ফিতরাত বলতে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিকে বুঝায়। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি যা দাবী করে ইসলাম মূলত তাই। আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের চেনা-জানা জিনিসকেই আল্লাহ হালাল করেছেন। হারাম সুনির্দিষ্ট এবং খুবই সীমিত। মদ-জুয়া-যিনা-সুদ-ঘুষ এ সব হারাম জিনিসের প্রতি ঘৃণা আল্লাহপাক মানুষের প্রকৃতিতেই দিয়ে রেখেছেন। যারা এর সাথে সংশ্লিষ্ট তারা প্রকৃতিবিরোধী কাজটিই করে থাকে। আবার নেক কাজের প্রতি সুধারণা ও আগ্রহ মানুষের প্রকৃতিজাত। ন্যায় পথে উপার্জন, সৃষ্টির প্রতি সদাচরণ, মানুষের দুঃখ-কষ্টে ব্যথিত হওয়া ও এগিয়ে আসা-এ সব প্রকৃতিরই দাবী। এ জন্য বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণ সব মানবগোষ্ঠীর মাঝে অনেক ভালো লোকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
আল্লাহপাকের সকল সৃষ্টির ধর্মই হলো ইসলাম। আকাশ-বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা-সাগর-মহাসাগর, গ্রহ-নক্ষত্র, জীব-জানোয়ার-কীটপতঙ্গ এমন কি করোনা ভাইরাস সবই মুসলিম। অর্থাৎ সকল সৃষ্টি তার স্রষ্টার (আল্লাহর) অনুগত। স্রষ্টা প্রদত্ত নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাবার সাধ্য কারো নেই। এমনকি, যে ব্যক্তি আল্লাহকে অবিশ্বাস করে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও মুসলিম। অর্থাৎ যাকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে সে সেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এজন্যই তো আখিরাতে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যক্ষ (চোখ, কান, হাত-পা, জিহবা সবই) তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।
এই বিশ্বজাহানের স্রষ্টা (খালেক), লালন-পালনকারী (রব) এবং শাসক (মালেক) হলেন মহান আল্লাহ। সকল সৃষ্টি নিরাপদ ও সুন্দর জীবন যাপন করবে-এটি তাঁর অভিপ্রায়। সৃষ্টি কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর তিনি মানুষ সৃষ্টি করে তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ফেরেশতাদের সেজদা করার নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। সকলে আল্লাহর হুকুম পালন করলেও শয়তান অস্বীকার করে অভিশপ্ত হয়। তার প্রার্থনানুসারে কিয়ামত পর্যন্ত তাকে অবকাশ দেয়া হয় এবং মানুষকে বিভ্রান্ত (অসওয়াসা সৃষ্টি) করার মত ক্ষমতাও তাকে প্রদান করা হয়। শয়তান ও মানুষ পরস্পরের শত্রু এমতাবস্থায় আদম (আ)-কে পৃথিবীতে চলে আসার জন্য বলা হলে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁকে অভয়বাণী শোনানো হয়, তাঁর পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই।
বিবেক-বুদ্ধির পাশাপাশি প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আল্লাহপাক মানুষের হেদায়াতের জন্য নবী-রসুল ও কিতাব পাঠিয়েছেন। সেখানে স্পষ্ট করেছেন, দুনিয়ার জীবন নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী এবং যারা তাঁর হেদায়াত অনুসরণ করবে তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত নেয়াভতেভরা চিরস্থায়ী জান্নাত এবং যারা মেনে চলবে না তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ আযাব জাহান্নামের শাস্তি। দুনিয়া একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। ঈমানদারদের জীবনে নেমে এসেছে নানাবিধ পরীক্ষা এবং তা চলবে কিয়ামত পর্যন্ত। আর শয়তানের অনুচররা পৃথিবীর শাসন কর্তৃত্ব দখল করে যুগে যুগে জুলুম-নির্যাতন ও পাপাচারে জনজীবন অতীষ্ঠ করে তুলেছে। আল্লাহপাক সে সময়ে নবী-রসুল প্রেরণ করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আবার সীমালঙ্ঘনকারী ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীকে শাস্তি দিয়ে পৃথিবীবাসীকে নিরাপদ করেছেন।
গজব বলি বা বিপদাপদ বলি সবই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। এটা আসে বিশ্বাসীদের জন্য পরীক্ষা এবং অবিশ্বাসীদের জন্য শাস্তি হিসেবে। আল্লাহর ভাষায় সবই মানুষের হাতের কামাই। বর্তমান বিশ্ব জুলুম-নির্যাতন ও পাপাচারে পূর্ণ হয়ে পড়েছে। অগণিত মজলুমের কান্না আল্লাহর আরশ স্পর্শ করেছে। অনেকে জুলুমের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, আবার অনেকে সমর্থক বা নীরব দর্শক হয়ে থাকার অপরাধে আল্লাহপ্রদত্ত করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী আঘাত হেনেছে। করোনা ভাইরাস অতি ক্ষুদ্র জীবাণু যা খালি চোখে দেখা যায় না। আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা বলে করোনা সমগ্র বিশ্ববাসীকে ঘরবদ্ধ করেছে এবং মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা ও কার্যক্রম ব্যাহত করেছে। ইতোমধ্যে ষাট লক্ষাধিক লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং তিন লক্ষ সাতষট্টি হাজার সাত শত পনের জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।
করোনা আল্লাহর সৃষ্ট এবং পূর্ণরূপে মুসলিম (অনুগত)। আল্লাহ তাকে যে ক্ষমতা ও গুণ দিয়েছেন তার বলে সে সমগ্র বিশ্বকে হতাশা ও আতঙ্কে নিমজ্জিত করেছে। আবার মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি এবং প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর গুণ-ক্ষমতার একটি ক্ষুদ্র অংশ সে লাভ করেছে। এজন্যই বলা হয়, তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও, আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হও। আল্লাহর প্রদত্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে লকডাউন, ঘরে অবস্থান, ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব। পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে শীঘ্রই এর প্রতিষেধক ও ঔষধ আবিষ্কার সম্ভব হবে ইনশা-আল্লাহ। অবশ্য এতে সময় লাগবে। ইতোমধ্যে করোনা মানুষের গর্ব-অহঙ্কার ও শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা ধ্বংস করে দিয়েছে। তার অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মারণাস্ত্র এই ক্ষুদ্র জীবাণু ধ্বংসে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি।
এই করোনা ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী কোনো বাছ-বিছার ছাড়াই সমভাবে ক্ষতি সাধন করছে। করোনা মারাত্মকভাবে ছোঁয়াচে। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে করোনার ধ্বংসক্ষমতা মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। করোনাকে এই গুণ ও ক্ষমতা আল্লাহই দিয়েছেন। করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসলে যে কেউ সংক্রমিত হবে এটিই স্বাভাবিক, এটিই করোনার ধর্ম ও নিয়ম। যদি কেউ আক্রান্ত না হয় তবে বুঝতে হবে সেটি আল্লাহর হুকুম ও তাঁর অনুগ্রহ।
রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, কুলক্ষণ ও ছোঁয়াচে বলে কিছু নেই। আবার তিনি বলেছেন, মহামারি আক্রান্ত এলাকায় তোমরা যেও না, তোমরা কেউ সেখানে থাকলে বেরও হবে না। সাধারণ মানুষের জন্য এই নিয়ম। তারা ঘরে থাকবে, নিতান্ত বাধ্য হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও দূরত্ব বজায় রেখে বের হবে। ডাক্তার, নার্স বা করোনা রোগী সেবাদান বা রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিতরা সুরক্ষা সামগ্রীসহ সেবাদান করবে এবং তাদের জন্য প্রথমোক্ত হাদিস (ছোঁয়াচে বলে কিছু নেই)। আবার করোনা আক্রান্ত রোগীর পাশে থেকে স্বামী/স্ত্রী এক অপরকে সেবাদান করে করোনায় আক্রান্ত নাও হতে পারে। এমনটি ব্যতিক্রম এবং সেটি আল্লাহর হুকুম।
মানুষের তৈরী বিষ খেলে মানুষ মারা যায়। অনেকেই বলবেন, বিষের কোনো ক্ষমতা নেই, আল্লাহরই হুকুমে মৃত্যু হয়। হ্যাঁ শতভাগ সত্য; আবার বিষ খেলে, গলায় ফাঁস দিলে, ১৫ তলা থেকে লাফিয়ে পড়লে মৃত্যু হয়, এটিও সত্য। আল্লাহ না চাইলে মরবো না, এ কথা বলে বিষ পান বা ১৫ তলা থেকে লাফিয়ে পড়াকে ইসলাম অনুমোদন করে না। এমন আল্লাহ নির্ভরতার ইসলামে স্বীকৃতি নেই। বরং আত্মহত্যাকারী হিসেবে জাহান্নামের সুসংবাদ শোনানো হয়েছে। প্রতিটি দ্রব্যের মধ্যে যে গুণ রয়েছে সেটিই তার ধর্ম এবং কর্মে পরিণত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেটি আল্লাহরই বিধান।
মানুষের বিবেক-বুদ্ধি যা আল্লাহপ্রদত্ত হেদায়াতের বিপরিত তা বিকৃতি। যেমন, পাশ্চাত্য সমাজে সমকামিতা, সমঝোতার ভিত্তিতে নারী-পুরুষের মেলামেশা ও সন্তান লাভ এবং মাদকাসক্তি তারা বিবেকসম্মত মনে করলেও এটি তাদের নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মবোধের বিপরিত। ইসলাম এ ধরনের বিবেক-বুদ্ধিকে স্বীকৃতি দেয় না।
ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সহজ-সরল জীবনবিধান যা সম্পূর্ণ বিবেকসম্পন্ন ও সহজে মেনে চলার মত। আল্লাহপাক নানা ভঙ্গিতে বলেছেন, আল্লাহকে ভয় করো যতখানি সাধ্যে কূলায়, তোমাদের ওপর কাঠিন্য আরোপ করা আল্লাহর ইচ্ছা নয়, উম্মাহকে বলা হয়েছে মধ্যমপন্থী জাতি এবং ক্ষমার দরজা উন্মুক্ত রেখে মানুষকে আশার বাণী শোনানো হয়েছে। আল্লাহর রসুল (সা)ও তাঁর উম্মতকে অপেক্ষাকৃত সহজ পন্থা অবলম্বনের কথা বলেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে ফকিহদের মধ্যে মতপার্থক্য উম্মাহর জন্য রহমত এবং সবাই সত্যাশ্রয়ী। রসুলুল্লাহ (সা) তাঁর উম্মাহর জন্য কোনো সংকীর্ণতা রাখেননি এবং সহজতা বিধানের জন্য তাঁর আমলেই ভিন্নতা ছিল। তাই সকল মতের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে যে কোনো একটি মত গ্রহণের এখতিয়ার উম্মাহর রয়েছে। উলামায়ে কেরামের মাঝে মতপার্থক্যে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা (গুনাহ) রয়েছে পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ও একে অপরকে হেয় করার মধ্যে।
আমাদের মডেল হলেন প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)। ইসলাম মানার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর উম্মাহকে যতখানি ছাড় দিয়েছেন সেটি সংকুচিত না করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও যোগ্যতার মানুষকে দ্বীনের সাথে সংশ্লিষ্ট করা বা ধরে রাখার মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ। ইসলামে ঈমান সবচেয়ে বেশি মূল্য বহন করে। আমলের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমার যোগ্য। একজন মুসলিম সেই, যে মনেপ্রাণে ইসলামকে তার জীবনাদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম দ্বীন (জীবনাদর্শ) হিসেবে বিশ্বাস করে এবং মনে করে এর মধ্যেই রয়েছে সার্বিক কল্যাণ। সাথে সাথে সে চায় দ্বীন বিজয়ী হোক। একজন সাধারণ মানুষের জন্য এই বিশ্বাস ও দ্বীনের বুনিয়াদী ইবাদত পালন জান্নাতে যাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট হতে পারে। এ প্রসঙ্গে সেই বেদুইনের কথা স্মরণ করতে হয় যে রসুলুল্লাহ (সা)-এর কাছে দ্বীন শিখতে চাইলে তিনি তাকে ঈমানের সাথে নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জ (সামর্থ হলে) আদায়ের কথা বলেছিলেন। পক্ষান্তরে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর সব থাকা সত্তে¡ দ্বীনের বিজয় কামনা না করায় মুনাফিক সরদার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
ইসলাম সকল সৃষ্টির ধর্ম (সহজাত বা প্রকৃতিজাত)। আবার ইসলাম সব মানুষের ধর্ম। মানুষের জীবনের একটি অংশ সহজাত ইসলাম ও বিশ্বাসের বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত এবং আল্লাহপ্রদত্ত হেদায়াত অনুসরণের মধ্যে রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ। একজন অমুসলিম তার ধর্ম অনুসরণের পাশাপাশি দুনিয়ার শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণের লক্ষ্যে ইসলামকে জীবনাদর্শ হিসেবে মেনে নিতে পারে। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের জীবনাদর্শ ইসলামের সহজ উপস্থাপন সময়ের দাবী। আল্লাহপাক সেভাবে ইসলামকে জানা, মানা ও সর্বস্তরের মানুষের কাছে পেশের যোগ্যতা আমাদেরকে দান করুন। আমিন। ৩১ মে ২০২০
ইসলাম ও সমসাময়িক বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগ
Comments
Post a Comment