আল্লাহপাক ক্ষমার আধার। ক্ষমা করার মধ্যেই যতো তাঁর আনন্দ। মজার ব্যাপার হলো, বান্দাহ যখন ভালো কাজের নিয়ত করে তখনই তার আমলনামায় নেকি লেখা হয়। আর যখন কাজটি বাস্তবে রূপ দেয় তখন তার ছওয়াব দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন এবং সেটি দেন কাজের প্রতি তার নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও একাগ্রতার ওপর ভিত্তি করে। পক্ষান্তরে শাস্তিদানের ক্ষেত্রে তাঁর আচরণটা এমন যেন নিতান্ত ঠেকায় পড়ে তিনি তাঁর বান্দাকে শাস্তি দেন। বান্দা যতটুকু অন্যায় করে ঠিক ততটুকুই লিখে রাখেন এবং অপেক্ষা করেন বান্দার তাওবা পর্যন্ত। শুধুই কি তাই? বান্দাহ যখন নামাযের জন্য আসে, এক ওয়াক্ত থেকে আর এক ওয়াক্ত পর্যন্ত সময়কালের গুনাহ তিনি নিজ থেকেই ক্ষমা করে দেন। তিনি বলেছেন, ‘যে বিপদ আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই, অবশ্য আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অনেক অপরাধ এমনি ক্ষমা করে দেন’-সূরা আশ শূরা ৩০। আবার হাদিসে বলা হয়েছে ভালো কাজ মন্দ কাজকে মিটিয়ে দেয়। যে আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি এতো দয়ার্দ, এতো উদার সেই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ না হয়ে পারা যায়?
বান্দাকে শাস্তিদানের জন্য আল্লাহর কোনো তাড়াহুড়ো নেই। বরং তিনি অপেক্ষা করেন তাঁর বান্দাহ কখন ফিরে আসবে? আমরা অনেক সময় ভাবি, এতো জুলুম-নির্যাতনের পরও পাপীষ্ঠ-জালেমকে আল্লাহ ধরেন না। না ধরার পেছনে তাঁর অক্ষমতা নয় বরং তাঁর উদারতা ও ক্ষমাশীলতাই কারণ। আবার বান্দার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুনাহ ধরার জন্য মাইক্রোস্কপ নিয়ে তিনি বসে থাকেন না। বরং তিনি অগ্রিম জানিয়ে দিয়েছেন, তোমরা বড় বড় গুনাহ থেকে দূরে থেকো, তাহলে ছোট গুনাহসমূহ এমনিতেই ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ মু’মিনদের চরিত্র উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘যারা বড় বড় গুনাহ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকে আর ক্রোধ হলে ক্ষমা করে দেয়’-সূরা আশ শূরা ৩৭। আল্লাহ নিজে যেমন উদার ও ক্ষমাশীল, তেমনি তিনি তাঁর বান্দাহ ও প্রতিনিধির মাঝেও সেই গুণ দেখতে চান।
আল্লাহপাক বড় বড় গুনাহ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। বড় বড় গুনাহ বলতে বোঝায় অধিকার হরণ। সেটি হতে পারে আল্লাহর বা তাঁর বান্দার। আল্লাহর হক হলো মানুষ একনিষ্ঠভাবে তাঁর হুকুম মেনে চলবে (ইবাদত) এবং হুকুম মানার ক্ষেত্রে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। এজন্য শিরককে বলা হয়েছে সবচেয়ে বড় গুনাহ। পরবর্তী পর্যায়ে আসে মানুষের অধিকার হরণ এবং এক্ষেত্রে যে যতো বেশি নিকটবর্তী তার হক নষ্ট করা তত জুলুম ও বড় গুনাহ। পিতা-মাতার হক, স্বামী-স্ত্রীর হক, সন্তানের হক, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি, ইয়াতিম-মিসকিন, অধীনস্থ, এককথায় সকল মানুষের হক নষ্ট করা কবীরা গুনাহ। ওজনে কম-বেশি, ধোঁকা-প্রতারণা, ঘুষ-দুর্নীতি সকল অনৈতিক কাজে কারো না কারো হক নষ্ট হয় এবং সবই কবীরা গুনাহ। আল্লাহর আদালতে এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। এসব অপরাধ থেকে যারা মুক্ত হবে আল্লাহপাক তাদেরকে ক্ষমা করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
কবীরা গুনাহ সম্পর্কে উম্মাহর মধ্যে মোটামটি ঐকমত্য রয়েছে। উম্মাহর মাঝে যে ভিন্নতা ও মতপার্থক্য তা মূলত মুস্তাহাব বা ছোটখাট আমল নিয়ে। এই ভিন্নতার মাঝে কোনো দোষ দেখি না এবং আমি জানি, মহান আল্লাহ এসব বিষয়ে তাঁর বান্দাদেরকে কখনো জিজ্ঞাসার মুখোমুখিও করবেন না, বরং জিজ্ঞাসাবাদ করবেন এসব নিয়ে কেন ঝগড়া-ঝাটি করা হয়েছে এবং পরস্পর ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে? ঘৃণা, বিদ্বেষ পোষণ ও হিংসা করা কবীরা গুনাহ এবং তাওবা ছাড়া ক্ষমা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। হিংসুটের জন্য জান্নাতে কোনো স্থান নেই। প্রিয়তম নবী তাঁর উম্মতদেরকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘আগুন যেমন শুকনো কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের সকল আমল ধ্বংস করে দেয়’। আল্লাহপাকের কাছে হিংসুটে বড় ঘৃণিত এবং তিনি তাঁর বান্দাদেরকে হিংসুটের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে তাঁর কাছে আশ্রয় চাওয়ার জন্য বলেছেন (সূরা ফালাক)।
সংকীর্ণতা ও অনুদার মানসিকতার কারণে আজ আর আমাদের গৃহ শান্তির নীড় নয়। পরিবার ও সমাজে নেই প্রশান্তি। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ক্ষমা, সহনশীলতা ও উদারতার কোনো বিকল্প নেই। কতো ভাবেই না রসূলুল্লাহ (সা) তাঁর উম্মতদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন। ‘যে তার ভাইকে ক্ষমা করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন’। ‘যে তার ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন’। ‘যে দয়া করে না সে দয়া পায় না’। মানুষের মধ্যে উদারতা ও প্রশস্ততা বাড়ানোর জন্য কতো না ছিল তাঁর প্রচেষ্টা। আল্লাহ বলেছেন, ‘যে স্বীয় মনের সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করলো সেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করলো’-সূরা তাগাবুন ১৬। ক্ষমার চেয়ে বড় গুণ আর নেই। যে মানুষকে ক্ষমা করতে পারে সেই সবচেয়ে বড়, দুনিয়া ও আখিরাতে।
বাংলাদেশে উদারতা, সহনশীলতা, ক্ষমাশীলতার পরিবর্তে চলছে হিংসা-বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ পরায়ণতার চাষ। কে বলবে প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)-এর অনুসারী পরকালে বিশ্বাসী আমরা এক জাতি। মুসলিম হওয়ার সকল গুণ-বৈশিষ্ট্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এক কদর্য চেহারা ও দুর্গন্ধেভরা আমাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন ও চরিত্র। এমন চরিত্রের লোকদেরকে আল্লাহ কিভাবে ক্ষমা করবেন। আমাদের নেতৃবৃন্দ অনর্গল মিথা বলেন, ঘুষ-দুর্নীতিতে তাঁরা আকণ্ঠ ডুবে আছেন। জনগণের অধিকার হরণে আমরা বিশ্বসেরা। না, জনগণের প্রতি রয়েছে আমাদের আস্থা আর না আমাদের নেতৃবৃন্দের প্রতি রয়েছে জনগণের আস্থা। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, সবচেয়ে বড় গুনাহ কোনটি? আমি বিনা দ্বিধায় বলবো, জনগণের অধিকার হরণ। আবার যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে কি? আমি বলবো, হ্যাঁ আছে। তা হলো, জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। অর্থাৎ একটি সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনই পারে পরস্পরের আস্থাহীনতা দূর করে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে।
সমাজে রাজনীতিবিদদের সম্মান ও মর্যাদা অতি উচ্ছে। সাথে সাথে তাদের দায়িত্বও সীমাহীন। কিয়ামতের দিন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকের স্থান হবে আল্লাহর আরশের ছায়ায়। শাসককে আল্লাহর আদালতে ব্যক্তিগতভাবে দাঁড়ানোর সাথে সাথে তাঁকে তাঁর জনগণের পক্ষেও জবাবদিহি করতে হবে। বড় ভয়ানক অবস্থা হবে তাঁর। তাই ছলে-বলে-কৌশলে শাসক হওয়া ও টিকে থাকার চেষ্টা বড় নির্বুদ্ধিতা বৈ আর কিছু নয়। জনগণের শাসক হওয়ার জন্য উদ্যোগী হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর রসূল (সা) হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
বিশ্বব্যাপী করোনা আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা। মানুষ যদি সতর্ক না হয় তাহলে সেটি হবে তার জন্য বদনসিব। আমরা কেউ এ দুনিয়ায় থাকবো না। করোনায় হোক বা অন্য কোনোভাবে হোক আমাদেরকে মহান আল্লাহর দরবারে যেতেই হবে। কোনো উপায় নেই। তাই সরকারি ও বিরোধী দল-আমাদের অবস্থান যেখানেই হোক, প্রতিশোধপরায়ণ না হয়ে আমরা পরস্পরকে ক্ষমা করে আমাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলি। একজন মুসলমানের পক্ষে ক্ষমা করার মধ্যে লাভ ছাড়া কোনো লোকসান নেই। ক্ষমার বিনিময় আল্লাহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিবেন এবং আখিরাতে ক্ষমা ও জান্নাতপ্রাপ্তির চেয়ে একজন ব্যক্তির বড় কিছু আর পাওয়ার নেই।
হে আল্লাহ! আমরা তোমারই প্রতিনিধি। আমাদেরকে তুমি তোমার গুণে গুণান্বিত, তোমার রঙে রঞ্জিত হওয়ার তাওফিক দান করো। পরোয়ারদেগার! ক্ষমা, উদারতা ও প্রশস্ততার গুণে আমাদের সজ্জিত হওয়ার তাওফিক দান করো। তোমার বান্দাদের ক্ষমা করার মাধ্যমে আমাদের জীবনকে সহজ-সরল ও নিরুদ্বিগ্ন করে দাও। হে রব! তুমি আমাদের মোনাজাত কবুল করো ও তোমার নেক বান্দাদের মধ্যে শামিল করে দাও। আমিন। ২৫.০৭.২০২০।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment