বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
‘হে চাদর মুড়ি দিয়ে শয়নকারী। ওঠো এবং সতর্ক করো, তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো’- সূরা মুদ্দাস্সির ১-৩
চলছে লকডাউন। শুরু হয়েছে ২৬ মার্চ থেকে। দীর্ঘ সময় মসজিদে না গিয়ে নিজের ঘরকেই মসজিদ বানিয়ে নিয়েছি। পুরো সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করেছি (এক ওয়াক্ত মাত্র দু’জন মিলে আদায় হয়েছে)। আলহামদু লিল্লাহ। প্রতিদিন ফজর বাদে হাদিস পাঠ করা হয় ও সূরা মশক হয়। মশক পরিচালনা করেন আমার স্ত্রী (তা’লীমে কুরআন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত)। আজকে আমাদের পারিবারিক বৈঠকে সূরা মুদ্দাস্সির ১-৩ নিয়ে আলোচনা হয়। আমি আমার বন্ধুদের সাথে একটু শেয়ার করতে চাই।
সূরার প্রথম বাক্যের মুদ্দাস্সির শব্দকে নাম হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। মক্কী সূরা এবং প্রথম দিকে অবতীর্ণ। সর্বসম্মত মত হলো, সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিলের মাধ্যমে ওহী অবতরণ শুরু হয়। এরপর দীর্ঘদিন ওহী নাযিল বন্ধ থাকে। তাতে মুহাম্মদ (সা) বেশ হতাশ হয়ে পড়েন। তাঁর ভাবনা, হয়তো কোনো ভুল-ত্রুটি হয়ে গেছে। আসলে ওহী অবতীর্ণ হওয়ার ধকল সামলানোর জন্যই ছিল এই বিরতি। এমনি অবস্থায় রাস্তায় চলতে গিয়ে একদিন তিনি আকাশে জিবরাইল (আ)-কে দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ঘরে ফিরে তাঁকে কম্বল আবৃত করে দিতে বলেন। এ অবস্থায় আল্লাহপাক সূরা মুদ্দাস্সিরের প্রথম সাতটি আয়াত নাযিল করেন।
হে মুহাম্মদ (সা) বা হে রসুল (সা) বলে সম্বোধন না করে আদর করে ‘হে কম্বল আবৃতকারী’ বলে ডাক দিয়েছেন। আরাম করে শুয়ে থাকার দিন আর তাঁর নেই। গাফিলতিতে নিমজ্জিত আল্লাহর বান্দাদেরকে সতর্ক করার এক গুরু দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছে। যে সমাজে তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছে সে সমাজের মানুষ আখিরাতকে ভুলে গিয়ে চরম গোমরাহির মধ্যে নিমজ্জিত। জাহান্নামের আগুনে ভস্ম হওয়ার উপযুক্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহপাক তাঁর রসুলকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। মূলত এই ক’টি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে মুহাম্মদ (সা)-এর রিসালাতের দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়।
এ কথা স্পষ্ট যে, রসুল হিসেবে মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর যে দায়িত্ব তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারী অনুসারীদের দায়িত্বও তাই। সাহাবায়ে কেরামের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমার যে কাজ তোমাদেরও তাই’। স্বল্পসংখ্যক ঈমানদারের বিপরিতে অগণিত মানুষ আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত এবং তাঁর বান্দাদের প্রতি সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন ও অবৈধ পন্থায় অপরের সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। এ সবের মূলে রয়েছে আখিরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতির অনুপস্থিতি। আল্লাহর রসুল (সা)-এর চতুষ্পার্শের লোকদের মধ্যে যেমন ছিল, আজও তেমন রয়েছে। এই শ্রেণির মানুষকে সতর্ক করার জন্য নিজের আরাম-আয়েশ পরিহার করে আল্লাহপাক তাঁর প্রিয়তম নবী (সা)-কে ওঠে দাঁড়াবার নির্দেশ প্রদান করেছেন।
নবীর দাওয়াতের মূল কথা হলো আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করা। মানুষ যদি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও মহানত্ব উপলব্ধি করতে পারতো তাহলে স্রষ্টার নাফরমানি করা বান্দাহ হিসেবে তার পক্ষে সম্ভব হত না। শিরকের মূল বিষয় হলো আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের সাথে কাউকে শরীক করা। তৎকালে মানুষ আল্লাহকে মানলেও নানাভাবে তাঁর সাথে শির্ক করতো। বিভিন্ন দেব-দেবির পাশাপাশি সমাজপতিদের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল। নবুয়তের দায়িত্বের সূচনায় আল্লাহপাক তাঁর নবীকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা দানের নির্দেশ প্রদান করেছেন।
আমাদের আযানের শুরুতে আল্লাহ আকবার, নামাযের শুরুতে আল্লাহু আকবার ও পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাযের মাঝে প্রতিদিন ৯৪ বার আল্লাহু আকবার উচ্চারিত হয় এবং পশু জবেহ করা হয় আল্লাহু আকবার বলে। মানুষের মন-মস্তিষ্কে যাতে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্ব (আল্লাহু আকবার) গেঁথে যায় সেজন্যই এমন ব্যবস্থা। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মূলত আল্লাহু আকবারেরই ভাব প্রকাশ করে। আরবের কাফির-মুশরিকরা প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)-এর মুখ থেকে আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা শুনতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। এটি ছিল রসুল (সা)-এর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রকাশ্যে দাওয়াত দানের সাথে সাথে মুহাম্মদ (সা)-এর বিরুদ্ধে মক্কার কাফিররা প্রচন্ডভাবে বিরোধীতা শুরু করে। না, এই বিরোধীতার পেছনে মুহাম্মদ (সা)-এর বিরুদ্ধে কোনো অপবাদ ছিল না, তাঁর চরিত্রে কোনো কালিমা ছিল না বরং তাঁর স্বজাতির লোকেরা তাঁকে বড় আদর করে ডাকতো আল-আমিন ও আস-সাদিক বলে।
মুহাম্মদ (সা)-এর মত সকল নবী-রসুলের চরিত্র ছিল নিষ্কলুষ ও পবিত্র। সকল প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে তাঁরা ছিলেন মুক্ত। সবাই কেবল আল্লাহরই শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছেন এবং বিরোধীতার ক্ষেত্রও এই একটি। নমরুদ, ফিরাউন, শাদ্দাদ, আবু জেহেলরা নিজেরা শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার ছিল; পক্ষান্তরে নবী-রসুলগণ তাদের মোকাবেলায় আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিয়েছেন। আজও একই চিত্র। দেশে দেশে স্বৈরশাসকরা নিজেদেরকে বড় মনে করে এবং ইসলামকে প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে তার ওপর হামলে পড়ে। চতুর্মুখে কেবল নিজেদের প্রশংসা শুনতে চায় এবং এর বাইরে সবাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। অথচ আল্লাহর দাবী, তিনি সবার বড় (আল্লাহু আকবার) এবং প্রশংসা কেবল তাঁরই (আলহামদু লিল্লাহ)।
কুরআন মজিদ খুললে যে শব্দটির সাথে আমাদের প্রথম পরিচয় হয় তা হলো ‘আলহামদু লিল্লাহ’। প্রশংসা আল্লাহর এতটুকু নয় বরং সকল প্রশংসা আল্লাহর। এই শব্দটি উচ্চারণের মাধ্যমে ব্যক্তিপূজা ও সৃষ্টিপূজার মূলোৎপাটন করে দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি ও সৃষ্টির মাঝে মহৎ ও কল্যাণকর যা কিছু তা সবই আল্লাহর দান। তাই প্রশংসা ব্যক্তি বা সৃষ্টির নয় যিনি দাতা সেই মহান আল্লাহর। আমরা বলেও থাকি, কেউ ভালো রেজাল্ট করলে বলি আলহামদু লিল্লাহ, নির্বাচনে বিজয়ী হলে বলি আলহামদু লিল্লাহ। মহৎ কিছু সম্পন্ন করার পর ব্যক্তিকে স্বীকৃতি প্রদান করলে তিনিও বলে উঠেন, ভাই দুআ করেন যাতে আল্লাহ আপনাদের খেদমত করার তাওফিক দান করেন। বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য হলো, অবিশ্বাসী তার সকল অর্জনের পেছনে নিজের বা দলের কৃতিত্ব (ক্রেডিট) দাবী করে পক্ষান্তরে বিশ্বাসীরা কৃতিত্ব আল্লাহকে সমর্পণ করে বিনয়ী হয়।
আল্লাহপাক তাঁর নবীকে দিয়ে শিখিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে যখন পূর্ণতা আসে তখন আল্লাহপাক বলেন, যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসে (সূরা নসর), এ বিজয়ের পেছনে রসুল (সা)-এর কোনো ক্রেডিট নেই, এ বিজয় একান্ত আল্লাহপাকের অনুগ্রহের ফল। কোনো বিজয়োল্লাস নয়, বলা হলো আল্লাহর প্রশংসা করতে ও তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে। মুসলমানরা কখনই জয় মুহাম্মদ বা মুহাম্মদ জিন্দাবাদ শ্লোগান প্রদান করেনি, তাদের শ্লোগান একটিই ‘আল্লাহু আকবার’। তাঁদের পরিচয় আব্দুহু ও রসুলুহু অর্থাৎ আল্লাহর গোলাম ও রসুল। সকল নবী-রসুলের সাহসী উচ্চারণ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বা ‘আল্লাহু আকবার’ ছিল সমাজ বদলের শ্লোগান। ফলে সকল স্বৈরশাসক ও তাদের অনুগতরা একযোগে আক্রমণ করে বসেছে। আর তাদের বিরোধীতার মোকাবেলায় নবী-রসুলরাও ছিলেন বেপরোয়া (ভয় করতেন না) কারণ তাঁরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। মানুষ নিজেরা নিজেদেরকে বড় মনে করে বা সমাজের মানুষ যাদেরকে বড় মনে করে তারা আসলে আল্লাহর মোকাবেলায় অতি তুচ্ছ ও নগন্য। তারা কেউ স্থায়ী নয় বা তাদের ক্ষমতাও স্থায়ী নয়। আল্লাহর সৃষ্ট অতি ক্ষুদ্র এক জীবাণু করোনার কাছে বিশ্বের শক্তিমানরা আজ চরম অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে।
হক ও বাতিলের এ দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম চিরন্তন। পৃথিবীর ইতিহাসই হলো হক ও বাতিলের লড়াই। আল্লাহর স্পষ্ট ঘোষণা, ‘যারা ঈমানদার তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে আর যারা কাফির তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। তোমরা শয়তানের সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে লড়াই করো, বিশ্বাস করো শযতানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’-সূরা নিসা ৭৬। মাঝামাঝি পথ বলে কিছু নেই। যারা নিরাপদ অবস্থানে থাকতে চায় তারা আসলে বর্ণচোরা, সুযোগ-সন্ধানী ও ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ জীবন যাপন করতে চায়। আল্লাহর কাছে আমাকে-আপনাকে স্পষ্ট করতে হবে, আমরা ইসলামের পক্ষের না বিপক্ষের শক্তি। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণে পুরোদস্তুর মুসলমান হলেও এই হতভাগা ইসলামের পক্ষে ছিল না, সে ইসলামের বিজয় কামনা করতো না। ফলে সে মুনাফিক সরদার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। প্রকৃত হকপন্থী চেনার মাপকাঠি হলো এই দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম। বাতিল অতীতকালে যেমন ছিল এখনো আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। এই দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে যারা বাতিলের বিরোধীতার মুখোমুখি হচ্ছে এবং নিপীড়ন-নির্যাতনে জর্জরিত হচ্ছে তারাই হকপন্থী এবং তাদের জন্যই রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ ‘ক্ষমা ও জান্নাত’। ১৭.০৬.২০২০
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment