Skip to main content

মৃত্যুভয় অমূলক

মৃত্যু অনিবার্য। এড়িয়ে চলার কোনো সুযোগ নেই। যাদের প্রাণ আছে এমন সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যু নিয়ে আস্তিক-নাস্তিক কারো মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। সন্দেহ-অবিশ্বাস রয়েছে মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে। নিরেট নাস্তিক ছাড়া মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে সকলেরই কোনো না কোনোভাবে ধারণা বা বিশ্বাস রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মৃত্যু দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি মাত্র এবং এক অনন্তকালের যাত্রা। কিয়ামত সংঘটন, বিচার অনুষ্ঠান এবং জান্নাত-জাহান্নামের ধারণা আমাদের বিশ্বাসেরই অংশ। ইসলামে যেসব মৌলিক বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে তন্মধ্যে তকদির অন্যতম। তকদিরের বিষয়টি আমাদের কাছে গোপন রয়েছে। মানুষ আল্লাহ তায়ালার প্রতিনিধি। প্রতিনিধি হিসেবে কার্যসম্পাদনে তাকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করবে আল্লাহর অনুমোদনের পর। দুনিয়াটাকে আল্লাহপাক লোভনীয় করে সৃষ্টি করেছেন। এর প্রতি মায়া-মুহাব্বত প্রকৃতিজাত। দুনিয়ার আরাম-আয়েস, সুখ-শান্তি ভোগ-ব্যবহারে ইসলামে কোনো বাধা নেই, তবে একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যারা অবস্থান করবে অর্থাৎ আল্লাহর অনুগত হয়ে জীবন-যাপন করবে তাদের জন্য রয়েছে মৃত্যু পরবর্তী মহা সুখ-শান্তির সুসংবাদ। আখিরাতে অনন্তকালের সুখ-শান্তি লাভের ক্ষেত্রে দুনিয়ার জীবনে কিছু ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন রয়েছে। আখিরাতের জীবনে চিরস্থায়ী জান্নাতপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আল্লাহপাক তাঁর পথে প্রচেষ্টাকে (জিহাদ) অগ্রাধিকার দান করেছেন এবং স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, যারা তাঁর পথে প্রচেষ্টা চালাবে তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্ষমা ও এমন জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত (সূরা সফ ১১-১২)। যুদ্ধ মানেই ঝুঁকি এবং সেখানে মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকে। মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ একান্তভাবে আল্লাহর। তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে যারা এই কাজটি করে তারা মূলত আল্লাহর সাহায্যকারী, তারা অত্যন্ত মর্যাদাবান। যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে যেতে হিম্মত দরকার। নানাভাবে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কখনো বলেছেন, যারা আল্লাহর পথে মারা যায় তাদেরকে মৃত বলো না, তারা জীবন্ত। আবার কোথাও বলেছেন, তারা রিজিকপ্রাপ্ত। ইসলামিক পরিভাষায় তাদেরকে বলা হয় শহীদ। তারপরও তো মৃত্যু। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও দুনিয়ার জীবনের আরাম-আয়েস সবকিছু ত্যাগ করে অনন্ত পথে পাড়ি জমানো স্বাভাবিকভাবে ভয়েরই কথা। আল্লাহ বলেছেন, মৃত্যুভয় একেবারেই অমূলক, যুদ্ধের ময়দানে বা ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজে গেলেই যে মৃত্যু ঘটবে এমনটি নয়। আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কখনই কারো মৃত্যু আসে না। তাঁর বাণী, ‘কোনো প্রাণীই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মরতে পারে না। মৃত্যুর সময় সুনির্দিষ্ট’- সূরা আলে ইমরান ১৪৫। তিনি আরো বলেছেন, ‘মৃত্যু, তোমাকে ধরবেই ধরবে, সুরক্ষিত দালানে থাকলেও’- সূরা আন নিসা ৭৮ দু’টি আয়াতের অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে। সূরা দু’টি বদর ও ওহুদ যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অবতীর্ণ। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের তাঁর পথে জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করার জন্য সাহস যুগিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন। ইসলাম কার্যকারণ সম্পর্ক অস্বীকার করে না। যুদ্ধের ময়দানে তীর বা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় মারা গেলে সে শহীদের মর্যাদা পাবে। আবার এ কথাও নিশ্চিত, শহীদ হওয়াটা আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে নয়। আল্লাহ না চাইলে মৃত্যু আসবে না, এটি মনে করে আল্লাহর রসুল (সা) যুদ্ধযাত্রায় শিশু ও বৃদ্ধদের সাথে নিতে পারতেন, কারণ আল্লাহর ওপর নির্ভরতার ক্ষেত্রে তাঁর সাথে আর কারো তুলনা নেই। কিন্তু তিনি তা করেননি এবং লোকালয় থেকে বেরিয়ে তিনি যুদ্ধ করেছেন। এখনো লক্ষ্য করা যায়, যে সব সেক্টরে যুদ্ধ হয় সেখান থেকে সাধারণ মানুষদের সরিয়ে নেয়া হয়। মৃত্যু লেখা না থাকলে মরবো না, এ কথা বলে যুদ্ধসংলগ্ন এলাকায় কেউ থাকবোও বলে না। এটি প্রকৃতিরই দাবী। সে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। একজন নাগরিকের স্থান ত্যাগ না করা অপরাধ, পক্ষান্তরে একজন যোদ্ধা বা সৈনিকের স্থান ত্যাগ করা ভয়াবহ অপরাধ। কারণ তাকে প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম দিয়েই প্রেরণ করা হয়েছে। দেশে এখন যুদ্ধ চলছে করোনার বিরুদ্ধে। করোনা আল্লাহপাকের সৃষ্ট এক ভয়ঙ্কর জীবাণু। আল্লাহ তায়ালা তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। তাই করোনা থেকে আত্মরক্ষা করা, তাকে প্রতিহত করা মানুষের দায়িত্ব। আল্লাহ নিজেই শিখিয়ে দিয়েছেন তাঁর সৃষ্ট সকল কিছুর অনিষ্ট থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় চাওয়ার (সূরা ফালাক)। করোনা এক ছোঁয়াচে রোগ। আল্লাহর রসুল (সা) বলেছেন, ‘তোমরা মহামারি আক্রান্ত এলাকায় যাবে না, আবার সে সময়ে আক্রান্ত এলাকা থেকে বেরও হবে না।’ এমতাবস্থায় কারো মৃত্যু হলে রসুল (সা) তাকে শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই মহামারি থেকে আত্মরক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞরা যে সব পরামর্শ প্রদান করছেন (ঘরে অবস্থান, একান্ত বের হলে মাস্ক পরিধান, ঘন ঘন হাত ধোয়া, পরিচ্ছন্ন থাকা, পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ও শারীরিক পরিশ্রম ইত্যাদি) তা মেনে চলা হাদিসের ওপরই আমল হবে। করোনায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা, সেবা-যত্ন ও তার সাথে উত্তম আচরণ, মারা গেলে দাফন-কাফন, সাহায্য-সহযোগিতা পৌঁছানো কাজে যারা নিয়োজিত, তাদের মর্যাদা সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত যোদ্ধার মত। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা সামগ্রীসহ (তার পক্ষে সম্ভব সর্বোচ্চ সতকর্তা অবলম্বন) করোনা রোগীর সেবা করবে এ ধারণায় যে, বিপদাপদ ও মৃত্যু আল্লাহর ফয়সালার বাইরে হয় না। সে মাঠে-ময়দানে কাজ করবে ও আল্লাহর সৃষ্ট করোনার অনিষ্ট থেকে তাঁরই কাছে আশ্রয় চাইবে। সাধারণ মানুষ বা করোনা যোদ্ধাদের পরিজন (ঘরে অবস্থান করা মানুষগুলো) আল্লাহর শেখানো ভাষায় (সূরা ফালাক ও নাস) তাঁরই কাছে দুআ করবে। এই শ্রেণির যোদ্ধাদের (যাদের প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা সামগ্রী রয়েছে) কাছে রসুল (সা)-এর হাদিসটি যথার্থ- ‘ছোঁয়াচে বা কুলক্ষণ বলে কিছু নেই’। মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেকে বিপদের মধ্যে ফেলবে, তা ইসলাম সমর্থন করে না। বিপদ-মুসিবত এড়িয়ে পথ চলাটাকে ইসলাম পছন্দ করে। তাই বলে সততার ওপর টিকে থাকার ক্ষেত্রে বিপদ বা হক প্রতিষ্ঠায় বিপদাপদ এড়িয়ে আপোষ করে চলাকে ইসলাম অনুমোদন দেয় না। এ ক্ষেত্রে কুরআন সাহস যোগায়, কোনো বিপদ কখনই আসে না, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া (সূরা তাগাবুন)। ইসলাম সকল ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের পক্ষে। কোনো ব্যাপারে বাড়াবাড়ি পছন্দনীয় নয়। তাই আমরা যেমন কোনো ব্যাপারে বেপরোয়া হবো না আবার ভীরুতাও প্রদর্শন করবো না। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর পথে চলাটা সহজ করে দিন। ১৯.০৬.২০২০

Comments