Skip to main content

মু’মিন জীবনের লক্ষ্য

একজন ব্যক্তি প্রকাশ্যে কালিমা তাইয়্যেবার ঘোষণা দিয়ে বিশ্বাসীদের দলভুক্ত হন। আবার মুসলিম পিতা-মাতার ঘরে জন্মগ্রহণকারী যে কেউ প্রকাশ্যে অস্বীকৃতি না জানালে সেও বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত। সমাজ তার সাথে একজন মু’মিন হিসেবেই আচরণ করে। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে কতকগুলো মৌলিক বিষয়ে (আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, রসূল, পরকাল ও তকদির) বিশ্বাস স্থাপন করাকেই ঈমান বলে এবং যারা বিশ্বাস করে তারাই মু’মিন। মানুষের জীবনের দু’টি দিক। এক. দুনিয়ার জীবন, দুই. পরকালের জীবন। মু’মিনের জন্য দু’টি জীবনই গুরুত্বপূর্ণ, যদিও দুনিয়ার জীবনটা আখিরাতের তুলনায় খুবই ক্ষণস্থায়ী। পক্ষান্তরে আখিরাতের জীবনটা স্থায়ী এবং সেখানে লাভ করবে, হয় অসংখ্য নেয়ামতেভরা জান্নাত, নয়তো সীমাহীন দুঃখ-কষ্টেভরা জাহান্নাম। আল্লাহপাক নিজেই তাঁর কাছে চাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর বান্দাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দাও’। যদিও মু’মিন দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ কামনা করে কিন্তু অস্থায়ী দুনিয়ার তুলনায় স্থায়ী আখিরাতই তার জীবনের মূল লক্ষ্য। আর বুদ্ধিমান মাত্র সেটিই চাইবে। নবুয়ত লাভের পর রসূল (সা)-এর দাওয়াতের মূল বিষয় ছিল কালিমা তাইয়্যেবা (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ) অর্থাৎ তাওহিদ ও রেসালাতকে (আল্লাহকে ইলাহ এবং মুহাম্মদ (সা)-কে রসূল হিসেবে) মেনে নেয়ার আহবান। সাথে সাথে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আখিরাত। শুরুতে মুহাম্মদ (সা) মানুষের কাছে কালিমা তাইয়্যেবারই দাওয়াত প্রদান করেছেন এবং এই দাওয়াত কবুল করলে দুনিয়ার জীবনে শান্তির পাশাপাশি আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের সুসংবাদ তিনি শুনিয়াছেন, অন্যথায় কঠিন আযাবের কথা বলেছেন। আল্লাহপাক ছোট্ট ছোট্ট সূরায় আখিরাতের একটি চিত্র সে সময়ে তুলে ধরেছেন। আখিরাতের সাফল্য দু’টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এক. ঈমান, দুই. নেক আমল। ঈমান ও নেক আমলের সম্পর্ক বীজ ও বৃক্ষের মতো। মাটিতে বীজ বপন করা হলে সেখান থেকে অঙ্কুরোদ্গম হয়। বীজ থেকে চারা না গজালে বুঝতে হবে বীজটি পরিপক্ক নয় বা নষ্ট হয়ে গেছে বা শক্ত কোনো কিছুতে চাপা পড়ে আছে। তাই কারো মধ্যে ঈমান থাকলে তার প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির আচার-আচরণ, লেন-দেন ও সামগ্রিক চরিত্রে। নামায ফরজ হয়েছে নবুয়তের দ্বাদশ বর্ষে (মি’রাজ থেকে ফিরে রসুল (সা) নামাযের ঘোষণা প্রদান করেন) এবং রোযা হিজরতের পরে মদীনায়। অবশ্য নফল নামায ও রোযা সব সময়ই ছিল। কাবা চত্তরে নামায আদায়ের সময়ে রসূল (সা)-এর ঘাড়ে উটের নাড়ি-ভূঁড়ি চাপিয়ে দেয়া এবং আশুরার রোযা রাখার কথা আমরা জানি। এই সময়ে আল্লাহপাক আখিরাতে জবাবদিহির কথা উল্লেখ করে মু’মিনদের নৈতিক চরিত্র উন্নয়নের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। রসূল (সা) বলেন, আমাকে নৈতিক চরিত্রের পরিশুদ্ধির লক্ষ্যেই প্রেরণ করা হয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ ছোট্ট ছোট্ট সূরাগুলো যদি আমরা একটু খেয়াল করি তাহলে দেখবো নানাভঙ্গিতে আখিরাতের যৌক্তিকতা এবং পুরস্কার ও শাস্তির কথা সেখানে বলা হয়েছে। তৎকালে মানুষের মাঝে যে সব নৈতিক ত্রুটি ছিল সেগুলো উল্লেখ করে মু’মিনদেরকে সে সব ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। শক্তিমানদের অত্যাচার-নির্যাতনে মানুষ ছিল বড় অসহায়; তারা মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অপমান করতো। যেমন, মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল করা ও পেছনে দোষ প্রচার করা এবং কার্পণ্য করাকে সূরা হুমাযায় জঘন্য অপরাধ উল্লেখ করে পরিণতি হিসেবে হুতামায় নিক্ষেপ করার কথা বলা হয়েছে। সেটির ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে আল্লাহর আগুন। কিয়ামতের বদলাকে (আখিরাত) অবিশ্বাস করার কারণে মানুষের মধ্যে কী ধরনের নৈতিক ত্রুটি দেখা দেয় তা উল্লেখ করতে গিয়ে সূরা মাউনে বলা হয়েছে তারা আর কেউ নয়, ঐ সব লোক যারা ইয়াতিমের সাথে দুর্ব্যবহার করে ও মিসকিনকে খাবার দেয় না এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস অপরকে দেয়া থেকে বিরত থাকে ও লোক দেখানো কাজ করে। তৎকালে মানুষ নানাবিধ অনৈতিক কাজে নিয়োজিত থাকতো। এর মূলে ছিল আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাস। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদেরকে ভালো কাজ বা নেক কাজে উদ্বুদ্ধ করেছেন। মানুষের বিবেকের মাঝে ভালো কাজের একটি ধারণা আল্লাহই দিয়ে রেখেছেন। মানুষ যে সব কাজকে ভালো মনে করে আল্লাহপাক সেগুলোই হালাল করেছেন। পক্ষান্তরে মানুষ যে কাজগুলোকে ঘৃণা করে ও মন্দ জানে সেগুলোকেই হারাম করেছেন। মদ-জুয়া, নগ্নতা-অশ্লীলতা, যিনা-ব্যাভিচার, চুরি-ডাকাতি, ঘুষ, খেয়ানত, ওজনে কম-বেশি-ভেজাল প্রদান, ধোকা-প্রতারণা-শঠতা, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, গালি দেয়া, আঘাত করা, সবধরনের জুলুম-নির্যাতনকে মানবপ্রকৃতিই মন্দ বলে এবং তা সবই আল্লাহ হারাম করেছেন। অতি ছোট্ট সূরা আসরে আল্লাহ কতো চমৎকারভাবে ধ্বংস ও বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় বলে দিয়েছেন। তা হলো ঈমান, নেক আমল, হকের প্রতি নছিয়ত ও ধৈর্যধারণের উৎসাহ যোগানো। প্রত্যেকটি গুণই মানুষের মধ্যে থাকতে হবে এবং সেটি বর্তমান থাকলেই কেবল সাফল্য সম্ভব। ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর মাধ্যমেই একটি সমাজ পরিশুদ্ধ হতে পারে। সাহাবায়ে কেরামদের কাছে সূরা আসর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম শাফেয়ী (রহ) বলেন, হেদায়াতের জন্য এই সূরাটিই যথেষ্ট। মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্বের মূলে রয়েছে মানবজাতির কল্যাণ সাধন এবং ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখা। সূরা যিলযালে আখিরাতের বর্ণনা দানের সাথে বলা হয়েছে, অণু পরিমাণ ভালো ও মন্দ কাজ সবই মানুষের আমলনামায় লিপিবদ্ধ হচ্ছে। প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)-এর দাওয়াতে খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষ সাড়া দিয়েছিল। সে সময়ে সাড়াদানকারী সাহাবীদের (রা) দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ ছিল না বরং ঈমান আনার মধ্যে ছিল জীবন, সম্পদ ও সম্মানহানির ঝুঁকি। নিজেদেরকে বিপদগ্রস্ত ও সম্মানহানির ভয়ে তৎকালে অনেকেইে রসূল (সা)-এর দাওয়াত ও কুরআনের প্রতি দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও ঈমান আনতে পারেনি। ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা (খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা)-এর পিতা) সবকিছু উপলব্ধি করার পরও সামাজিক নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে ঈমান আনতে পারেনি। রসূল (সা)-এর দাওয়াতের জবাবে আবু লাহাব বলেছিল, তোমার দ্বীন গ্রহণ করলে আমি কী পাবো? জবাবে রসূল (সা) বলেছিলেন, অন্যরা যা পান আপনিও তাই পাবেন। জবাবে আবু লাহাব বলেছিল, যে দ্বীন গ্রহণ করলে আমি সাধারণের কাতারে চলে যাব সেই দ্বীন আমি গ্রহণ করতে পারি না। সারাজীবন রসূল (সা)-কে আগলে রেখেছিলেন যে চাচা সেই আবু তালিবও সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ে ঈমান আনতে পারেনি। মক্কায় ঈমান গ্রহণকারী মু’মিনদের পরকালিন জীবনের সাফল্যই ছিল জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। সেই সময়ের প্রতিকূল পরিবেশ তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল ঈমানের দৃঢ়তা, পরম ধৈর্য এবং আল্লাহর নাফরমানিমূলক সকল কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকার যোগ্যতা। খাঁটি সোনায় পরিণত হওয়া স্বল্প সংখ্যক মু’মিনরাই মদীনায় হিজরত করার পর নবগঠিত রাষ্ট্রের নেতৃত্বদানে সফল হয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খেয়ানত থেকেও তাঁরা দূরে ছিলেন। মদীনায় হিজরত করার পর অনুকূল পরিবেশে ইসলাম গ্রহণকারী লোকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সামষ্টিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হিসেবে জামাতে নামায এবং রোযার মতো ইবাদত সেসময়ে কার্যকর হয়েছে। আখিরাতে জবাবদিহির অনুভূতিই মানুষকে আল্লাহর হুকুম মানা ও নিষেধ থেকে বিরত রাখে। আনুষ্ঠানিক ইবাদতসমূহ মানুষকে সার্বক্ষণিক আল্লাহর হুকুম মানায় সহায়তা করে। মনিবের হুকুম পালনের ক্ষেত্রে দু’টি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক. মনিবের স্মরণ, দুই. মুনিবের ভয়। মানুষ যে আল্লাহর গোলাম নামায বারবার তাকে তা স্মরণ করে দেয় এবং দৈনিক পাঁচবার আল্লাহর ঘরে উপস্থিত হয়ে সে তাঁর গোলামী করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী আর মুসলিম থাকে না, হয়ে পড়ে মুনাফিক। পাঁচ ওয়াক্ত নামায মানুষকে আল্লাহর গোলামীর কথা স্মরণ করে দেয় বলে নামাযকে বলা হয় ‘জিকর’। নামাযের উপকারিতা প্রসঙ্গে আল্লাহ জোর দিয়ে বলেছেন, নিশ্চয়ই নামায মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। রোযা মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে। পুরো মাসব্যাপী রোযা পালন মানুষের মধ্যে এই অনুভূতিই জাগ্রত করে, দুনিয়ার কেউ না দেখলেও আল্লাহ দেখেন এবং আল্লাহরই ভয়ে সে সব ধরনের অন্যায়-অপকর্ম থেকে দূরে থাকে। মক্কায় নিপীড়ন-নির্যাতন এবং মদীনায় সমগ্র আরবের বিরুদ্ধে বুক টান করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পশ্চাতে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং পরকালিন সাফল্যই ছিল প্রেরণা। তাই স্বল্প সংখ্যক সাহাবী বিশাল বাহিনীর মোকবেলায় হিম্মতহারা হননি। আর আল্লাহ তাঁদেরকে সেভাবে উদ্বুদ্ধও করেছেন। যদিও আল্লাহ বলেছেন, তোমরা পছন্দ করো আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, কিন্তু এটি ছিল সেকেন্ডারি। আল্লাহর পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টার (জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ) প্রধানত লাভ হিসেবে আল্লাহপাক স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, সব ধরনের গুনাহের ক্ষমা ও জান্নাতপ্রাপ্তি যার তলদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত (সূরা সফ)। দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ ঘোষণার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর মু’মিন বান্দাদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তোমরা দশজন একশ জনের ওপর বিজয়ী হবে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাহিনী বিশাল বাহিনীর ওপর জয়লাভ করবে, মৃত্যুর সময় সুনির্দিষ্ট রয়েছে; আবার যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, তারা রিজিকপ্রাপ্ত। দুনিয়ায় মু’মিনদের সম্মানজনক রিজিক ও নেতৃত্ব (খেলাফত) দানের প্রতিশ্রুতিও প্রদান করা রয়েছে (সূরা নূর ৫৫)। এই সমাজে মানুষ বিভিন্ন আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় এবং সেজন্য অনেক ত্যাগও স্বীকার করে। এর পেছনে আখিরাত নয় কেবল দুনিয়ার কল্যাণই লক্ষ্য হিসেবে কাজ করে। তারপরও দেখা যায়, বছরের পর বছর দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেও তারা টিকে থাকে। পেছনে একটিই লক্ষ্য, ত্যাগী নেতা হিসেবে ইতিহাসে স্থান ধরে রাখা। কিন্তু এই সংখ্যাটি খুবই নগন্য। দেখা যায়, একটি পর্যায়ে তাদের অনেকেই আর টিকে থাকতে পারে না। দুনিয়াবী স্বার্থের কাছে হার মানে। পক্ষান্তরে মু’মিনের হারানোর কিছু নেই। বরং দুনিয়ায় যে যতো বেশি বঞ্চিত হবে ও নিপীড়ন-নির্যাতনের সম্মুখীন হবে আখিরাতে তার মর্যাদা তত বৃদ্ধি পাবে। আখিরাতের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় সব ধরনের লোভ ও ভয় থেকে তাকে মুক্ত করে। আজকের সমাজে সীমাহীন দুর্নীতি ও নৈতিক অধপতন এবং করোনার কারণে মৃত্যুর মিছিল দেখার পরও মানুষের নৈতিক আচরণে পরিশুদ্ধি নেই, এর মূল কারণ আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসহীনতা। ঈমান ও নৈতিক অধপতন দু’টি একসাথে থাকতে পারে না। সদাচরণ ও নৈতিক উৎকর্ষতার বর্ণনায় হাদিসের পৃষ্ঠাগুলো ভরপুর হয়ে আছে। কারো মধ্যে যদি নৈতিক অধপতন দৃষ্ট হয় বুঝতে হবে তার মধ্যে ঈমান নেই বা ঈমানের দুর্বলতা রয়েছে। আর কারো মধ্যে ঈমান থাকলে অবশ্যম্ভাবী তার কাছ থেকে ভালো কথা ও কল্যাণকর কিছু পাওয়া যাবে। সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ, দুর্নীতি, রাহাজানি, মানুষের অধিকারহরণ প্রমাণ করে এ জাতি বিশ্বাসবিবর্জিত জাতিতে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় লেবাছ বা চটকদার কথাবার্তা সবই ধোঁকা-প্রতারণা। মানুষের দ্বারা ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এমন হলে ঈমানদার ব্যক্তি দ্রুতই নিজেকে সংশোধন করে নেয় এবং তাওবা করে সে আল্লাহর পথে ফিরে আসে। রসূল (সা)-এর সময়ে সেই মহিলার কথা আমরা জানি যে শয়তানের প্ররোচণায় যিনা করে বসেছিল। কিন্তু পরকালের ভয়ে সে এতো ভীত হয়ে পড়েছিল যে যিনার দুনিয়াবী শাস্তি জানার পরও নিজেকে গুনাহ থেকে পবিত্র করার লক্ষ্যে রসূল (সা)-এর কাছে এসে সে তার অপরাধ স্বীকার করে। রসূল (সা) তাকে বারবার ফিরিয়ে দেন। যিনা সে বুঝে কি না বা এর শাস্তি কী তা তাকে বলেন। তৃতীয়বার আসলে তার ওপর দন্ড কার্যকর করেন। পাথর ছুঁড়ে মারার একটি পর্যায়ে সরে যেতে চাইলে তাকে সে সুযোগ দেয়া হয় না। আল্লাহর রসূল (সা) জানার পর বলেন, তোমরা যদি তাকে পালিয়ে যেতে দিতে কতই না ভালো হতো। শাস্তিদানের ক্ষেত্রে এই হলো শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি। রক্তের ছিটা পড়লে কেউ কেউ বিরক্তি প্রকাশ করেন। প্রিয়তম নবী (সা) বলেন, ঐ মহিলা যে তাওবা করেছে তা সমগ্র মদীনাবাসীর মধ্যে ভাগ করে দিলে তা যথেষ্ট হতে পারতো। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি, রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় ইসলাম স্বীকার করে না। আখিরাতে জবাবদিহি থেকে মুক্তির লক্ষ্যে কেউ স্বেচ্ছায় অপরাধ স্বীকার করলে তাকে তার প্রাপ্য দন্ড দেয়া হবে। অপরাধ করে যে কেউ তা গোপন রেখে তার রবের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারে, এ সুযোগ তার রয়েছে। ইসলামে বিচার দু’টি উপায়ে। এক. স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি প্রদান, দুই. সাক্ষীর সাক্ষ্যদানের ভিত্তিতে। অপরাধীর কাছ থেকে শক্তি প্রয়োগ করে স্বীকারোক্তি আদায় নয়, বিচারপ্রার্থী বা রাষ্ট্রকেই অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করতে হবে। মিথ্যা সাক্ষ্যদান, জেনেশুনে মিথ্যার পক্ষাবলম্বন ও মিথ্যার পক্ষে রায় দান কোনো ঈমানদার ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। পরকাল অবিশ্বাসী নিরেট নাস্তিকের পক্ষেই মিথ্যার পক্ষাবলম্বন সম্ভব এবং পরিণতি জাহান্নাম। কঠোর শাস্তিদানের মাধ্যমে সমাজ থেকে অপরাধ দমন নয়, বরং পরকালে প্রতিটি কাজের জবাবদিহির অনুভূতি সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূলের প্রচেষ্টা শুরু থেকেই আল্লাহপাক কুরআনের মাধ্যমে প্রদান করেছেন। এই দুনিয়া একটি পরীক্ষাগার। পরীক্ষাগ্রহণ আল্লাহর এক স্থায়ী নিয়ম। আল্লাহর ভাষায় ‘আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে ভয়-ভীতি, অনশন, জানমালের ক্ষতি ও আমদানি হ্রাসের দ্বারা পরীক্ষা করবো। বিপদ-মুছিবত উপস্থিত হলে যারা ধৈর্য ধারণ করে ও বলে, আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাবো। তাদের জন্য সুসংবাদ’- সূরা বাকারা ১৫৫-১৫৬। রোগ-ব্যাধি, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, চাকুরি-ব্যবসা-বাণিজ্য বা অত্যাচারী শাসকের পক্ষ থেকে বান্দার ওপর পরীক্ষা হিসেবে বিপদ আসবে। পরকালে কল্যাণ লাভের আশায় একজন মু’মিন সবকিছু অকাতরে সহ্য করতে পারেন। দুনিয়ার এ সব কষ্ট ও বিপদাপদ খুবই সাময়িক এবং এগুলো গুনাহ মাফের কারণ। আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় বান্দাহকে বেগুনাহ অবস্থায় তাঁর কাছে ফেরত নিতে চান। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর পথে চলার ক্ষেত্রে পরম ধৈর্য অবলম্বনের তাওফিক দান করুন। আমিন। ২৮.০৬.২০২০

Comments