সমস্যাসঙ্কুল এই দুনিয়ায় আমরা চাইলেই কি টেনশন মুক্ত থাকতে পারি? এ প্রশ্ন সবারই। আমাদের রয়েছে রোগ-শোক, আছে রুটি-রুজির চিন্তা, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, বার্ধক্য বয়সে নিজেকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা, জীবনে সাধিত অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি-গুনাহ নিয়ে চিন্তা, মৃত্যুপরবর্তী জীবনে শাস্তি নিয়ে ভাবনা, এমন হাজারো সমস্যা সব সময় আমাদের মনের কোনে উঁকি-ঝুঁকি মারে। একজন ছাত্রের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ, ছাত্রজীবন শেষে কর্মসংস্থানের চিন্তা, যুবক-যুবতির বিয়ে-সাদী নিয়ে ভাবনা, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতার সাথে সন্তান-সন্ততির সম্পর্ক, ভাই-বোনদের পারস্পরিক সম্পর্ক, অফিসে বস ও অধীনস্থদের সম্পর্ক-এই পৃথিবীতে কতো যে সমস্যা তা গুণে শেষ করা যাবে না এবং এ সকল বিষয়ই আমাদেরকে টেনশনে ফেলে দেয়। অথচ এই টেনশন আমাদের শরীর ও মনের ওপর দারুণ বিরূপ প্রভাব ফেলে। আজকাল হার্ট এ্যাটাক ও ব্রেনস্ট্রোক দারুণভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, টেনশন ফ্রি থাকতে পারলে এ সব রোগ থেকে নিজেকে অনেকখানি দূরে রাখা সম্ভব। বর্তমানে করোনা থেকে উত্তরণের জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়। এটাও নির্ভর করে টেনশনফ্রি থাকার ওপর।
মানুষের জীবনে নিরবচ্ছিন্ন সুখ বা দুঃখ বলে কিছু নেই। দুটোই পাশাপাশি রয়েছে। দুনিয়া একটি কর্মক্ষেত্র এবং ফলভোগের জায়গা হলো আখিরাত। সেখানে হয় চিরন্তন সুখ নয় তো চিরন্তন দুঃখ। পৃথিবী একটি পরীক্ষাগার-এখানে আল্লাহপাক সুখ ও দুঃখ উভয়টি দিয়ে তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন এবং সব অবস্থায় তিনি তাঁর বান্দাদের সাথে রয়েছেন। দুনিয়ার সামান্য জীবনের বিনিময়ে আখিরাতে অনন্ত কালের চিরস্থায়ী সুখের জন্য আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের বিপদ-মুছিবত দিয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করেন। সূরা বাকারার ১৫৫-১৫৭ নং আয়াতে বান্দা থেকে নানাভাবে পরীক্ষা গ্রহণের কথা আল্লাহ বলেছেন এবং শেষে বলেছেন যারা ধৈর্য অবলম্বন করে ও বলে, ‘আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁর কাছে ফিরে যাব’-তাদের জন্য সুসংবাদ। সূরা তাগাবুন ১১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, বিপদাপদ যা আসে তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং যে ঈমান আনে আল্লাহ তার দিলকে হেদায়াত দান করেন।
এখানে দু’টি আয়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাতে স্পষ্ট করা হয়েছে, বান্দার ওপর বিপদ-মুসিবত যা আসে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তা আসে পরীক্ষা হিসাবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া অর্থ জীবনে সাফল্য অর্জন। যার আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান আছে, কোনো বিপদই তাকে হতাশ করে না বা অস্থির করে না। কারগারের নির্জন প্রকোষ্ঠ বা ফাঁসির মঞ্চ তাকে বিচলিত করতে পারে না। রসুলুল্লাহ (সা) কতো সুন্দরভাবেই না বলেছেন, মু’মিনের জন্য সব অবস্থাই কল্যাণকর। দুঃখ-কষ্টে পড়লে সে ধৈর্য অবলম্বন করে এবং সচ্ছলতা আসলে সে শুকরিয়া আদায় করে। ঈমানের মতো পুঁজি কারো অন্তরে থাকলে সে কখনো পেরেশানিতে নিমজ্জিত হতে পারে না। সে তার সকল দুঃখ-কষ্ট মহান মুনিবের কাছে পেশ করে ঝামেলামুক্ত হয়ে পড়ে।
মানুষ তার আপন জনের আঘাত সহজে ভুলতে চায় না। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশির আচরণে সে বড় অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। সূরা তাগাবুন ১৪ নং আয়াতে আল্লাহ স্বীকার করেছেন, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মাঝে কতিপয় শত্রু কিন্তু আল্লাহ কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। জীবনে চলতে গিয়ে নানাভাবে নানাজনের কাছ থেকে ব্যথা-বেদনা পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গেলেন তো হেরে গেলেন। ক্ষমা করার মাঝেই রয়েছে আনন্দ, আছে পরম প্রাপ্তি। এক. টেনশন থেকে মুক্তি, দুই. আল্লাহর ক্ষমা। রসুলুল্লাহ (সা)-এর বাণী কি আমরা উপেক্ষা করতে পারি, ‘যে তার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার অপরাধ ক্ষমা করবেন’। এমন কোনো হতভাগা আছে কি, যে কিয়ামতের ভয়াবহ দিনে আল্লাহর ক্ষমা থেকে বঞ্চিত থাকতে চায়?
আপনার আর্থিক প্রাচুর্যতা নেই, তাই আপনি হতাশ। আপনার কী কী আছে তা কি কখনো গণনা করে দেখেছেন? আপনার সুস্থতা, বাবা-মার ভালোবাসা, দিল শীতলকারী স্বামী-স্ত্রী, চোখজুড়ানো সন্তান-সন্ততি, কল্যাণকামী আত্মীয়-স্বজন, সামাজিক মর্যাদা সর্বোপরি আল্লাহর পথে চলার মত হেদায়াত, আপনার তো কোনো অভাবই নেই। আপনি খেয়াল করুণ, আপনাকে যা দেয়া হয়েছে তা অনেকের ভাগ্যে জুটেনি। তাই হতাশা নয়, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপনার অন্তর সিক্ত হওয়ার কথা। আপনি রুটি-রুজির চিন্তায় বড় কাতর। আপনি তো আল্লাহর বাণীর সাথে পরিচিত, আল্লাহর কতো সৃষ্টি রয়েছে যারা কেউ রিজিক বহন করে চলে না, আল্লাহই তাদের রিজিক দেন এবং তোমাদের রিজিকও তিনিই দেবেন। আল্লাহর নিরানব্বইটি নামের একটি নাম রাজ্জাক। তাই আল্লাহর দেয়া নিয়ম অনুসরণ করে চেষ্টা করুন ও তাঁর কাছে সাহায্য চান, অবশ্যই তিনি দেবেন।
আপনি জীবনে অনেক পাপ করেছেন। ফরজ নামায পড়েননি, রোযা রাখেননি, যাকাত আদায় করেননি আরো কতো গুনাহ করেছেন যার খবর আল্লাহ ছাড়া কেউ রাখেন না। কোনো এক যুদ্ধে যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে এক মহিলা তার ছেলেকে আশেপাশে খুঁজছিল। তারপর ছেলেকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বারবার চুমু খাচ্ছিলো ও আদর করছিল। রসুলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, তোমরা কি মনে করো, এই মহিলার ছেলে আগুনে পুড়ুক, তা কি সে চাইবে? সবাই সমস্বরে বলে উঠলো কখনই নয়। তিনি বললেন, আল্লাহপাক এই মহিলার চেয়েও তাঁর বান্দাদের প্রতি অধিক দয়ার্দ। তাই হতাশ না হয়ে শুধু বলুন, পরোয়ারদেগার, ভুল হয়ে গেছে, নিজের ওপর অনেক জুলুম করেছি, তুমি ক্ষমা করে দাও। আপনি তো আর আল্লাহর বিদ্রোহী বান্দাহ নন। তাই নিরাশ হবেন কেন? আর অপেক্ষা না করে এখনই নামায শুরু করুন, বাকিটা দেখার দায়িত্ব আল্লাহর।
আপনি হয়তো ফজরের নামাযে জাগতে পারছেন না বা কোনো বাজে অভ্যাস ত্যাগ করতে চাইলেও পারছেন না। তাতে সমস্যা কী? আল্লাহ দেখবেন আপনার দৃঢ় ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা। শুরু করার দায়িত্ব আপনার এবং আপনাকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর। আপনি আল্লাহকে অনুভব করবেন মহানুভব, দয়ার্দ ও উদার হিসেবে এবং আপনি আল্লাহকে যতটুকু অনুভব করবেন, পাবেন তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি হিসেবে। বান্দাকে শাস্তি দেয়ার জন্য আল্লাহ ওৎ পেতে বসে নেই বরং ক্ষমা করার জন্য বান্দার মধ্যে ভালো দিকগুলো তালাশ করবেন। তাই আল্লাহর প্রতি বিনয়ী হোন ও বেশি বেশি করে ভালো কাজ করুন। আর ফিরে আসার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না। কারণ সে সুযোগ আপনার নাও আসতে পারে। ঝেড়ে ফেলুন জীবন থেকে সকল হতাশা, খুঁজুন জীবনের মধ্যে বেঁচে থাকার আনন্দ। আল্লাহর ওপর ঈমান ও নির্ভরতাই আপনাকে দিতে পারে সেই আনন্দ। ০৬.০৬.২০২০
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment