আল্লাহপাকের নাফরমানির নামই হলো গুনাহ। বান্দার পক্ষে মনিবের নাফরমানি কি কল্পনা করা যায়? ছোট হোক, বড় হোক আল্লাহর মর্জির খেলাপ মাত্রই গুনাহ। গুনাহের শ্রেণিবিভাগ করা বড় কঠিন। যেমন অধীনস্ত ব্যক্তি বসের হুকুমের শ্রেণিবিভাগ করতে পারে না। উর্ধতনের নির্দেশ পালনই নিয়ম। তারপরও আমরা কুরআন-হাদিস ও বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা অপরাধের ছোট-বড় নিয়ে আলোচনা করবো ইনশা-আল্লাহ।
যে কোনো ধরনের অধিকার ভঙ্গ হলো গুনাহ। তা আল্লাহর হোক বা বান্দার হোক। যেমন, আল্লাহর অধিকার হলো, মানুষ কেবল তাঁরই হুকুম মেনে চলবে এবং হুকুম মানার ক্ষেত্রে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। এজন্য শিরককে বলা হয় সবচেয়ে বড় জুলুম বা বড় গুনাহ। ইসলামের দৃষ্টিতে হক দ্বিবিধ-আল্লাহর হক ও বান্দার হক। আল্লাহর হক নষ্টকারী বান্দা তাওবা করলে তাৎক্ষণিক ক্ষমা পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে বান্দার হক নষ্টকারী ব্যক্তি যতক্ষণ না মজলুমের কাছ থেকে ক্ষমা না পায় ততক্ষণ আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না।
মনে করুন মূর্তিপূজারী একজন অমুসলিম জীবনভর আল্লাহর নাফরমানি করে আসছে; কিন্তু যখনই সে তাওবা করে ইসলাম গ্রহণ করছে তখনই তার পেছনের সকল গুনাহ ক্ষমা হয়ে যাচ্ছে। নামায না পড়া কবীরা গুনাহ এবং নামায না পড়া ব্যক্তিকে মুসলমান গণ্য করা হয় না; জীবনে নামায না পড়া ব্যক্তি বা রোযা পালন না করা ব্যক্তি তাওবা করে নামায-রোযা শুরু করলেই তার পেছনের গুনাহের ক্ষমা পেতে পারে। তাহলে ভাবতে পারেন, বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলে (মনে করুন ৬০ বছর) তাওবা করে খুব ভালোভাবে নামায-রোযা শুরু করে দিব। হ্যাঁ পারেন, তবে আপনাকে ৬০ বছর হায়াতের একটি গ্যারান্টি পেতে হবে। যেহেতু মৃত্যু অনিশ্চিত, তাই জীবনটাকে সর্বক্ষণ আল্লাহর আনুগত্যের মধ্য দিয়ে পরিচালনার জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট ইবাদত-বন্দেগী পালনে শৈথিল্য বা দুর্বলতা যে কোনো সময়ে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়ার একটি সুযোগ রয়েছে। তারপরও বলবো, বিষয়টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং পরকালে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি কখনই তার নিজের সম্পর্কে বেপরোয়া হতে পারে না। তাই সে সর্বক্ষণ আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হয়ে চলার চেষ্টা করে এবং তাঁর নাফরমানির পর্যায়ে পড়ে এমন কার্যক্রম থেকে সর্বদা দূরে থাকে। চরিত্রের এটি একটি দিক যা আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত; ভিন্নতর দিক, যেটি বান্দার সাথে সংশ্লিষ্ট, সেটি বড় ভয়াবহ এবং অধিক সংখ্যক মানুষের জাহান্নামে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেটিই হবে বড় কারণ। বর্তমান মুসলমানরা এই দ্বিতীয় পর্যায়ের গুনাহকে বড় হালকাভাবে গ্রহণ করার কারণে আজ তাদের এই দুরবস্থা।
মনে করুন, একজন ব্যক্তি সারাটা জীবন তাহাজ্জুদের নামায পড়েন, প্রতি রমযানে কুরআন খতম করেন এবং এলাকায় মসজিদ-মাদ্রাসায় দানের ক্ষেত্রে খুবই অগ্রণী; কিন্তু ভোটের দিন সব ভোটারকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজের পক্ষে বাক্স ভরে ফেলেন, আপনি কি মনে করেন তার গুনাহের তুলনায় ঐ সব নেকি কোনো কাজে আসবে? কুরআন-হাদিস পাঠের মাধ্যমে আমার যে উপলব্ধি তাতে আমি বিনা দ্বিধায় বলতে পারি তার বদির পাল্লা এতো ভারি হবে যে তা মাটির সাথে আটকে থাকবে, পক্ষান্তরে তার নেকির কোনো ওজনই হবে না, হবে না এই কারণে যে সে স্রেফ মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য ঐ সমস্ত আমল করেছে আর তার সাঙ্গপাঙ্গ দ্বারা প্রচার চালিয়েছে। আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস থাকলে তার মধ্যে দ্বৈত ভূমিকা থাকতো না।
আপনি কি মনে করেন অফিসে যে লোকটি ঘুষ খায় বা তিন টাকা দামের দ্রব্যের দশ টাকা ভাউচার বানায় বা ক্রেতাকে ওজনে কম বা ভেজাল দিয়ে ঠকায় সে কি পরকালে বিশ্বাস করে? যে ব্যক্তি গুম, খুনের সাথে জড়িত বা মানুষের প্রতি জুলুম করে, তার এ কাজের পেছনে আখিরাতে বিশ্বাসের কোনো যোগসূত্র আছে কি? নিরেট নাস্তিকের পক্ষেই সম্ভব মানুষের প্রতি জুলুম বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করা।
আল্লাহপাক তাঁর নবী (সা)-এর প্রতি হিজরতের প্রাক্কালে নামাযের বিধান এবং হিজরতের পরে রমযানের রোযা ফরজ করছেন। তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারী ব্যক্তির মধ্যে তেরোটি বছর ধরে তিনি কী পরিবর্তন আনতে চাইলেন? বান্দার মধ্যে বিশ্বাস এবং বিশ্বাসের আলোকে চরিত্র। আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও আল্লাহর কাছে জবাবদিহির অনুভূতিই অসভ্য ও বর্বর মানুষগুলোকে পৃথিবীর সুসভ্য মানুষে পরিণত করেছিল। মক্কীযুগে অবতীর্ণ সূরা ও আয়াতসমূহ একটু লক্ষ্য করুন। সূরা হুমাযায় বলা হয়েছে, নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য, যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল করে ও পেছনে দোষ প্রচার করে। এদের পরিণতি বলা হয়েছে হুতামা, আল্লাহর আগুন-প্রচন্ডভাবে উত্তপ্ত-উৎক্ষিপ্ত। একটু গালাগালি করা ও পেছনে নিন্দাবাদের পরিণতি যদি এই হয় তবে যারা গুম-খুনের সাথে জড়িত তাদের পরিণতি কী হবে? জাহান্নাম ছাড়া ভিন্ন কিছু কি কল্পনা করা যায়?
আপনি সূরা মাউন পড়ুন। ইয়াতিমকে ধাক্কা দেয়া (হক নষ্ট করা), মিসকিনকে খাবার দিতে উৎসাহ না দেয়াকে পরকালে বিশ্বাসহীনতার পরিচায়ক বলা হয়েছে। মিসকিনের রিলিপের সামগ্রী চুরি করাকে কিভাবে দেখবেন? আপনি কি মনে করেন, তার মধ্যে সর্ষেকণা ঈমান আছে? সূরা আসরে ধ্বংস ও বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে চারটি গুণের কথা বলা হয়েছে। প্রথমেই বলা হয়েছে ঈমান এবং সাথে সাথে উল্লেখ করা হয়েছে নেক আমলের কথা। এখানে নেক আমলের কোনো ফিরিস্তি দেয়া হয়নি। মানুষের প্রকৃতি (বিবেক-বুদ্ধি) যে কাজটিকে ভালো মনে করে সেটিকেই বোঝানো হয়েছে। একজন মু’মিনের কাছ থেকে কখনই কোনো মন্দ কথা, আচরণ বা কর্ম সম্ভব নয়, আখিরাতে বিশ্বাসী ব্যক্তি মন্দ আমল কিভাবে করবে? শুধুই কল্যাণকর কাজ তার থেকে মানুষ আশা করবে।
আখিরাতে লক্ষ্য করবেন, দুর্নীতিবাজ যতো কর্মকর্তা রয়েছে সবার ঘাড়ে দুর্নীতির বোঝা। কারো ঘাড়ে ল্যাপটপ-কম্পিউটার বা আসবাবপত্র বা ব্রিজ-কালভার্ট বা আস্ত বিল্ডিং বা পদ্মাসেতু ইত্যাদি। হ্যাঁ, আল্লাহর রসূল (সা) এমনই বলেছেন, ‘আমরা যখন কাউকে সরকারি দায়িত্ব প্রদান করি সে যদি এক টুকরো সূতা বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র জিনিস আত্মসাৎ করে তাহলে সে খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে কিয়ামতের দিন উত্থিত হবে’। সরকারি দায়িত্বের ভার কতো কঠিন, এবার বুঝুন। আমরা অধ্যক্ষ হতে চাই, প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার হতে চাই- দায়িত্ব যতো বড় তার ভারও তত বড়। সকল দায়িত্বশীলকে তার নিজের ও অধীনস্তদের পক্ষ থেকে জবাবদিহি করতে হবে। এই বিশ্বাস যার রয়েছে তার পক্ষে কি কখনো সম্ভব দুর্নীতি করার?
বান্দার প্রতি আল্লাহ অত্যন্ত দয়ার্দ। তিনি তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য উদ্গ্রীব। সাথে সাথে তো এটিও ঠিক, তাঁর যে সব বান্দার সাথে জুলুম করা হবে তার বদলা গ্রহণও তাঁর ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতার দাবী। কুরআন ও হাদিসে সদাচরণ ও ন্যায়পরায়ণতার কথা বারবার বলা হয়েছে। রসূল (সা)-এর বাণীগুলো একটু খেয়াল করুন- ‘এই পৃথিবীতে যারা রয়েছে তাদের সাথে সদাচরণ করো তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন’। ‘যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না’। ‘যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়, সে মু’মিন নয়’। দু’জন মহিলা সম্পর্কে আল্লাহর রসূল (সা)-কে প্রশ্ন করা হয়- একজন ইবাদত-বন্দেগী বেশি করেন কিন্তু আচরণ মোটেই ভালো নয়; পক্ষান্তরে অন্যজনের ইবাদত-বন্দেগী কম কিন্তু আচরণ অত্যন্ত ভদ্র ও মার্জিত। রসূল (সা) প্রথম জনকে জাহান্নামী ও দ্বিতীয় জনকে জান্নাতী বলে উল্লেখ করেন।
রসূল (সা)-এর জীবনে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। তাঁকে অনুসরণ করা আমাদের জন্য ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যেই তাঁকে পাঠানো হয়েছে। এ কথা নানাভাবে তিনি উল্লেখ করেছেন। যথার্থ অনুসরণ হবে আল্লাহর দ্বীনকে নিজের জীবনে অনুসরণ, মানুষের কাছে উপস্থাপন ও সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালানো। নিজেদের চরিত্রকে আল্লাহর রসূল (সা)-এর চরিত্রের আদলে গড়ে তোলার মাধ্যমেই সম্ভব এই কাজে ভূমিকা রাখা। দুর্ভাগ্য, আজকে রসূল (সা)-এর অনুসরণকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে রফে ইয়াদাইন করা না করা, আমিন জোরে না আস্তে বলা ইত্যাদি অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে পরস্পর তর্ক-বিতর্কের মধ্যে। অথচ প্রয়োজন ছিল, কখনো মিথ্যা না বলা, আমানতে খেয়ানত না করা, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করা, মানুষের প্রতি বিনয়ী হওয়া, অসহায় ও দরিদ্রদের প্রতি দরদী হওয়াসহ মৌলিক মানবীয় গুণে ভূষিত হওয়া। আল্লাহর রসূল (সা) ছিলেন সকল মানবীয় গুণে সজ্জিত এক অনুপম চরিত্রের অধিকারী মহামানব।
আল্লাহর সকল সৃষ্টি তাঁর প্রশংসা করছে (তাসবিহ করছে)। ফেরেশতাদের আহার নেই, নিদ্রা নেই, বিশ্রাম নেই। প্রশংসা করার পাশাপাশি তাঁর সা¤্রাজ্য পরিচালনায় সর্বক্ষণ হুকুম পালন করে যাচ্ছেন। মানুষ তো আল্লাহরই প্রতিনিধি এবং এই পৃথিবীতে তাঁর শাসন কার্যকর করার জন্য তাঁরই প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। এই ভূমিকা পালনের মধ্যেই রয়েছে তার শ্রেষ্ঠত্ব। সে আব্দুল মালেক হয়ে সুশাসন কায়েম করবে, আব্দুল হাকিম হয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, আব্দুর রব হয়ে সৃষ্টির লালন-পালন করবে, আব্দুর রাজ্জাক হয়ে রিজিকের ইনসাফপূর্ণ বন্টন করবে। এভাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-লিঙ্গ নির্বিশেষে পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা ভোগ করবে এবং এটিই আল্লাহপাকের অভিপ্রায়। এদেরই জন্য রয়েছে অসংখ্য নেয়ামতেভরা জান্নাত। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে তাঁর যথার্থ বান্দা ও প্রতিনিধি হওয়ার তাওফিক দান করুন। ২৮.০৭.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment