Skip to main content

দরসুল কুরআন

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম


হে ঈমানদারগণ! তোমাদের বাপ ও ভাইয়েরা যদি ঈমানের ওপর কুফরিকে প্রাধান্য দেয় তাহলে তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তারাই হবে জালেম।

হে নবি! বলে দাও, তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-
স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাকো এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ করো -- এসব আল্লাহ ও তাঁর রসুল এবং তাঁর পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফয়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো--আল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না'-- সুরা তওবা ২৩-২৪।

নামকরণ :

দুটি নাম- তওবা ও বারাআত।

তবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার অপরাধে কতিপয় সাহাবির তওবা এই সুরায় কবুল করা হয়েছে। তার থেকে এই সুরার নাম তওবা।

দ্বিতীয়ত, এই সুরার শুরুতে কাফের জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়ায় আর একটি নাম বারাআত।

নাজিলের সময়কাল :

এটিতে রয়েছে তিনটি ভাষণ। প্রথম থেকে পঞ্চম রুকুর শেষ অবধি নবম হিজরির জিলকদ মাস বা তার কাছাকাছি সময়ে অবতীর্ণ। রসুলুল্লাহ সা. আবু বকর রা.-কে সেবছর আমীরুল হজ করে পাঠান। তাঁর গমনের পর এই ভাষণটি অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে তিনি আলী রা.-কে পাঠান হজের সমাবেশে শোনানো ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।

দ্বিতীয় ভাষণটি ৬ষ্ঠ রুকু থেকে ৯ম রুকুর শেষ পর্যন্ত। ৯ম হিজরির রজব মাস বা তার কিছু আগে নাজিল হয়। সে সময়ে তবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল। জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য মুমিনদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং দুর্বল ঈমানদারদের কঠোর ভাষায় তিরস্কার করা হয়েছে।

তৃতীয় ভাষণটি ১০ম রুকু থেকে শেষ পর্যন্ত চলেছে। তবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর নাজিল হয়। তবুক যুদ্ধে যারা শরীক হয়নি তাদেরকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করা হয়েছে এবং কতিপয় ঈমানদারকে ক্ষমা করা হয়েছে।

বিসমিল্লাহ না লেখা :

এই সুরার শুরুতে বিসমিল্লাহ না লেখার বিষয়ে নানা মত থাকলেও গ্রহণযোগ্য মত হলো স্বয়ং রসুলল্লাহ সা. এই সুরার শুরুতে বিসমিল্লাহ না লেখায় পরবর্তীকালে আর কেউ লেখেননি।

ঐতিহাসিক পটভূমি ও বিষয়বস্তু :

হুদায়বিয়ার সন্ধির পর ইসলামের দ্রুত প্রসার ঘটে। যুদ্ধ বিগ্রহ নয় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দাওয়াতের জন্য খুবই অনুকূল। ইসলামের এই প্রসারের কারণে আরবের জাহেলি শক্তি আতঙ্কিত হয়ে নিজেরাই সন্ধি ভেঙ্গে ফেলে। কিন্তু রসুলুল্লাহ সা. তাদেরকে আক্রমণের সুযোগ না দিয়ে ৮ম হিজরিতে নিজেই মক্কা আক্রমণ করে বিজয় লাভ করেন। বলা যায় এর মধ্য দিয়ে আরবের জাহেলি শক্তির মৃত্যু ঘটে। এরপর হোনাইনের যুদ্ধে মরণকামড় দিয়ে কুফরি শক্তি ব্যর্থ হয়। সেসময়ে আরবের বাইরের শক্তির সাথেও ইসলামের সংঘর্ষ দেখা দেয়। রসুলল্লাহ সা. কয়েকজন সরকার প্রধানের কাছে দূত পাঠালে তাদেরকে হত্যা করা হয়।

রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন সিরিয়ার শাসক শুরাহবিল সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করলে রসুল সা. সেখানে তিন হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন। মূতা নামক স্থানে শুরাহবিলের এক লক্ষ সৈন্যের মোকাবিলায় পরপর দুজন সেনানায়কের শাহাদতের পর খালেদ বিন ওলিদের নেতৃত্বে মুসলমানরা বিজয় লাভ করেন। রোমান শাসক কায়সার প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করলে রসুল সা. ত্রিশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। সে সময়টা ছিল বড় নাজুক। তৎকালীন সুপার পাওয়ার রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সহজ ব্যাপার নয়। আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের কঠোর ভাষায় যুদ্ধের জন্য তাগিদ দিয়েছেন এবং সামান্য শৈথিল্য প্রদর্শনকে ঈমান থেকে বিচ্যুতি বলে উল্লেখ করেছেন। বলা হয়েছে ঈমান স্রেফ কিছু বিশ্বাসের নাম নয় বরং আল্লাহর সঙ্গে একটি চুক্তি। কেনাবেচার চুক্তিতে বলা হয়েছে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের জানমাল ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে মারে ও মরে।

এই সুরায় মুনাফিকদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি অবলম্বন করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। মিলেমিশে থাকার সুযোগ শেষ করে দেয়া হয়েছে। মুনাফিকরা মুসলমানদের যুদ্ধে যাওয়া থেকে নানাভাবে নিবৃত্ত করতো। তবুক যুদ্ধের প্রাক্কালে সুওয়ালিমের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয় যেখানে তারা সলাপরামর্শ করতো এবং তবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে মসজিদে দিরার জ্বালিয়ে দেয়া হয়। অবস্থার প্রেক্ষাপটে মুসলমানরাও উপলব্ধি করে যে ইসলামের বিজয় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হলে সাহস-হিম্মত প্রদর্শনের কোনো বিকল্প নেই।

আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যা :

ইসলাম বিশ্বভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী। সবাই আদমের সন্তান। সব ঠিক আছে। আবার পিতামাতার হক ও আত্মীয়- স্বজনের হক আদায় এবং সকল মানুষের সাথে সদাচরণে বিশ্বাসী। কিন্তু হক ও বাতিলের প্রশ্নে ইসলাম সর্বদা হকের পক্ষে। এখানে রক্তসম্পর্ক বা অন্য কোনো সম্পর্ক গুরুত্ব বহন করে না। পিতা ও ভাইকে উল্লেখ করে এখানে বলা হয়েছে তারা যদি ঈমান অপেক্ষা কুফরকে অধিক ভালোবাসে তাহলে তারা কেউ নন। এখানে ঈমানই মুখ্য। বদর ও উহুদ যুদ্ধে মুসলমানরা তার প্রমাণ দিয়েছেন। নির্বাচনের সময় পার্লামেন্ট নির্বাচনে পিতা, চাচা বা ভাই বাতিলের পক্ষে বিপরীতে আত্মীয়তার সম্পর্কহীন একজনকে সমর্থন দানের মধ্য দিয়ে বর্তমানে ঈমানদার জনগোষ্ঠীকে তারই প্রমাণ দিতে হয়। এখানে স্পষ্ট করা হয়েছে যে ঈমান অপেক্ষা কুফরকে কেউ ভালোবাসলে তাকে কোনো অবস্থাতেই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না, সে পিতা হোক বা ভাই হোক এবং যে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে সেই হবে জালেম।

২৪ নং আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে আল্লাহ, আল্লাহর রসুল ও আল্লাহর পথে জিহাদ অপেক্ষা কোনো কিছু মুসলমানদের কাছে প্রিয় হতে পারে না। মানুষের প্রিয় জিনিস এক এক করে উল্লেখ করা হয়েছে - পিতা, সন্তান, স্বামী/স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পদ, ব্যবসা, বাসস্থান কোনো কিছু যদি আল্লাহ, তাঁর রসুল ও জিহাদ অপেক্ষা প্রিয় হয় অর্থাৎ আল্লাহর পথে জিহাদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাহলে আল্লাহর ফয়সালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন। এ পর্যন্ত বলার পর আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি ফাসেকদেরকে হেদায়াত দান করেন না।

শিক্ষা :
সুরা তওবা এবং এই আয়াতদ্বয় স্পষ্ট করে যে একজন মুমিনের মৌলিক কাজ আল্লাহর এই জমিনে তাঁর দীন কায়েমের জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালানো। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর চেয়ে উত্তম কোনো আমল আর নেই এবং মুসলিম সমাজের সম্মান-মর্যাদা ও শৌর্যবীর্য সবই নির্ভর করে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর প্রতি কতখানি তারা আন্তরিক। জিহাদ সম্পর্কে উপলব্ধি দানের মাধ্যমে আল্লাহপাক আমাদেরকে যথার্থ মুমিন হওয়ার তৌফিক দান করুন।

Comments