জুমা আলোচনা
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া যে তিনি দয়া করে আমাদেরকে তাঁর ঘরে হাজির হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। আলহামদু লিল্লাহ।
জুমার দিন আমাদের ঈদের দিন। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠতম দিন। গোসল করে উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে আজানের পরপরই আমাদের আল্লাহর ঘরে উপস্থিত হতে হবে। এদিনের প্রধান কাজ জুমার সালাত আদায়। তাই আমাদের সবারই প্রস্তুতি থাকা দরকার। প্রথম আগমন এবং প্রথম কাতারে বসার মধ্যে রয়েছে প্রভূত সওয়াব। রসুলুল্লাহ সা. মসজিদে আগমনের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে উট, গরু, ছাগল কুরবানির সুসংবাদ শুনিয়েছেন। আবার প্রথম কাতারে আসন গ্রহণের ফজিলত প্রসঙ্গে বলেছেন, মানুষ যদি বুঝতো প্রথম কাতারে বসায় কতো সওয়াব তাহলে লটারি করার প্রয়োজন হতো। আমি সুযোগ পেলেই আপনাদেরকে বলে থাকি। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায় না। সামনের কাতার ফাঁকা রেখে পেছনে বসলে মানুষকে ডিঙিয়ে যেতে হয় যেটা আদবের খেলাপ এবং নিষেধ রয়েছে।
জুমার দিনে খুতবা শ্রবণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খুতবা অত্যন্ত মনোযোগের সাথে শুনতে হয়। কেউ কথা বললে ভাই চুপ করো তাও বলা যায় না। ফেরেশতারা মুসল্লিদের আগমনের ভিত্তিতে সওয়াব লিখতে থাকেন। খতিব মহোদয় খুতবা দান শুরু করলে ফেরেশ্তারা লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে থাকেন। তাহলে আপনি জুমার নামাজের ফায়দা থেকে বঞ্চিত হলেন। ড. আব্দুল্লাহ বিন বাজ রহ.সহ ইসলামিক স্কোলাররা খুতবা দান মাতৃভাষায় প্রদানের পক্ষে জোরালো বক্তব্য প্রদান করেছেন।
আমরা আল্লাহর গোলাম এবং সেইসাথে তাঁর প্রতিনিধি। মানবতার কল্যাণ সাধনই মূলত আমাদের কাজ। আল্লাহর ভাষায়, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠতম উম্মত, তোমাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য’। মানুষ আমাদের থেকে কেবল ভালোটাই পাবে। মানুষের অমঙ্গল হবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা কখনই নয়। আপনি লক্ষ করুন, মানবকল্যাণে সাধিত সকল কাজই অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। মানুষকে সালাম দেয়া, হাসিমুখে কথা বলা, অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, বিপদাপদে সাহায্য করা, ভারি বোঝা বহনে সহায়তা করা, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেয়া; এককথায় মানুষের জন্য হিতকর সবই সওয়াবে ভরা। এমনকি রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেয়াতে রসুলুল্লাহ সা. জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়েছেন। আচরণ, কথাবার্তা ও লেনদেনে যে যতো সুন্দর সে ততো ভালো মুসলিম। চরিত্রবান ব্যক্তি মাত্রই মানুষের কল্যাণকামী এবং রসুলুল্লাহ সা. চরিত্রবান ব্যক্তিকে সর্বোত্তম ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মানুষকে শাস্তি দেয়ার জন্য আল্লাহপাক বাহানা তালাশ করবেন না বরং ক্ষমা করার জন্য নানা উপায় খুঁজবেন। ঈমানদার ব্যক্তির আমলনামায় নেকির পাল্লাকে ভারি করবে মুমিনের সদাচরণ।
মানুষের জন্য ক্ষতিকর সকল আচরণ ও কর্মকাণ্ড সবই কবিরা গুনাহ। মানুষকে গালি দেয়া, সম্মান হানি করা ভয়ঙ্কর অপরাধ। আল্লাহর ভাষায়, ‘নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনাসামনি গালাগাল করে ও পেছনে দোষ প্রচার করে’। এদের পরিণতি বলা হয়েছে যে তারা হুতামায় নিক্ষিপ্ত হবে। আর এর ভয়াবহতা বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, আল্লাহর আগুণ, প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত-উৎক্ষিপ্ত। একটু গালি দিলে বা অসাক্ষাতে নিন্দা করলে যদি এই শাস্তি হয় তাহলে যারা মানুষকে শারীরিক নির্যাতন করে বা গুম-খুনের সাথে জড়িত তাদের পরিণতি কী হতে পারে? আল্লাহর প্রতিনিধি মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার-অসদাচরণ সেটাতো আল্লাহরই সাথে করা। আবার লক্ষ করুন, মানুষের অকল্যাণ হয় এমন সকল কাজ একটি একটি করে গণনা করুন, দেখবেন সবই কবিরা গুনাহ। ওজনে কম দেয়া, মিথ্যা বলা, ধোঁকা-প্রতারণা করা সবই কঠিন অপরাধের কাজ। ওজনে কম দেয়ার অপরাধে হজরত শোয়াইব আ.-এর জাতিকে তো আল্লাহপাক সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। মিথ্যাবলা, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, আমানতে খেয়ানত করা কেবল কবিরা গুনাহ নয় রসুলুল্লাহ সা.-এর ঘোষণা মোতাবেক মুনাফিকের খাসলত। ওদের আর মুসলমান পরিচয় দেয়ার অধিকার নেই।
আমরা যাদেরকে কাফির-মুশরিক বলে গালি দেই ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ ইসলামকে ব্যবহারিক জীবনে মানে। তারা মিথ্যা বলে না, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না, আমানতদারিও তাদের মধ্যে রয়েছে। ওদের অফিস-আদালতে মানুষ সেবা পায়; ঘুষ সেখানে অকল্পনীয়। আমাদের অফিসসমূহে ঘুষ এখন সাধারণ ব্যাপার। অথচ আমরা জানি, ঘুষ দানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ই দোযখী। রসুলুল্লাহ সা. কাউকে জাহান্নামের সুসংবাদ (?) শুনালে আর এমন কে আছে যে তাকে জান্নাতে পৌঁছে দিবে? কারণ রসুলুল্লাহ সা. যা বলেন তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। আমাদের দেশে সব অফিস বা সব কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতিবাজ, এমনটি নয়। অনেক ভালো মানুষ রয়েছে যারা মানুষের সেবা করে তৃপ্ত হন। গতকাল কুষ্টিয়ায় সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেবের আন্তরিক সেবাদানে আমি তৃপ্ত, আল্লাহর কাছে তাঁর জন্য দোয়া করি। মানুষকে সেবা প্রদান সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সেরা ইবাদত, রুজি হালাল হওয়ার শর্ত। একজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামাজ পড়তে গিয়ে নফল ইবাদত-বন্দেগিতে অতিরিক্ত সময়দানে কোনো সওয়াব নেই বরং সরকারি কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাতে গুনাহ হবে। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আমরা কাউকে দায়িত্ব প্রদান করলে সে তার নিজের কাজ যতো নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করে আমাদের অর্পিত দায়িত্ব যদি সেভাবে পালন না করে তাহলে তাকে উল্টাভাবে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। যে কাজ দশ মিনিটে হওয়া সম্ভব তার জন্য আধা ঘন্টা লাগানো জুলুম। উদ্বুদ্ধকরণের (মটিভিশন) জন্য ব্যবহারিক জীবনে ইসলামকে মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। আজ যারা ব্যবহারিক জীবনে মানবিক ধর্ম (ইসলাম) অনুসরণ করছে আল্লাহপাক বিশ্বের নেতৃত্ব তাদের হাতেই প্রদান করেছেন। পৃথিবী পরিচালনায় এটিই আল্লাহর সুন্নাত (নিয়ম)। ঈমান না থাকার কারণে আখেরাতে প্রতিদান পাওয়া থেকে হয়তো তারা বঞ্চিত হবে।
অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সর্বত্র খেয়ানত। কেনাকাটায় ভয়াবহ দুর্নীতি, বড় বড় প্রকল্পে পুকুরচুরি নয় সাগরচুরি হয়। যার মধ্যে পরকালের ভয় রয়েছে সে কি কখনই দুর্নীতি করতে পারে? রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আমরা কাউকে দায়িত্ব প্রদান করলে সে যদি এক টুকরো সূতা বা তার চেয়ে কোনো ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে তাহলে কিয়ামতের দিন খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে। আজকের এই ভদ্র মানুষগুলো কতভাবেই না সেদিন হেনস্থা হবে।
আমানত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মুহাম্মদ সা. ছিলেন মানবজাতির জন্য মডেল। সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা, প্রতিশ্রুতি পালনে তিনি ছিলেন অনন্য। এসব মানবীয় গুণের কারণে তিনি ছিলেন জাতির আস্থাভাজন। তিনি সমাজবিমুখ ছিলেন না। সমাজের সমস্যা সমাধানে তিনি কিশোর বয়সেই সমবয়সীদের নিয়ে গড়ে তুলেন হিলফুল ফুজুল। লক্ষ্য একটিই- মানুষের কল্যাণ সাধন। সমাজকর্মী ছিলেন বলেই মানুষ তাঁকে নেতা মেনে বিবাদ-বিসংবাদ ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতাকারী মানতেন। আমরা কালো পাথর স্থাপন ব্যাপারে সমস্যা সমাধানে তাঁর ভূমিকা সবাই জানি। কাবা ঘর মেরামতের সময় আরবের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে চরম বিবাদ মুহূর্তে মুহাম্মদ সা.-এর আগমন দেখে সবাই বলে উঠে- ঐ যে আমাদের আল আমিন আসছেন, তাঁর ফয়সালা আমরা সবাই মেনে নেব। তিনি চাদর বিছায়ে তার উপর পাথরটি রেখে গোত্রপতিদের চাদরের বিভিন্ন কোণ ধরতে বলেন এবং সেখানে পৌঁছানোর পর নিজ হাতে তা যথাস্থানে রাখেন। এভাবে তিনি সুন্দর সমাধান প্রদান করেন।
সমাজের মানুষের কল্যাণ ব্যাহত হয়, তা যেভাবেই হোক সেটি কবিরা গুনাহ। আল্লাহর সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত তা তওবার মাধ্যমে মাফ হয়। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র ও ক্ষমাশীল। কিন্তু তাঁর বান্দাদের প্রতি জুলুম তিনি ক্ষমা করেন না যদি মজলুম ক্ষমা না করে। এটি ইনসাফেরই দাবি। আমরা নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা পাঠ্য বইয়ে ইসমাইল হোসেন সিরাজীর লেখা পড়েছিলাম- অতি নামাজী-কালামী, হাজি-দরবেশ পাপী-গুনাহগার হতে পারেন যদি তিনি করে থাকেন সামাজিক জীবনের দুশমনি। তিনি আরো লিখেছিলেন- যে লোক হাওয়ায় জাহাজে করে বছর বছর হজ করে আসেন সে যদি তার কারখানার শ্রমিকের ন্যায্য পারিশ্রমিক না দেয় এবং তার মৃত্যুর পর কবরে সোনার চাবি রেখে দিয়ে আসলে সেই চাবি দিয়ে বেহেশতের কোনো দরজাই খুলতে পারবে না। কতো স্বচ্ছ তাঁর উপলব্ধি ও উপস্থাপনা।
সম্মানিত মুসল্লিবৃন্দ! আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করবো মানুষের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যান এবং সর্বদা চেষ্টা করুন মানুষের কল্যাণ সাধনের। উপকার করতে যদি নাই পারেন তবে আপনার দ্বারা যেন কোনো মানুষ কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেব্যাপারে সতর্ক থাকুন। মানুষের প্রতি জুলুম বড় ভয়াবহ অপরাধ। এর কোনো ক্ষমা নেই। আল্লাহর কাছে তওবা এবং মজলুমের পক্ষ থেকে মাফ না পর্যন্ত। জালেমের জন্য আল্লাহর জান্নাতে কোনো স্থান নেই। সাধারণত ধনী এবং প্রভাবশালী লোকেরাই মানুষের প্রতি জুলুম করে থাকে। অর্থবৃত্ত এবং নেতৃত্ব আল্লাহপাকের একান্ত অনুগ্রহ। এগুলো পেয়ে মানুষ হবে বিনয়ী এবং তাঁর বান্দাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবে। দুর্ভাগ্য, আল্লাহর দেয়া এসব অনুগ্রহকে মানুষের প্রতি জুলুম-নির্যাতনে ব্যবহার করে। এরা আসলেই হতভাগা।
আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা. সদাচরণ ও দানের কথা বারবার বলেছেন এবং অন্যথা হলে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। রসুল সা. বলেছেন, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়। যে মুমিন নয়, তার নামাজ-রোজার প্রয়োজন কী? নামাজের জন্য নামাজ নয় আবার রোজার জন্যও রোজা নয়। এর পেছনে রয়েছে আল্লাহপাকের এক উদ্দেশ্য। নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ আল্লাহর স্মরণ- নামাজ যদি মানুষকে অন্যায় থেকে দূরে না রাখতে পারে তাহলে এমন নামাজ পণ্ড শ্রম নয় কী? আল্লাহর রসুল সা. বলেছেন, যে নামাজ মানুষকে অন্যায় থেকে দূরে রাখতে না পারে সে নামাজ আল্লাহ ও মানুষের মাঝে ব্যবধান বাড়িয়ে দেয়। রোজার ব্যাপারটাও তাই। তাই আসুন, আমরা সৎকর্মশীল হই, মানুষের জন্য কল্যাণকামী হই। কল্যাণ কামনার নামই দ্বীন। আমাদের দ্বারা আল্লাহর সকল সৃষ্টি নিরাপদ হোক। আল্লাহপাক আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ দান করুন। আমিন।
০৬.০৫.২০২২ কুচিয়ামোড়া বাজার জামে মসজিদে প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালীর জুমা আলোচনা।
Comments
Post a Comment