Skip to main content

কুরবানি চিরন্তন

মানবসৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে কুরবানি চলে এসেছে। সূরা মায়েদা ২৭ নং আয়াতে আল্লাহপাক আদম (আ)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানি পেশের কথা বলেছেন। সেখানে একজনের কুরবানি কবুল হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যার কুরবানি কবুল হয়নি সে হিংসার বশবর্তী হয়ে অপর ভাইকে হত্যা করার কথা বলে। জবাবে ভাইটি বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা কেবল মুত্তাকীদের কাছ থেকেই কুরবানি কবুল করেন’। হত্যা করার কথা বললে জবাবে সেই ভাই আরো বলেন, ‘তুমি হত্যার উদ্দেশ্যে হাত বাড়ালেও আমি বাড়াবো না, কারণ আমি আল্লাহকে ভয় করি’। এখানে এটিও উল্লেখ্য, নরহত্যার মত জঘন্য কাজ কোনো মুত্তাকী লোকের দ্বারা সম্ভব নয়। কুরবানির নিয়ম-কানুন পরিবর্তন হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কুরবানি মানব ইতিহাসের আদিকাল থেকে চলে আসছে। আমাদের প্রতিবেশি হিন্দুদের মাঝেও বলিদান প্রথা চালু আছে। আমরা এখন যে কুরবানি করি তা আজ থেকে চার হাজার বছর পূর্বে হযরত ইব্রাহিম (আ) কর্তৃক আপন ছেলেকে কুরবানি করার স্মরণ হিসেবে প্রতিকী পশু কুরবানি করা। কুরবানি স্রেফ কোনো উৎসব নয়; কুরবানি হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নিজের মধ্যে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করার লক্ষ্যে। এ প্রসঙ্গে সূরা হজ্জ ৩৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে কখনো গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়াটুকুই’। একজন কুরবানিদাতা এ ঘোষণাই প্রদান করে, ‘নিশ্চয়ই আমার নামায, কুরবানি (যাবতীয় ইবাদত অনুষ্ঠান), আমার জীবন ও মরণ সব কিছু জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার জন্য’- সূরা আনয়াম ১৬২। উপরে আমরা কুরআনের কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করেছি। এতে স্পষ্ট, স্রেফ লৌকিকতা ও প্রদর্শনী আল্লাহর কাছে কোনো মূল্য বহন করে না। আল্লাহর কাছে মূল্য বহন করে ব্যক্তির তাকওয়া। তাকওয়াশূন্য কোনো ইবাদত হোক তা নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ, কুরবানি সবই অর্থহীন। আমাদের সমাজে নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ, কুরবানি সবই রয়েছে; কিন্তু তা আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবেশিত হয়েছে, আল্লাহর স্মরণ ও ভয় আমাদের অন্তরে জাগরুক হচ্ছে না। তাইতো সমাজে এতো অন্যায়-অবিচার, ঘুষ-দুর্নীতি ও খুন-খারাবি। মানুষ আল্লাহকে ভয় করে চললে সমাজ অপরাধ শূন্য হয়ে পড়তো। ইউটিউবে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের (রহ) কুরবানি সম্পর্কীয় আলোচনা শুনলাম। কুরবানি তো ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যলাভ। সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছে ধনী ও শিক্ষিত সমাজ। এই সমাজের মধ্যে কুরবানি দানের প্রবণতা অনেক বেশি। এটি একটি ভালো দিক। আবার এমন অনেকে আছেন যারা কুরবানি করেন অথচ নামায পড়েন না। তাঁর প্রশ্ন, তাতে লাভ কী? কুরবানি দেয়া ওয়াজিব বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। কুরবানি না দিলে কাফির হয়ে যাবে এমন কথা কেউ বলেন না। পক্ষান্তরে নামায না পড়লে কাফির হয়ে যাবে এমন কথা হাদিস থেকেও জানা যায় এবং ফকিহদের মধ্যে অনেকেই বলেন। নামাযের গুরুত্ব অনুভব করে অথচ গাফিলতি হয় এমন লোকদের সম্পর্কে ফকিহরা কাফির না বললেও তাদেরকে বড় গুনাহগার (কবিরা গুনাহ) বলেন। তবে নামাযকে গুরুত্ব না দেয়া বা নামায পড়ে কী হবে বা নামায না পড়লেও ঈমান ঠিক আছে, এমন কথা যারা বলে তারা যে কাফির, এব্যাপারে ফকিহরা একমত। ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর বলেন, লেখাপড়া শেষে দেশে প্রত্যাবর্তনের পরে এলাকায় তাঁর এক বাল্যবন্ধু ইন্তেকাল করলে তাঁকে জানাযা পড়ার জন্য বলা হয়। তিনি যখন জানতে পারলেন, সে নামায পড়ে না তখন তিনি জানাযা পড়ায় অস্বীকৃতি জানান। লোকটির শ্বশুর ছিলেন খুব দ্বীনদার। স্বল্পসংখ্যক মুসল্লি জানাযায় শরীক হলেন। কিন্তু তাতে দেখা গেল, পরবর্তী জুমায় মুসল্লি পূর্ণ হয়ে গেছে। ভাগে কুরবানি করার ক্ষেত্রে যাদের উপার্জন হারাম ও যারা বেনামাযী তাদেরকে এড়িয়ে চলার জন্য তিনি বলেন। তিনি নিজেই প্রশ্ন করেন, সারা জীবন নামায না পড়লেও কুরবানির সময়ে কেউ যদি নামায শুরু করে তাহলে তার বিধান কী? তিনি জবাব দেন, সারা জীবন নামায না পড়ে কেউ যদি তাওবা করে নামায শুরু করে দেয় তাহলে তার নামায না পড়ার পেছনের সব গুনাহ মাফ। এই কুরবানির পেছনে আমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ)-এর চরম আত্মত্যাগ জড়িয়ে আছে। তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজের জীবন, পরিবার ও বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া প্রাণাধিক পুত্রকে জবেহ করার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন। হারাম উপার্জন পরিহার ও নামায আদায়ের মাঝে কিছু কষ্ট তো আছেই। পিতার যোগ্য সন্তান হিসেবে ও আখিরাতে অনন্তকাল সুখ ভোগের জন্য দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে একটু কষ্ট তো সহ্য করাই লাগে। আমরা আমাদের অতীত জীবনের কোনো রোগ-ব্যাধি বা দুর্ঘটনা স্মরণ করে অনুভব করতে পারি যে, দয়াময় আল্লাহ বড় কৃপা করে আমাদেরকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। যোহর পড়ার পর আসর পড়ার কোনো গ্যারান্টি নেই। মৃত্যুর কথা বেশি করে স্মরণের লক্ষ্যেই তো এই মহামারি ‘করোনা’। এই করোনা মু’মিনদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করেছে। আসুন, আর অপেক্ষা না করে নিজেরা সৎ জীবন-যাপন ও নামায শুরু করে দেই। বিশ্বাস করুন, নামায পড়ার মধ্য দিয়েই একজন ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম হিসেবে আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানোর সুযোগ লাভ করবে। কুরআন স্পষ্ট করেছে, নামায না পড়া জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট (সূরা মুদ্দাস্সির)। সূরা বাকারায় বলা হয়েছে, নামায না পড়া পরকাল অবিশ্বাসী কাফিরদের কাজ। নিজেরা নামায পড়ার সাথে সাথে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে নামাযের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করি। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে পিতা ইব্রাহিম (আ)-এর কুরবানি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সব ধরনের নাফরমানি থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন। (কুরবানি সম্পর্কে ধারাবাহক আলোচনার ইচ্ছা রয়েছে, সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি)। ০৫.০৭.২০২০।

Comments