা-৩ দুনিয়া ও আখিরাত কোনোটাই ইসলাম উপেক্ষা করে না। মুসলমানদের প্রার্থনা : ‘হে আমাদের প্রভু! তুমি আমদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দাও’। অবশ্য দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, পক্ষান্তরে আখিরাতের জীবন স্থায়ী। বুদ্ধিমান সেই, যে দুনিয়ার জীবনের চেয়ে পরকালকে অগ্রাধিকার দেয়। পক্ষান্তরে নিরেট মুর্খ, বোকা ও হতভাগা সেই যে দুনিয়া অর্জন করতে গিয়ে পরকালকে বিসর্জন দেয়। পরকাল বিসর্জন দেয়া অর্থ, দুনিয়া পেতে হালাল-হারাম ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য ভুলে যাওয়া। দুনিয়া ও আখিরাত আমরা যেটিই পেতে চাই তার জন্য ত্যাগ স্বীকার অবশ্যম্ভাবী। যে ছেলেটি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে কর্মজীবনে সাফল্য অর্জন করেছে; সে ছেলেটির সাফল্যের পেছনে জড়িয়ে আছে অনেক শ্রম ও কষ্ট-সাধনা। যে ব্যবসায়ী আজ সাফল্যের শীর্ষে তার পেছনের ইতিহাস অত সুখকর নয়, রয়েছে অনেক সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা। রাজনীতিক অঙ্গনেও একই কথা। অনেক জেল-জুলুম, নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করেই তার এই উত্থান। এ অঙ্গনে ত্যাগী কর্মীর মূল্যায়নের কথা খুব জোরেশোরে শোনা যায়। সন্তান জন্ম, লালন-পালন ও সংসারে কষ্টকর ভূমিকা পালনের কারণেই মা’র এতো মর্যাদা। বাড়ির যে বউটির ত্যাগ-কুরবানি যত বেশি সবার কাছে তার সম্মান ও মর্যাদাও তত বেশি। যে সন্তান তার পিতা-মাতার জন্য অগ্রগামী হয়ে খোঁজ-খবর নেয়, সেবা-যত্ন করে, অর্থকড়ি খরচ করে ও ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ করে অর্থাৎ ত্যাগ স্বীকার করে সেই তো তার পিতা-মাতার সবচেয়ে প্রিয়ভাজন। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও ত্যাগের মাধ্যমেই একে অপরের নিকটবর্তী হয়। অফিসে ঐ কর্মচারীরই মূল্যায়ন হয় যে আন্তরিক ও ত্যাগী। দুনিয়ার জীবনে সকল ক্ষেত্রে এটিই সত্য। কুরবানির অর্থ নৈকট্যলাভ। আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই পশু কুরবানি করা হয়। আখিরাতের সাফল্যের পেছনেও রয়েছে অনেক ত্যাগ ও কুরবানি। কালিমা তাইয়্যেবাহ্ ঘোষণা দিয়ে যে ইসলামে প্রবেশ করে তাকে অনেক কিছু বিশেষ করে হারাম উপার্জনের সকল পথ ত্যাগ করতে হয়। তার জীবনে নেমে আসতে পারে আর্থিক দুরবস্থা। নামাযের মতো অত্যাবশ্যকীয় ইবাদতসমূহ পালনের ক্ষেত্রেও আরামদায়ক ঘুম, বিশ্রাম ও কর্মব্যস্ততা পরিহার করে মসজিদ পানে ছুটে যেতে হয়, ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করে রোযা পালন ও কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করে যাকাত আদায় করতে হয়। আল্লাহর আরো নৈকট্যলাভের উদ্দেশ্যে তাহাজ্জুদ নামায, নফল রোযা, নফল অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন পড়ে। এ সবই ত্যাগ ও কুরবানি এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে যত ত্যাগ স্বীকার করবে সে তত নৈকট্য লাভ করবে। মানবজাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহপাক সর্বশেষ রসূল পাঠান মুহাম্মদ (সা)-কে। সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী এই মানুষটি তাঁর সমাজে সুদীর্ঘ ৪০টি বছর কাটিয়েছেন। বংশীয় আভিজাত্য ও অনুপম চরিত্রের কারণে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে সমাজে চলাফেরা করেছেন। নবী হওয়ার পর দ্বীনের দাওয়াত দানের সাথে সাথে নিজ বংশ, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজপতিদের দ্বারা তিনি নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। এমন কি পুত্র সন্তানের ইন্তেকালের পরে সহানুভূতি পাওয়ার পরিবর্তে তাঁর আপন চাচাসহ সমাজের মানুষ তাঁর সন্তান হারানোকে খুশি হিসেবে প্রকাশ করেছে, যা ছিল বড়ই পীড়াদায়ক। সেই সময়ে সান্ত্বনা হিসেবে আল্লাহ নাজিল করেন সূরা কাউছার। আল্লাহ তাঁর নবী (সা)-কে কাউছার দান করেছেন অর্থাৎ প্রাচুর্য, সীমাহীন প্রাচুর্য। নাম, যশ, খ্যাতি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা যেদিক দিয়েই চিন্তা করা যায়, আল্লাহ তাঁর নবী (সা)-কে যা দিয়েছেন দুনিয়ার আর কাউকে দেননি। কাউছার দান সান্ত্বনার সাথে সাথে ভবিষ্যৎ বাণীও। নিপীড়িত-নিঃগৃহিত সেই মানুষটি পৃথিবীর সেরা মানুষে পরিণত হবেন এবং বিপুল পরিমাণ ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী হবেন, সে সময়ে কেউ কি তা কল্পনা করেছিল? কয়টি বছর যেতে না যেতেই তিনি মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেন এবং নবগঠিত রাষ্ট্রের তিনিই সব। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে আসীন হওয়ার মধ্য দিয়েই একজন ব্যক্তি যথার্থ সম্মান ও মর্যাদায় অভিষিক্ত হন এবং আজও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। হাশরের ময়দানে হাউজে কাউছার নবী মুহাম্মদ (সা)-এর জন্য হবে বড় প্রাপ্তি। কাউছার দানের কথা উল্লেখ করার সাথে সাথে আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন, ‘প্রভুর উদ্দেশ্যে নামায পড়ো ও কুরবানি করো’। কাউছার লাভ ও তা টিকিয়ে রাখার জন্য দু’টি শর্ত : এক. নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরী, দুই. আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সব ধরনের ত্যাগ ও কুরবানির জন্য প্রস্তুত হয়ে যাওয়া। এটি শুধু রসূল (সা)-এর জন্য নির্দিষ্ট নয়, এটি তাঁর উম্মতের জন্যও। মু’মিনরা যদি ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হয়ে আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা চালায় তাহলে আল্লাহ তাদেরকে খেলাফত দানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ (সূরা নূর ৫৫)। আবেদ থেকে অগ্রসর হয়ে তাদেরকে আনসারুল্লাহ হতে হবে এবং লড়াই-সংগ্রামের ময়দানে নিজের সময়, অর্থকড়ি ও জীবনকে কুরবানি করতে হবে। আমরা যদি একটু মনোযোগের সাথে কুরআন অধ্যয়ন করি ও রসূল (সা)-এর জীবন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে দেখবো, সকল ব্যবস্থাপনার ওপর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার চেষ্টা-প্রচেষ্টাই মুহাম্মদ (সা)-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য (সূরা তাওবা, ফাতহা ও সফ) এবং সেটিকে কেন্দ্র করেই তাঁর সমগ্র জীবন আবর্তিত হয়েছে। আল্লাহর পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে (জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ) সর্বোত্তম আমল এবং বিনিময়ে গুনাহের ক্ষমা ও জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহর পথে শহীদকে তিনি মৃত বলতে নিষেধ করেছেন। এ সবই কুরবানি এবং যে যতো কুরবানি পেশ করতে পারবে সে তত আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে। আল্লাহর পথে ত্যাগ ও কুরবানির লক্ষ্যে মু’মিদেরকে বারবার আহবান জানানো হয়েছে। আর্থিক কুরবানিকে তাঁকে দেয়া ঋণ বলে উল্লেখ করে বহুগুণ বৃদ্ধিসহ ফেরৎ দানের ওয়াদা করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে ঈমান আনার পাশাপাশি নিজে নেক আমল করাটাকে যথেষ্ট বিবেচনা করা হয়নি। বরং ঈমান ও নেক আমলের পুঁজি সমাজে আবর্তিত হয়ে আরো অনেক আল্লাহর বান্দা হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে এবং একটি কল্যাণকর সমাজে রূপ নেবে এটিই আল্লাহর অভিপ্রায় এবং ত্যাগ ও কুরবানি ছাড়া তেমন একটি সমাজ কল্পনাও করা যায় না। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর পথে চলার ক্ষেত্রে সব ধরনের কুরবানি মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন। ০৭.০৭.২০২০। চলবে।

Comments