মানুষ আল্লাহর গোলাম এবং চেতনা লাভের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর হুকুম মেনে চলা বান্দাহ হিসেবে মানুষের দায়িত্ব। এর ব্যতিক্রম ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় মানুষ আল্লাহর সার্বক্ষণিক গোলাম। দ্বীনদারী বা দুনিয়ারী বলে আলাদা কিছু নেই। সবই দ্বীনদারী যদি সেখানে আল্লাহর নাফরমানি না থাকে এবং কাজের পেছনে থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আবার নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাতও হতে পারে স্রেফ দুনিয়ারী যদি এর পশ্চাতে থাকে মানুষকে দেখানো এবং নির্বাচনে ভালো করা বা দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ হাসিল। ইসলামের দৃষ্টিতে আমলের ভালো-মন্দ নির্ভর করে নিয়তের ওপর।
ইসলাম মানবজীবনে সর্বত্র শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা চায়। শৃঙ্খলা তখনই কায়েম থাকে যখন কর্তৃত্বশীল ও অধীনস্থের মধ্যে আনুগত্য বজায় থাকে। নিরঙ্কুশ ও শর্তহীন আনুগত্য আল্লাহর এবং আল্লাহর আনুগত্য হতে হবে তাঁরই প্রেরিত রসুল (সা)-এর আনুগত্যের মাধ্যমে। আল্লাহ ও রসুল (সা)-এর আনুগত্য শর্তহীন এবং কেউ নিজেকে মুসলিম পরিচয় দিতে চাইলে তাঁদের আনুগত্যের ক্ষেত্রে অন্যথা করার কোনো উপায় নেই। এর বাইরে সকল আনুগত্য শর্তাধীন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাকের বাণী, ‘হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রসুলের, আর সেই সব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী। এরপর যদি তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যাপারে মতপার্থক্য দেখা দেয় তাহলে একে আল্লাহ ও রসুলের দিকে ফিরিয়ে দাও-যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান এনে থাকো। এটিই সঠিক কর্মপদ্ধতি এবং পরিণতির দিক দিয়ে এটিই উৎকৃষ্ট’- সূরা আন নিসা ৫৯।
ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম। বিশ্বপ্রকৃতিতে রয়েছে শৃঙ্খলা ও আনুগত্য। ফলে কোথাও কোনো সংঘর্ষ বা বিরোধ নেই। আল্লাহ চান মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর বিধান অনুসরণ করে মানুষ সুখি ও সুন্দর জীবন-যাপন করুক। পরিবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান (আর্থিক-সামাজিক-রাজনীতিক সব ধরনের), অফিস-আদালত, পার্লামেন্ট বা রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠান সকল ক্ষেত্রে রয়েছে কর্তৃত্বশীল ও অধীনস্থের বিষয়। এখানে আল্লাহপাকের স্পষ্ট নির্দেশ, যারা কর্তৃত্বশীল বা দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী তাদের আনুগত্য করতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা)-এর আনুগত্যের মতই কর্তৃত্বশীলের আনুগত্য অবশ্যম্ভাবী (ফরজ) তবে সেটি শর্তাধীন। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা)-এর নিয়মের সাথে কর্তৃত্বশীলের আনুগত্য যদি সাংঘর্ষিক হয় তবে আল্লাহ ও রসুল (সা)-এর দিকে ফিরে যেতে হবে। হাদিসে এভাবে এসেছে, স্রষ্টার নাফরমানি করে সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই’।
মানবসমাজের একটি ক্ষুদ্র ইউনিট হলো পরিবার। পুরুষকে পরিবারের কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছে। এখানে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির জন্য পরিবার প্রধানের আনুগত্য ফরজ করা হয়েছে। পরিবারে শৃঙ্খলা বিধানের জন্য এটি অপরিহার্য। পরিবার প্রধানের আনুগত্যের বাইরে যে জীবন সেটি জাহেলিয়াতের জীবন। অবশ্য একটি বিষয় এখানে বিবেচনা যোগ্য, তা হলো পরিবার প্রধান স্বৈরাচার বা ডিক্টেটর হবে না। আল্লাহপাক তাঁর অনুগত বান্দাদের পরিচয় প্রদান করেছেন এভাবে- ‘তারা তাদের সামগ্রিক ব্যাপারসমূহ পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে’-সূরা আশ শূরা ৩৮। পরামর্শ করো বিষয়টি এমন নয়, বরং তাদের প্রকৃতিই এমন, যেখানে একাধিক ব্যক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেখানে সে এককভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে সবার সাথে পরামর্শ করে কার্যসম্পাদন করে। অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করবে এবং পরিবারে ছেলে-মেয়ে বড় হলে বা পরিবারে পিতা-মাতা বা আর কেউ থাকলে পরামর্শে তাদেরকেও শরীক করাবে। একক চিন্তা চাপিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
পরিবার থেকে শুরু করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি একই। সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা যা কিছুই বলি না কেন সকল ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী যারা তাদের আনুগত্য করতে হবে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হওয়া ইসলামের বিধান এবং জনগণ আস্থা প্রত্যাহার করে নিলে সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার আর কোনো অধিকার নেই; যেটি আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে লক্ষ্য করি। জনগণ দ্বারা নির্বাচিত বা রাজতান্ত্রিক বা ডিক্টেটরশীপ বা সামরিক সরকার যেভাবেই ক্ষমতাসীন হোক না কেন নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় পরিবর্তন ছাড়া সেই সরকারের আনুগত্য তার নাগরিকদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। আনুগত্যহীনতা অর্থই ফাসাদ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি-যা কোনোভাবেই ইসলাম অনুমোদন করে না। এখানে শর্ত একটিই যদি সরকার সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর নাফরমানিমূলক কোনো নির্দেশ প্রদান করে তাহলে সেটি না মেনে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা)-এর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে রাষ্ট্রকে কর প্রদান বা ট্রাফিক আইন বা সম্প্রতি করোনা সম্পর্কিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে সব নির্দেশাবলী বা আইন-কানুন জারি করে বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জারিকৃত সকল আইন (যদি আল্লাহর নাফরমানিমূলক না হয়) স্বতস্ফুর্তভাবে মেনে চলা নাগরিকদের জন্য অবশ্য পালনীয় (ফরজ) যেমন ফরজ নামায রোযা ও অন্যান্য ইবাদত অনুষ্ঠান পালন। রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান পালন আল্লাহর ইবাদতেরই অংশ। কারণ কর্তৃত্বশীলের আনুগত্য আল্লাহরই নির্দেশ। প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকার যদি জনগণের আস্থাভাজন না হন বা জোরপূর্বক ক্ষমতাসীন হন। হ্যাঁ, তাহলেও আনুগত্য করতে হবে। আনুগত্য না করে যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি ও শান্তি-শৃঙ্খলা ব্যাহত করা বা রাষ্ট্রের স্থিতি বিনষ্ট করা ইসলাম অনুমোদন করে না। এ জন্য সরকার পরিবর্তন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
সমাজে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ইসলামের মৌলিক কাজ। ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ) রাজতান্ত্রিক পন্থায় জনগণের শাসক হলেও সুশাসন ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার কারণে অনেকেই তাঁকে ইসলামের পঞ্চম খলিফা বলেন। আল্লাহর রসুল (সা)-এর অত্যন্ত মর্যাদাবান সাহাবী (কাতেবে ওহী) হওয়া সত্ত্বেও হযরত মুয়াবিয়া (রা) নানা কারণে খলিফা হিসেবে পরিচিতি না পেয়ে আমীর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। ইয়াজিদ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলে শাসককে যাকাত প্রদান ও তার আনুগত্যের ব্যাপারে প্রশ্ন উঠলে সে সময়ে উম্মাহ ঐকমত্যে পৌঁছে যে, ইয়াজিদকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। এসব দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, সরকার যেভাবেই অধিষ্ঠিত হোক না কেন মুসলিম উম্মাহর শান্তি-শৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার স্বার্থে সরকারের আনুগত্য অপরিহার্য।
ইসলাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদে বিশ্বাসী। আল্লাহপাকের আদালতে প্রত্যেককে আলাদাভাবে দাঁড়াতে হবে। অধিকার হরণ- সেটি আল্লাহর হোক বা বান্দার হোক, তা কবীরা গুনাহ। স্বাধীনভাবে সরকার গঠন বা নেতা নির্বাচন জনগণের একটি অধিকার। এ অধিকার হরণ বড় ধরনের জুলুম। এটি আমি এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি, তাহাজ্জুদ নামায ও নফল রোযা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ, তা আদায়কারীকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে তুলে। সারাজীবন তাহাজ্জুদ নামায আদায় ও নফল রোযা পালনকারীর ছওয়াব যদি আমরা একটি পাল্লায় ওজন করি তাহলে হয়তো ওজন হবে ১০০ গ্রাম; বিপরিতপক্ষে একটি দিন যদি কেউ জনগণের ওপর অবৈধভাবে ক্ষমতাসীন হয়ে থাকে তাহলে বদির পাল্লায় জনগণের অধিকার হরণজনিত গুনাহের ওজন হবে এক টন। (এটি কোনো ফতওয়া নয়, কুরআন-হাদিস পড়ার প্রেক্ষিতে আমার উপলব্ধি, সব ধরনের জুলুমকে আমি এমনটিই মনে করি)। এ অপরাধ থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো তাওবা করে জনগণের অধিকার তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া।
আমাদের দেশে আশংকাজনকভাবে করোনার বিস্তৃতি ঘটছে। বিস্তৃতি রোধকল্পে সরকারের পক্ষ থেকে নানাবিধ কর্মসূচি গৃহিত হচ্ছে। স্বতস্ফুর্তভাবে এ সব নিয়ম-কানুন মেনে চলা নাগরিকদের জন্য অত্যাবশ্যক (ফরজ)। ঘরে অবস্থান করা, নিতান্ত প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হলে মাস্ক ব্যবহার ও তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলার মধ্যে রয়েছে ছওয়াব এবং না মানার মধ্যে রয়েছে গুনাহ। যদি কেউ প্রশ্ন করেন গুনাহের মাত্রা কতখানি অর্থাৎ ছগিরা না কবীরা? আমি বলবো, একজন পর্দাহীন নারীকে দীর্ঘ দৃষ্টিতে অবলোকন করা যে মানের গুনাহ, ঠিক মাস্ক ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া বা অপ্রয়োজনে ঘুরাঘুরি করা তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে নিজের, পরিবারের ও সমাজের ক্ষতি। আর ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর সকল ধরনের কর্মকান্ড ইসলামে হারাম। কোনো ব্যক্তির তার নিজের ক্ষতি করারও অধিকার নেই। এজন্য ইসলাম সকল নেশার দ্রব্য হারাম করেছে। আর আত্মহত্যা ইসলামে জঘন্য অপরাধ, পরিণতি বিনা হিসাবে জাহান্নাম।
মোটামুটি আমি আমার আলোচনায় স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি যে, সরাসরি আল্লাহর বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে সরকারের পক্ষ থেকে জারিকৃত সকল বিধি-বিধান মেনে চলা তার নাগরিকদের জন্য অত্যাবশ্যক। আল্লাহপাক আমাদেরকে সকল কর্মকান্ডে তাঁকে ভয় করে চলার তাওফিক দান করুন। ০৯.০৬.২০২০
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment