কুরবানি সম্পর্কে ইতোপূর্বে কয়েকটি পর্বে লিখেছি। আজকে মাসালা নিয়ে আলোচনা করবো। বলে রাখি, আমি কোনো ফকিহ নই। ফিকাহর কিতাবপত্র পাঠ ও ফকিহদের আলোচনা শুনে ফেসবুক বন্ধুদের অবহিত করি মাত্র। ফিকাহ বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে বলেই তো চারটি মাজহাবের সৃষ্টি হয়েছে। চারটি মাজহাব ও আহলে হাদিস সবাইকে আমি সত্যাশ্রয়ী মনে করি। আমার নিজস্ব একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং মতপার্থক্যগত বিষয়ে আমি উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি ও যে কোনো একটি মত গ্রহণের এখতিয়ার রয়েছে বলে মনে করি।
আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনই প্রতিটি ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য। কুরবানি সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের রক্ত ও গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া’। ইসমাইল (আ)-এর পরিবর্তে একটি পশু কুরবানির মধ্য দিয়ে আল্লাহ বলেছেন, ‘পরবর্তীকালের লোকদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে জারি করে দিলাম’। পিতা ইবরাহিম (আ)-এর চরম আত্মত্যাগের স্মরণই আমাদের এই কুরবানি। গোশত খাওয়া, প্রদর্শনী বা হারাম উপার্জনে কুরবানির প্রশ্নই উঠে না।
সূরা কাউছারে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমার প্রভুর উদ্দেশ্যে নামায পড়ো ও কুরবানি করো’। নামায না পড়ে কুরবানি করায় কোনো লাভ হবে কি? এ প্রশ্ন থাকতেই পারে। আমি কুরবানিকে নিরুৎসাহিত করছি না। বরং যে কুরবানিতে আল্লাহ বান্দার মাঝে তাকওয়া চাচ্ছেন; সেই কুরবানির নিয়তের সাথে সাথে আমরা সকল গুনাহ থেকে (বিশেষ করে হারাম উপার্জন ও নামায না পড়া) আল্লাহর কাছে তাওবা করি। আল্লাহ তাঁর তাওবাকারী বান্দাকে পছন্দ করেন।
১.কুরবানি প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব/সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। রসূল (সা)-এর উক্তি ওয়াজিব হওয়ার দলিল : ‘সামর্থবান ব্যক্তি যদি কুরবানি না করে সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে’। সুন্নাতে মুয়াক্কাদার দলিল হলো সাহাবায়ে কেরামের (রা) প্রশ্নের জবাবে রসূল (সা) বলেছেন, ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ)-এর সুন্নাত’। ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। কুরবানির অনেক ছওয়াবের কথা হাদিসে উল্লেখ রয়েছে।
২.কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে সাহেবে নেসাব হওয়া শর্ত এবং সারা বছর নয় কুরবানির দিনগুলোয় নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলেই হবে। মুকিম, বালেগ ও সুস্থ হওয়াও শর্ত।
৩.‘সামর্থবান ব্যক্তি যদি কুরবানি না করে সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে’-এর প্রেক্ষিতে কেউ কেউ বলেন পরিবারে যারাই সামর্থবান তাদের সবার প্রতি কুরবানি ওয়াজিব। রসূলুল্লাহ (সা) প্রতি বছর দু’টি হৃষ্টপুষ্ট দুম্বা/ভেড়া কুরবানি করতেন। একটি তাঁর ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে এবং অন্যটি উম্মাহর পক্ষ থেকে। ফলে পরিবার প্রতি একটি পশু কুরবানি দিলেই ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে বলে আশা করি।
৪.কুরবানির বিনিময় অন্য কিছু দিয়ে সম্ভব নয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে শহরে কুরবানি দেয়া সমস্যা হলে গ্রামে তার পক্ষ থেকে আত্মীয়-স্বজন কুরবানি দিয়ে দিলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে।
৫.নিজ হাতে কুরবানি করা উত্তম। কুরবানি মূলত রক্ত প্রবাহিত করা ও রক্ত দর্শন করা। নিজ হাতে জবেহ করতে না পারলে উপস্থিত থাকা ভালো। না থাকতে পারলেও সমস্যা নেই।
৬.চাঁদ উঠার পর থেকে ঈদের নামায পর্যন্ত কুরবানিদাতার নখ, চুল না কাটা মুস্তাহাব।
৭.ঈদুল ফিতরে কিছু খেয়ে যাওয়া সুন্নাত, ঈদুল আযহায় কুরবানির গোশত দিয়ে খাওয়া সুন্নাত।
৮.উট, গরু, মহিষ, ছাগল, দুম্বা ও ভেড়া দিয়ে কুরবানি করা যায়। উট ৫ বছর, গরু ২ বছর এবং ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ১ বছর বয়সের হতে হবে। পশুটি অবশ্যই নিখুঁত হবে।
৯.পশুর গলায় লাল ফিতা বেঁধে চিহ্নিত করায় দোষ নেই। তবে গলায় মালা পরিয়ে বা সাজিয়ে প্রদর্শনীতে রিয়া প্রকাশ পেতে পারে।
১০.ছাগল, দুম্বা ও ভেড়া এককভাবে এবং উট, গরু ও মহিষ সর্বোচ্চ ৭ জন মিলে কুরবানি করা যায়। ভাগে দিতে চাইলে অন্যান্যদের তাকওয়ার বিষয়টি খেয়াল করা দরকার।
১১.একটি গরু সর্বোচ্চ ৭ জন এবং এর কম হলে কোনো সমস্যা নেই। গোশত ভাগ অনুপাতে ওজন করে নিতে হবে। কুরবানির গোশতের একটি অংশ সর্বসম্মতভাবে কোনো মাদ্রাসা/ইয়াতিমখানার জন্য রেখে বাকি অংশ সমানভাগে ভাগ করলে সমস্যা নেই।
১২.কুরবানির কোনো কিছু থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়া যাবে না। প্রতিবেশি বা আত্মীয় হিসেবে অন্যান্যদের মতো হাদিয়া দেয়া যাবে।
১৩.কুরবানির গোশত কুরবানিদাতা নিজে খাবে, গরীবদের দিবে ও আত্মীয়-স্বজনকে হাদিয়া দিবে। সমাজে প্রচলিত নিয়ম, তিন ভাগ করে একভাগ কুরবানিদাতা, একভাগ আত্মীয়-স্বজন ও একভাগ ফকির-মিসকিনকে দেয়ায় অসুবিধা নেই।
১৪.কুরবানির গোশত জমা করে বা ফ্রিজে রেখে খাওয়ায় কোনো দোষ নেই। তাকওয়ার দাবী আল্লাহর অসহায় বান্দারা যেন উপকৃত হয়।
১৫.মান্নতের কুরবানির গোশত পুরোটাই সদকা করে দিতে হবে।
১৬.গরীব মানুষ কুরবানির নিয়ত করলে তা পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment