রাতের সেরা রমজানের শেষ দশক এবং দিনের সেরা জিলহজ মাসের ১-৯ তারিখ
আজ ২০ মে ২০২২ সোবহানবাগ জামে মসজিদে মসজিদের সম্মানিত খতিব মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ আল্লাহপাকের হামদ এবং রসুলুল্লাহ সা.- এর উপর দরুদ পাঠ শেষে খুতবায় পুরো সময়টি নফল রোজা নিয়ে আলোচনা করেন।
খতিব মহোদয় বলেন, রমজানের ফরজ রোজা শেষে শাওয়াল মাসের ৬টি রোজা বেশ ফজিলতপূর্ণ। এ ছাড়া রসুলল্লাহ সা. বছরের অধিকাংশ সময় নফল রোজা রাখতেন। তন্মধ্যে কিছু কিছু রোজা সম্পর্কে নানা ফজিলতের কথা বলেছেন। প্রতি মাসে তিনটি রোজা আইয়ামে বীজ ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা তিনি ছাড়তেন না এবং সাহাবিদেরকে পালন করার জন্য বলেছেন।
রসুলুল্লাহ সা. সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন। তিনি বলতেন, সোমবার আমার জন্মদিন এবং আমি সোমবারে রোজা রাখা পছন্দ করি। আমাদের সমাজে বেলুন ফুটিয়ে ও মোমবাতি নিভিয়ে জন্মদিন পালনের নিন্দা করে তিনি বলেন, আমরা কতো নির্বোধ যে এর মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন প্রদীপই শেষ করে দিতে চাই। জন্মদিন পালন করতে চাইলে সেদিন রোজা রেখে আল্লাহর কাছে সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করার কথা বলেন। এছাড়া তিনি বলেন, সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমলনামা তার রবের কাছে পৌঁছে এবং আমি চাই আমার আমলনামা রোজা অবস্থায় আল্লাহর কাছে পৌঁছুক।
রমজানের ফরজ রোজা বাদে মাস হিসেবে তিনি রজব ও মুহররম মাসে অধিক রোজা পালন করতেন। রমজান মাসে যাতে রোজা রাখতে কষ্ট না হয় সেজন্য ১৫ তারিখের পর থেকে রোজা না রাখার জন্য তিনি তাঁর সাহাবিদের বলতেন। তিনি বলতেন, রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মুহররম মাসের রোজা এবং ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হলো তাহাজ্জুদের সালাত। আশুরার (দশ তারিখ) রোজা রাখার ব্যাপারে তিনি অনেক ফজিলতের কথা বলেছেন। একদিনের রোজা বিগত বছরের গুনাহের কাফ্ফারার কথা শুনিয়েছেন। এই দিনে হজরত মুসা আ. তাঁর অনুসারীসহ ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে সাগর পার হয়ে যান আর ফেরাউন সদলবলে লোহিত সাগরের সুয়েজ উপসাগরে ডুবে মরেছিল। মুসা আ. শুকরিয়াস্বরূপ আশুরার দিন রোজা রাখতেন এবং তাঁর অনুসারী ইহুদিরাও রোজা রাখতো। রসুল সা. বলতেন, মুসা আমার ভাই এবং তাঁকে অনুসরণ করার আমি বেশি হকদার। তিনি তাঁর সাহাবিদের রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অবশ্য তিনি বলেছেন, আগামী বছর বেঁচে থাকলে ইহুদিদের সাথে পার্থক্য করার জন্য আমি একদিন বৃদ্ধি করে রোজা রাখবো। অবশ্য রসুল সা. সে সুযোগ পাননি। আমাদের জন্য ৯ ও ১০ কিংবা ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রাখা উত্তম হবে।
খতিব মহোদয় সুরা ফজর উল্লেখ করে বলেন, জিলহজ মাসের প্রথম দশদিন অত্যন্ত ফজিলতের। রাত হিসেবে রমজানের শেষ দশক এবং দিন হিসেবে জিলহজের প্রথম দশক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রমজানের শেষ দশকে রয়েছে লাইলাতুল কদর এবং জিলহজের প্রথম দশকে রয়েছে ইয়াওমুল আরাফা। ৯ জিলহজে রোজা রাখা প্রসঙ্গে রসুলল্লাহ সা. বলেছেন বিগত ও আগামী দুই বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হলো এই আরাফার দিনে রোজা রাখা। পাঁচ দিন রোজা রাখা হারাম। ১ শাওয়াল এবং জিলহজ মাসের ৪ দিন ১০-১৩ তারিখ। জিলহজ মাসে আইয়ামে বীজ হিসেবে ১৩, ১৪ ও ১৫ রোজা না রেখে রাখতে হবে ১৪ ও ১৫ তারিখ।
হজরত মুসা আ.-এর শরীয়তে চুপ থাকার রোজা প্রচলন ছিল। সুরা মারয়ামে ২৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইসা আ.-এর জন্ম প্রসঙ্গে বলেছেন যখন মারয়াম আ.-এর প্রসব যাতনা শুরু হয় তখন তিনি লোকালয় থেকে এক খেজুর বাগানে চলে যান এবং সেখানে সন্তান প্রসব করেন। আল্লাহপাক তাঁকে খাদ্য ও পানির ব্যবস্থা করে দেন। আল্লাহর নির্দেশে কাণ্ড ধরে নাড়া দিলে তাজা খেজুর ও পায়ের আঘাতে জমিন ফুঁড়ে ঝর্ণা আকারে পানি বের হয়। তাঁকে বলা হয় খাও, পান করো ও চোখ জুড়াও। খেজুর আইরনসমৃদ্ধ এক পুষ্টিকর ফল এবং প্রসূতি মায়ের জন্য খুবই উপকারী।
জমিন ফুঁড়ে পানি বের হওয়ার ঘটনা তিনটি ক্ষেত্রে ঘটে। দুটি বন্ধ হয়ে গেছে এবং একটি প্রবাহমান (জমজম) রয়েছে। ইসমাইল আ. ও ইসা আ. ছাড়া আইয়ুব আ.-এর রোগমুক্তির ক্ষেত্রে তাঁকে জমিনে আঘাত করতে বলা হয় এবং সেই পানি দ্বারা গোসলের মাধ্যমে তিনি আরোগ্য লাভের পাশাপাশি আরো উজ্জ্বল ও সতেজ হন। গোসলের পানির সাথে মণি- মুক্তা ও স্বর্ণ ঝরতে থাকে এবং তিনি পূর্বের চেয়ে আরো ধনি হয়ে পড়েন।
কুমারী মাতা হিসেবে সন্তান প্রসবের ঐ সময়টা ছিল মারয়াম আ.-এর জন্য খুবই নাজুক। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে মৌনতা অবলম্বনের রোজা রাখার কথা বলা হয়। সন্তান কোলে নিয়ে তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট আসলে লোকজন নানা বিরূপ মন্তব্য করে। তখন তিনি তাঁর সন্তানের দিকে ইশারা করেন। সদ্যজাত শিশু বলে উঠে আমি আল্লাহর বান্দা, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন ও নবি করেছেন।
খতিব মহোদয় বলেন, কথা না বলে অনেক সময় চুপ থাকার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। সবকথা সবার পক্ষে বলা ঠিক নয়। সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের অনেক কথা ক্ষতির কারণ হয়ে পড়ে। বরং নিজেরা না বলে তাঁদের পক্ষে অন্যদের কথা বলা ভালো।
১২ রবিউল আউয়ালে অনেকে রোজা রাখেন। ঐদিন রোজা রাখার কোনো প্রমাণ নেই বরং রোজা রাখলে সেটি হবে বিদয়াত। কেবল শুক্রবার রোজাও ঠিক নয়। ঐদিন আমাদের ঈদের দিন। অবশ্য মিলায়ে রাখলে সমস্যা নেই। আবার সারা বছর রোজা রাখাও ঠিক নয়। বড় জোর দাউদ আ.-এর মতো রোজা রাখার কথা রসুলল্লাহ সা. বলেছেন। তিনি একদিন বাদে একদিন রোজা রাখতেন। রোজা সব নবিদের শরীয়তেই ছিল। রোজা আল্লাহর কাছে খুব পছন্দনীয় আমল। প্রত্যেক নেক আমলের সওয়াব আমলনামায় লেখা হয় দশ থেকে সাতশ গুণ বৃদ্ধি করে কিন্তু রোজা ব্যতিক্রম। এর পুরস্কার আল্লাহ নিজেই এবং রোজার বিনিময় রাইয়ান জান্নাত।
রোজা যা পারে অন্য কোনো ইবাদত দিয়ে তা সম্ভব নয়। রোজা মানুষের মাঝে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে। আল্লাহর ভয় মানুষকে সবধরনের পাপাচার থেকে দূরে রাখে। রোজাদারের রোজার খবর কেবল আল্লাহই জানেন। তাই আল্লাহ বলেন, রোজা আমার জন্য এবং আমিই তার পুরস্কার। খতিব মহোদয় তাঁর মুসল্লিদের ফরজ রোজার পাশাপাশি নফল রোজা রাখার জন্য আহবান জানান। সংক্ষেপিত।
শ্রুতিলিখন :
প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী।
Comments
Post a Comment